বিশ্বে জ্বালানির দাম কমছে, এখানে বাড়ানোর যুক্তি কী

সরকার জ্বালানি তেলে লোকসানের কথা বলে দাম বাড়িয়েছে। তবে লোকসানের হিসাবে বড় গরমিল আছে। পেট্রল ও অকটেনে লোকসান না থাকলেও সেখানেও দাম বাড়ানো হয়েছে। ঘটা করে বলা হলো, পেট্রল ও অকটেন মূলত গ্যাসের উপজাত থেকে দেশেই উৎপাদন করা হয়। অথচ এক সপ্তাহ না যেতেই আমদানিনির্ভর নয়, এমন তেলের দামও বাড়াতে হলো।

আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম সর্বোচ্চ ৯২ ডলার। অর্থাৎ লিটারপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম মাত্র ৫৬ থেকে ৫৭ টাকা। এক ব্যারেল (১৫৯ লিটার) অপরিশোধিত তেলকে পরিশোধন করে ৭৩ লিটার পেট্রল, ৩৬ লিটার ডিজেল, ২০ লিটার জেট ও হেভি ফুয়েল, ৬ লিটার প্রোপেন এবং ২৪ লিটার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পেট্রোলিয়াম পণ্য তৈরি হয়। তেল শোধনে লিটারে খরচ পড়ে দেড় টাকা। শোধন, পরিবহন ও কিছু সিস্টেম-লস মিলে লিটারে খরচ সর্বোচ্চ ৬২ টাকা। কিন্তু বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লভ্যাংশ, সরকারের কর, শুল্ক, ভ্যাট—এই চার স্তরের মুনাফার পরে লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিন ১১৪ টাকা, পেট্রল ১৩০ এবং অকটেন ১৩৫ টাকা। অর্থাৎ ১ ব্যারেল অপরিশোধিত তেলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা খরচ করে সেটা বিক্রি করা হচ্ছে ২৫ হাজার টাকার কাছাকাছি।

পেট্রল ও অকটেন মূলত ধনীরা ব্যবহার করেন; ডিজেল সর্বসাধারণ, কেরোসিন গরিবেরা। অর্থাৎ অর্থনীতির শিল্প-উৎপাদক থেকে ভোক্তা, প্রান্তিক থেকে ধনী—সব পর্যায়েই দাম বাড়ানো হয়েছে অযৌক্তিক হারে। মাত্র ৯ মাসে আগেও ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল ২৩ শতাংশ, এখন আরও ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে কৃষিসেচ, গণপরিবহন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে সাড়ে ৬৫ শতাংশ। অথচ এই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারের গড় বৃদ্ধি সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ। এখন তেলের দাম কমেও আসছে দ্রুত। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের দাম বাড়ানোর মাত্রাটা একদিকে ভয়াবহ, অন্যদিকে অযৌক্তিক। দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি, করোনা মহামারির প্রভাব, ইউক্রেন যুদ্ধের পরে চলমান অর্থনৈতিক সংকট আর দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির সময়ে কেন এভাবে তেলের দাম বাড়িয়ে মানুষকে গণশাস্তি দেওয়া?

তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পরিবহন, দ্রব্যমূল্য, কৃষিসহ সব খাতেই ভয়াবহ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কয়েক দফা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং দুই অঙ্কের অসহনীয় মূল্যস্ফীতির বিপর্যস্ত সময়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে দারিদ্র্য বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ কার্বন-কর নেই এমন সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জ্বালানির মূল্য এ মুহূর্তে বেশি। বাংলাদেশের কৃষি, গণপরিবহন ও প্রান্তিক অর্থনীতির প্রধান তিন স্তম্ভ হচ্ছে সার, ডিজেল ও কেরোসিন। সরকার এই তিন খাতেই এমন পর্যায়ের মূল্য বাড়িয়েছে যে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে কর্মহীনতা, চাকরিচ্যুতি, অর্থকষ্ট ও ক্ষুধার আতঙ্ক শুরু হয়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন ধারার ‘জ্বালানি দারিদ্র্যের’ ভয়।

প্রশ্ন থেকে যায়, প্রাথমিক জ্বালানির ওপর ৩২ শতাংশ শুল্ক-মূসক-কর আদায় উদীয়মান অর্থনীতির দেশে আত্মঘাতী নয় কি? সরকারের আয় বাড়াতে পণ্য উৎপাদন এবং ব্যবসা সহজীকরণের প্রাথমিক ভিত্তিতেই বাধা তৈরির যৌক্তিকতা কোথায়? প্রাথমিক জ্বালানি আর কত দিন সরকারের আয়ের উৎস থাকবে? আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে গেলে বাংলাদেশে সঙ্গে সঙ্গে দাম কমে না কেন?

জ্বালানির মুনাফা হারিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুতের ভর্তুকিতে

২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ক্রমাগতভাবে বড় অঙ্কের মুনাফা করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), তবে ইউক্রেন যুদ্ধের পরে সংস্থাটির মোট মুনাফা কমেছে। বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বিপিসির ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা জমা আছে (বণিক বার্তা, ৮ আগস্ট ২০২২)। প্রতিষ্ঠানটি ফেব্রুয়ারি-জুলাই সময়ে ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান করলেও বিগত সাত অর্থবছরে ৪৮ হাজার ১২২ কোটি টাকা লাভ করেছে। শুধু ২০১৮-২২ চার অর্থবছরেই জ্বালানি থেকে শুল্ক কর ও লভ্যাংশ বাবদ সরকার নিয়েছে ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা।

বিপিসির ঠিক বিপরীত চিত্র পিডিবির ক্ষেত্রে। সংস্থাটিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে টানা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছেই এবং বড় অংশই অলস বসে থাকছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে প্রচুর আয় করেছে বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো। ১২ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে ৮৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এমনকি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতেও ৯ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় তিনটি পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়ের সমান অর্থ ভর্তুকি গেছে বিদ্যুৎ খাতে। ভর্তুকির প্রায় পুরোটাই অপ্রয়োজনীয় এবং অলস রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি ও ওভারহোলিং চার্জে গেছে। ডলারে বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে বলে ‘ডলার পাচার’ হচ্ছে। তীব্র জ্বালানিসংকটেও নেই বেশি জ্বালানি পুড়ে কম বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা অদক্ষ কেন্দ্র বন্ধের উদ্যোগ।

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ৮০ শতাংশ ব্যবহৃত হবে, এমন শর্তে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়। যদিও প্রকৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আসলে ঘোষিত সক্ষমতার অর্ধেক বা তার কিছু বেশি মাত্র। ‘অপ্রমাণিত ও মিথ্যা সক্ষমতা’ পুরো ব্যবহার করা যাচ্ছে না কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে পুরোটাই। প্রশ্ন হচ্ছে সরকার অর্থনীতির চালিকা শক্তি সার ও ডিজেলে ভর্তুকি দিতে অপারগ অথচ অলৌকিক কারণে বিদ্যুৎ খাতের বোঝা এভাবে বাড়িয়ে চলেছে? বিগত এক যুগে মাত্র শীর্ষ ১০ দেশি কোম্পানির ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৪৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। এদের প্রতি এই আনুকূল্যের পেছনে কার কী স্বার্থ কাজ করেছে—এ প্রশ্ন তোলা ও এর জবাবদিহি জরুরি।

সরকারের যা রাজস্ব আয় তা খরচ হয়ে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ বেপরোয়া ঋণের সুদে এবং জনপ্রশাসনের অতিরিক্ত ব্যয়ে। যেহেতু সরকার এক অর্থবছরেই রাজস্ব আয়ের চেয়ে বেশি ঋণ করেছে, তাই অভ্যন্তরীণ সুদের ভারে সরকার এখনই দিশাহারা। মূলত অভ্যন্তরীণ ব্যাংকঋণ, সঞ্চয়পত্র ঋণের সুদের ব্যয় এবং সরকারের পরিচালনা খরচ মেটাতেই ‘জ্বালানি’ থেকে আয়ের উদ্যোগ। সরকারের আয়-ব্যয়ের বৈষম্য রাজনৈতিক ইচ্ছাপ্রণোদিত।

জ্বালানি কূটনীতিতে সরকার অসচেতন ছিল

সরকার বিভিন্ন অটেকসই কৌশলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাফল্য আনলেও কখনোই জ্বালানি কূটনীতি নিয়ে একেবারেই মনোযোগ দেয়নি। ওপেকভুক্ত বড় তেল উৎপাদনকারী কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বড় পরিসরের স্থায়ী জ্বালানি তেলের সরবরাহ চুক্তি নেই। সরকারের প্রাথমিক জ্বালানি পরিকল্পনায় জ্বালানি নিরাপত্তা ও সরবরাহ নিশ্চয়তার ধারণা ছিল না, বরং ছিল স্পট মার্কেট আমদানিপ্রীতি। প্রাথমিক জ্বালানির উৎস এবং সরবরাহ নিশ্চয়তা না রেখেই বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে।

সবুজ জ্বালানিতেও অমনোযোগী বাংলাদেশ, দেশের ৫ শতাংশ বিদ্যুৎও সবুজ হয়নি। সাগরে গ্যাস উত্তোলনের স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই সরকারের। স্থলভাগের বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রের সংস্কার প্রস্তাব ফাইলবন্দী। ৫০ শতাংশ জ্বালানি কেনা হয় বিদেশের স্পট মার্কেট থেকে, যেখানে বিশেষ গোষ্ঠীর কমিশন–বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। ভোক্তার গ্যাসের বিলের একটা অংশ যায় জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলে, যা গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে খরচ করার কথা, কিন্তু হয়নি।

স্পট মার্কেট থেকে অতি উচ্চ মূল্যে প্রাথমিক জ্বালানি ক্রয়ে বেশি ডলার খরচ হচ্ছে বলেই তেল আমদানি এবং গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে, পরিকল্পিত লোডশেডিং করে সরকার ডলার বা রিজার্ভ সাশ্রয় করতে চায়। কিন্তু এর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারে তেলের দাম বাড়ানোর যোগসূত্র নেই। তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের টাকার রাজস্ব বাড়বে কিন্তু তাতে ডলার আয় বা রিজার্ভ বাড়বে না।

বাস্তবতা হচ্ছে সরকারের যা রাজস্ব আয় তা খরচ হয়ে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ বেপরোয়া ঋণের সুদে এবং জনপ্রশাসনের অতিরিক্ত ব্যয়ে। যেহেতু সরকার এক অর্থবছরেই রাজস্ব আয়ের চেয়ে বেশি ঋণ করেছে, তাই অভ্যন্তরীণ সুদের ভারে সরকার এখনই দিশাহারা। মূলত অভ্যন্তরীণ ব্যাংকঋণ, সঞ্চয়পত্র ঋণের সুদের ব্যয় এবং সরকারের পরিচালনা খরচ মেটাতেই ‘জ্বালানি’ থেকে আয়ের উদ্যোগ। সরকারের আয়-ব্যয়ের বৈষম্য রাজনৈতিক ইচ্ছাপ্রণোদিত।

আইএমএফের ঋণপ্রাপ্তির শর্তে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি?

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে প্রায় সাড়ে চার শ কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, তেলের দাম বাড়িয়ে আইএমএফের ভর্তুকি কমানোর শর্ত পূরণ করে নিল। অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের কালেও আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন কেন দেখা দিয়েছে, সেই মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করা জরুরি। জাইকা, এডিবি, বিশ্বব্যাংকের কাছেও বাংলাদেশ নতুন ঋণ চেয়েছে। অথচ বিগত দুটি অর্থবছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ ১৮ বিলিয়ন ডলার, যা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের কাছাকাছি।

বাংলাদেশকে যেকোনো মূল্যে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তাবিষয়ক ভর্তুকি চালিয়ে যেতে হবে। বড় আকারের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ চুক্তি নেই বলে বাংলাদেশের জ্বালানি সংকট দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে না। দরকারি আমদানি বন্ধ করে ডলার সাশ্রয় করলে বা জ্বালানির দাম বাড়ালেই অর্থনীতির সংকট কাটবে না, বরং সংকট বাড়বে, ব্যবসায়ীরা বেকার হবেন, রপ্তানিতে সমস্যা শুরু হবে। তাই সংকটের মধ্যে দরকারি ভর্তুকি টিকিয়ে রেখেই নীতি নির্ধারণ করতে হবে।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ [email protected]