আইনের শাসন নাকি ‘জঙ্গলের শাসনের’ পথে যাবে ভারত

আতিক আহমেদকে হত্যার দৃশ্যটি তদন্তের জন্য অভিনয়ের মাধ্যমে ধারণ করে উত্তর প্রদেশের পুলিশ। যদিও পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা হয়
ছবি: সংগৃহীত

গত মাসে টিভি চ্যানেলগুলোর সরাসরি সম্প্রচারের মধ্যেই কুখ্যাত গ্যাংস্টার ও ভারতের পার্লামেন্টের প্রাক্তন সদস্য আতিক আহমেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একটি আধুনিক গণতন্ত্রে কেমন করে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে সে বিষয়ে উদ্বেগজনক বিতর্কের জন্ম হয়েছে।

ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া খুনিদের সঙ্গে ভারতের গোটা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাও এখন কার্যত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে।

আতিক আহমেদ একটি অপহরণ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়ে জেলে ছিলেন এবং চাঁদাবাজি–খুনসহ বহু অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা বিচারাধীন ছিল। ঘটনার দিন, আতিককে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জেলখানা থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল।

হাসপাতালের গেটের সামনে পুলিশ ভ্যান থেকে বের হওয়ার পর হাতকড়া পরা আতিক আহমেদকে টেলিভিশন ক্যামেরাগুলো ঘিরে ধরে এবং সাংবাদিকেরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকেন।

এদের মধ্যে ‘সংবাদমাধ্যম কর্মী’ হিসেবে আসা তিন ব্যক্তি আচমকা বন্দুক বের করেন এবং সবার সামনে আতিক ও তাঁর ভাইকে গুলি করে হত্যা করেন। ভিকটিমরা মাটিতে পড়ে যখন তড়পাচ্ছিলেন তখন ক্যামেরা ধরা লোকগুলোকে ছোটাছুটি করতে দেখা যাচ্ছিল।

এই হত্যাকাণ্ড ভারতের বেশির ভাগ নাগরিককে ধাক্কা দিলেও অনেকে, বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডটির ঘটনাস্থল উত্তর প্রদেশে অনেকেই উল্লাস প্রকাশ করেছেন।

আরও পড়ুন

অভয় শুক্লা নামের একজন ব্লগার এই হত্যাকাণ্ডের উদ্‌যাপন দেখে আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এটি কোনো পরিপক্ব গণতন্ত্র হতে পারে না। এই হত্যাকাণ্ডের পর ভারতীয় সমাজ পৈশাচিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে; মন্ত্রীরা পর্যন্ত এটিকে “ভগবানের মার” বলে ন্যায্যতা দিয়েছেন; ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বিশাল অংশ হোয়াটসঅ্যাপ ও টুইটারে “মাফিয়া ডনের” মৃত্যুকে উদ্‌যাপন করেছে।’

হত্যাকাণ্ডের পর বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি পুলিশ জড়িত ছিল। বলা হচ্ছে, পুলিশ হাসপাতালের ভেতরে না ঢুকে হাসপাতালের বাইরে পুলিশ ভ্যানটি দাঁড় করিয়েছিল, অথচ গাড়িটি সরাসরি ভেতরে নিয়ে যাওয়া যেত।

আতিক আহমেদকে হাসপাতালে আনার খবর সংবাদকর্মীরা আগেই জানতেন এবং তাঁদের আহমেদকে ঘিরে ধরতে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, হামলাকারীরা বুঝতে পারছিলেন, সাংবাদিকদের মতো পোশাক পরা থাকলে তাঁদের ভিকটিমদের কাছে যেতে কোনো বাধা পেতে হবে না মনে করেই তাঁরা সে ধরনের পোশাকে ছিলেন। যখন সাংবাদিকেরা আহমেদ ও তাঁর ভাইকে ঘিরে ধরছিলেন, তখন পুলিশের দিক থেকে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। ফলে নির্বিঘ্নেই খুনিরা গুলি চালাতে পেরেছে।

আরও পড়ুন

পুলিশের মদদে ঘটা যে কোনো হত্যাকাণ্ডই ভয়াবহ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা আরও গভীরে।

এই ধরনের একটি কাজে সাহায্য করার বা সেটিকে উদ্‌যাপন করার সম্ভাব্য উসকানির মধ্যে ভারতের ফৌজদারি-বিচারব্যবস্থার প্রকৃত দুর্বলতার ছবি দেখা যাচ্ছে।  

উত্তর প্রদেশ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব অর্জনে পেশিশক্তি ব্যবহারকারী গ্যাংস্টার এবং হিংস্র অপরাধীদের আড্ডাস্থল হিসাবে পরিচিত ছিল। অপহরণ, চাঁদাবাজি, ‘জমি দখল’ (প্রায়শই বন্দুকের মুখে অপরের সম্পত্তি কুক্ষিগত করা), দুর্নীতি, সরকারি কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি দেখানো এবং হত্যা রাজ্যটির অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।

এই ধরনের বেআইনি কাজকারবার স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের ছত্রচ্ছায়ায় সংঘটিত হচ্ছে। রাজ্যটির সামনের সারির দলগুলো নির্বাচনে গ্যাংস্টারদের ‘টিকিট’ দিয়ে থাকে এবং সাধারণত তাঁরাই ভোটে জিতে থাকে। পুলিশ আইন ভঙ্গকারীদের সাজার আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করতে ব্যর্থ হওয়ায় বিচারকাজ ব্যাহত হয় এবং তাঁরা প্রায়শই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। এতে অপরাধ আগের চেয়ে বাড়তে থাকে।

এই পটভূমিতে ২০১৭ সালে উগ্র ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির নেতা যোগী আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছিলেন। ক্ষমতাসীন বিজেপির প্রতিনিধি হিসেবে আদিত্যনাথ যেভাবেই হোক মাফিয়া চক্র ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেন। আদিত্যর অনুসারীরা দাবি করে থাকেন, তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ভারতের অন্য স্থানে অপরাধের হার কমতে থাকলেও যোগী আদিত্যর প্রশাসনের আইন লঙ্ঘনের জন্য গোটা ভারতকে খেসারত দিতে হচ্ছে। তিনি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত পুলিশ সেখানে ১৮৩ জন কথিত অপরাধীকে হত্যা করেছে।

প্রকাশ্যে আহমেদের এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পর আদিত্যনাথ ‘সব মাফিয়াকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হবে’ বলে দম্ভোক্তি করেছেন।

সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের বাড়িঘর কোনো রকম আইনের তোয়াক্কা না করে আক্ষরিক অর্থে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে ‘বুলডোজার বিচার’ প্রতিষ্ঠার কুখ্যাতি পাওয়া একজন নেতার এ ঘোষণাকে স্বাভাবিকভাবেই অশুভ অঙ্গীকার বলে মনে করা যেতে পারে। তবে গ্যাংস্টারদের ত্রাসের মধ্যে বসবাসকারী নাগরিকদের কাছে এটি একটি স্বস্তিদায়ক ঘোষণা বলেও মনে হচ্ছে।

আরও পড়ুন

ভারতের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো উত্তর প্রদেশ থেকে অন্যান্য স্থানেও ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এই তো গত মাসেই ২০০২ সালে আহমেদাবাদের নরোদা গাম গণহত্যার অভিযুক্ত ৬৯ জন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

২০০৮ সালের মে মাসে জয়পুরে সংঘটিত বোমা হামলায় ৭১ জন নিহত ও ১৮৫ জন আহত পর যে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, গত মার্চে তাঁদের সবাইকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

উভয় ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে; দ্বিতীয়ত, খালাসপ্রাপ্তরা বছরের পর বছর জেলে কাটিয়েছে।

মামলাগুলো ভন্ডুল হওয়ার কারণ এই নয় যে, উদার বিচার বিভাগ আইন ভঙ্গকারীদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে; বরং এর আসল কারণ হলো, আদালতে পেশ করা প্রমাণগুলো আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি মান পূরণ করে না। এটি অংশত পুলিশি দুর্বলতাকেই তুলে ধরে।

উত্তর প্রদেশের মতো উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পুলিশের যেনতেনপ্রকারেণ তদন্তকাজ চালানো, প্রমাণ জাল করা এবং পেশাদারির অভাব প্রদর্শনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।

অধিকন্তু, সাক্ষীরা প্রায়ই সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়ে যথাযথভাবে প্রস্তুত থাকে না। তাঁদের অনেকেই পুলিশি সুরক্ষার ওপর ভরসা রাখতে পারে না এবং ঘুষের লোভে পড়ে কিংবা ভীতি প্রদর্শনে দুর্বল হয়ে পড়ে। বছরের পর বছর এমনকি কয়েক যুগ ধরেও অনেক মামলা ঝুলে থাকে। ফলে সাক্ষীরা ঘটনার অনেক কিছু ভুল যান, এমনকি বিচার শুরু হওয়ার আগে অনেক সাক্ষীর মৃত্যুও হয়ে যায়।

এই সব ব্যর্থতার পেছনে কাঠামোগত কারণ কাজ করে। অনেক পুলিশ সদস্য, বিশেষ করে নিম্নস্তরের পুলিশ সদস্যরা মেয়াদোত্তীর্ণ মামলার তদন্ত করা ও প্রমাণ সংগ্রহের বিষয়ে অতিরিক্ত কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ পায় না। সেই মান্ধাতা আমলের ঔপনিবেশিক কায়দায় বিচার কাজ চলে বলে কেউই পুরোনো মামলাগুলো পুনরুজ্জীবনের হ্যাপা পোহাতে চান না। ফলে উত্তর প্রদেশের মতো বিভিন্ন রাজ্যে রাজনীতিক এবং অভিযুক্তরা প্রায়শই একজন আরেকজনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকেন।

যখনই কোনো আলোচিত মামলা ভেস্তে যায়, তখনই বিচার পরিচালনায় অধিকতর সাবধানতার জিগির তোলা হয়। কিন্তু আদতে যেটি দরকার তা হলো, পুলিশ বাহিনী, বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার করা।

এ অবস্থায় উত্তর প্রদেশ ও তার বাইরের রাজ্যগুলোতে ভারতীয়দের এখন সোজাসাপ্টা একটি পথ বেছে নিতে হবে। হয় তাদের আইনের শাসনের পথে হাঁটতে হবে, নয়তো জঙ্গলের শাসনের পথে যেতে হবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির একজন এমপি ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব