পশ্চিমাদের পরাজয় সত্যিই কি হতে চলেছে?

সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ইমানুয়েল টোড যা-ই লিখেছেন, ইউরোপে সেটা দৈববাণী বলে মনে করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।ছবি : রয়টার্স

‘এই ঘরের মধ্যে কেউ যদি চিন্তা করেন ইউক্রেনে পুতিন থেমে যাবেন, তাঁকে আমি আশ্বস্ত করতে চাই, পুতিন থামবেন না।’ বৃহস্পতিবার রাতে স্টেট অব ইউনিয়নে বক্তৃতাকালে জো বাইডেন এ কথা বলেন। ন্যাটোর সবচেয়ে নবীন সদস্য সুইডেনের প্রেসিডেন্ট উলফ ক্রিস্টারটনকে স্বাগত জানিয়ে বাইডেন বলেন, ইউরোপ ‘ঝুঁকিতে’ আছে।

কিন্তু বাইডেন এ কথাও বলেন যে ইউরোপের প্রতিরক্ষার জন্য আমেরিকান সেনা প্রয়োজন হবে না, এ ব্যাপারে তিনি আগের মতোই ‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ অবস্থানে রয়েছেন। গত সপ্তাহে যেমনটা হোয়াইট হাউসের মুখপত্র বলেছিলেন, ইউক্রেনে স্থল সেনা পাঠানোর ব্যাপারটি তাঁদের চিন্তায় নেই, সেটা পানির মতো পরিষ্কার।

এ কথায় সুইডেনের প্রেসিডেন্টের মাথা অবশ্যই ঘোরা উচিত। ন্যাটোকে যুদ্ধে টেনে আনা, নতুন সদস্য সুইডেনকে ন্যাটোর সদস্য করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী যুক্তি ছিল, রাশিয়ার পরবর্তী আগ্রাসন। কিন্তু এই আগ্রাসন যদি সত্যিকারের উদ্বেগ হতো, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ইউক্রেনে স্থল সেনা পাঠানোর বিকল্প কিছু ছিল না।

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা যে মুহূর্তে স্পষ্ট হওয়া দরকার ছিল, সেটা আরও অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা সমস্যা। কারণ, আমেরিকানদের মতো ইউরোপীয়ানরা এই যুদ্ধ নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এই যুদ্ধে ইউক্রেন জিততে পারবে কি না, তা নিয়ে তাঁদের সন্দেহ বেড়েই চলেছে। কিন্তু সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রকে অবিশ্বাস করছেন। দুই দশক আগে ইরাক যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও সক্ষমতা নিয়ে যে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল, তা দূর করার সামান্য উদ্যোগই নিয়েছে ওয়াশিংটন।

আমেরিকানরা অনেক সময় বিশ্বাস করেন যে তাঁরা যে মেরুকরণ করেছেন, সব পশ্চিমা সমাজেই তার প্রতিফলন থাকবে। ইউরোপের অভিজাতেরা দেখছেন যে রাশিয়ার আগ্রাসন রুখে দিতে ন্যাটো একটি যুদ্ধ করছে। কিন্তু সাধারণ লোকদের ধারণা হলো, আমেরিকান অভিজাতেরা এমন একটা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যাতে নিজেদের আধিপত্যের ওপর যেন চ্যালেঞ্জ না আসে। সেই যুদ্ধে যতই  সমান্তরাল ক্ষতি হোক না কেন, তাতে কিছু যায়-আসে না আমেরিকান অভিজাতদের।

মুনাফায় একমাত্র বিষয় নয়, যেটা বিশ্বে আমেরিকা করে । তারা একটা উদার মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যবস্থাও বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। সেটাকে অনেক সময় বলা হয়, সর্বজনীন মানবাধিকার। টোড সতর্ক করে দেন যে সম্প্রতি আমেরিকানরা যে মূল্যবোধ ছড়াচ্ছে, সেটা যতটা বিশ্বজনীন, তার চেয়ে অনেক বেশি আমেরিকান ভাবনা।

যা-ই হোক, আমেরিকান নেতৃত্বের পতন হচ্ছে। জানুয়ারি মাস থেকে ফ্রান্সে সর্বোচ্চ বিক্রীত বইয়ের তালিকায় যে নতুন বইটি উঠে রয়েছে, সেই বইয়ের যুক্তি এটি। ইংরেজি করলে বইটির নাম হবে দ্য ডিফিট অব দ্য ওয়েস্ট (পশ্চিমের পরাজয়)। বইটির লেখক ইমানুয়েল টোড একজন জনপ্রিয় ইতিহাসবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ। ১৯৭৬ সালে তিনি তাঁর দ্য ফাইনাল ফল (চূড়ান্ত পতন) বইয়ে শিশুমৃত্যুর পরিসংখ্যান ব্যবহার করে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হতে চলেছে।

এর পর থেকে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে টোড যা-ই লিখেছেন, ইউরোপে সেটা দৈববাণী বলে মনে করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। ২০০২ সালে তাঁর বই আফটার দ্য এম্পায়ার-এ ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় যে আমেরিকান বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়তে চলেছে। ৯/১১-এর হামলার পর আমেরিকায় যে জাতীয় সংহতি গড়ে উঠেছিল, সেখানে টোডের সেই ভবিষ্যদ্বাণী তীব্রভাবে বিরোধিতা করা হয়েছিল।

ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকানদের সম্পৃক্ততার একজন কঠোর সমালোচক টোড। এক বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে টোড বলে আসছেন, পশ্চিমারা এই যুদ্ধের একটি বিস্ময়ের ওপর অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে আসছে। সেটা হলো, রাশিয়ার বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরোধ। কিন্তু এই যুদ্ধের দ্বিতীয় বিস্ময়ের ব্যাপারে তারা একেবারেই নিশ্চুপ। সেই বিস্ময়টি হলো, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পরও রাশিয়ার টিকে থাকার সক্ষমতা। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি ধসে পড়বে।  

যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাবকে ব্যবহার করে পশ্চিমা মিত্রদের টেনে আনতে পারলেও বিশ্বের বড় ও নতুন অর্থনীতির খেলোয়াড়দের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়নি। রাশিয়ার  কাছ থেকে ভারত কম দামে জ্বালানি কেনার সুবিধা নেয়। চীন রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন পণ্য ও ইলেকট্রনিক উপকরণ সরবরাহ করছে।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও এর ইউরোপীয় মিত্ররা ইউক্রেনকে যে সহায়তা (বিশেষ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ) দিচ্ছে, তা অপর্যাপ্ত। তা দিয়ে যুদ্ধ জয় তো দূরে থাক, একটা স্থিতিশীল অবস্থা ধরে রাখাও কঠিন। পররাষ্ট্রনীতির প্রতিশ্রুতি পূরণের পথে যুক্তরাষ্ট্র নেই।
টোড হিসাব কষে দেখান যে রাশিয়ার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র কমসংখ্যক ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করে। এটা শুধু মাথাপিছু হিসাবেই কম নয়, সংখ্যার দিক থেকেও কম।

তিনি মনে করেন এর ফলে আমেরিকা একধরনের ‘অভ্যন্তরীণ মেধা পাচারের’ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উচ্চ দক্ষতা, উচ্চ চাহিদা ও উচ্চ মূল্য সংযোজন করতে পারে, এমন পেশা ছেড়ে আইন, আর্থিক খাত বা এ রকম সব পেশায় তরুণেরা আগ্রহী হচ্ছেন। এসব পেশা অর্থনীতিতে সামান্যই মূল্য সংযোজন করতে পারে।

টোড বলেন যে পশ্চিমারা তাদের শিল্প সচল রাখতে আউটসোর্সিংয়ের যে নীতি নিয়েছে, সেটা খারাপের চেয়ে বেশি খারাপ। এটা প্রমাণিত যে আউটসোর্সিং বাকি বিশ্বকে শোষণের প্রকল্প। কিন্তু মুনাফায় একমাত্র বিষয় নয়, যেটা বিশ্বে আমেরিকা করে । তারা একটা উদার মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যবস্থাও বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। সেটাকে অনেক সময় বলা হয়, সর্বজনীন মানবাধিকার। টোড সতর্ক করে দেন যে সম্প্রতি আমেরিকানরা যে মূল্যবোধ ছড়াচ্ছে, সেটা যতটা বিশ্বজনীন, তার চেয়ে অনেক বেশি আমেরিকান ভাবনা।

  • খ্রিস্টোফার কাল্ডওয়েল, কলাম লেখক এবং দ্য এইজ অপ ইনটাইটেলমেন্ট: আমেরিকা সিনস দ্য সিক্সটিজ বইয়ের লেখক
    দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত