আধপেটা খেয়ে শিক্ষকেরা কী ছাত্র পড়াবেন

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিক্ষকেরা ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করছেন

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির আহ্বানে সাড়া দেননি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। তাঁরা বলেছেন, ‘দাবি আদায় করেই ঘরে ফিরে যাব।’ শিক্ষকদের ‘ঘর’ মানে শ্রেণিকক্ষ। ১১ জুলাই থেকে শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত শিক্ষক ঢাকায় এসে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করছেন জুলাইয়ের চড়া রোদ উপেক্ষা করে। শিক্ষা বিভাগের বড় কর্তারা যখন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে আরাম করছেন, তখন বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকেরা রাস্তায় মশার কামড় খাচ্ছেন।

প্রতিবারই শিক্ষকদের দাবি আদায়ে আন্দোলন করতে হয়। কেবল প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা কলেজশিক্ষক নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও গ্রেড পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। এ থেকেই শিক্ষকদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা স্পষ্ট। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছেন। বেতন-ভাতায় সমতা আনার কথা বলেছেন। বর্তমানে তিন শ্রেণির মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। সরকারি, এমপিওভুক্ত বেসরকারি ও নন-এমপিও বিদ্যালয়।

সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা একই পাঠক্রমে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়ান। কিন্তু তাঁদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা এক নয়। এমপিওভুক্ত বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বর্তমানে মূল বেতন পুরোটাই পান। আগে পেতেন ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। কিন্তু বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতার ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল ফারাক। 

সরকারি শিক্ষকেরা মূল বেতনের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িভাড়া পান। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা পান মাত্র এক হাজার টাকা। সরকারি শিক্ষকেরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের সমান। বেসরকারি শিক্ষকেরা পান মাত্র ২৫ শতাংশ। চিকিৎসা ভাতা দেওয়া হয় মাত্র ৫০০ টাকা। শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা না দিলে ভালো মানের পাঠদান আশা করা যায় না।

আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। শিক্ষকেরা মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি জানান। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও শিক্ষকদের বলা হয়েছিল, জাতীয়করণের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। 

দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা খাতে বাংলাদেশে বরাদ্দ যেমন কম, তেমনি কম শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রভাষকের মূল বেতন ২২ হাজার টাকা, সহকারী অধ্যাপকের ৩৫ হাজার ৫০০ এবং অধ্যাপকের ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। ভারতে শিক্ষকতা শুরু সহকারী অধ্যাপক দিয়ে। সহকারী অধ্যাপকদের বেতন স্কেল ৫৫ হাজার টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ৯০ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ—সব স্তরেই বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন তুলনামূলক কম। 

শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে জাতীয়করণের যৌক্তিকতা আছে কি নেই, সেটিসহ শিক্ষা, শিক্ষকদের সার্বিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে দুটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। দুই কমিটির প্রতিবেদনের পর এ নিয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। দীপু মনি বলেছেন, আগামী আগস্টের শেষ নাগাদ এই দুই কমিটি গঠন করা সম্ভব হবে। শিক্ষকদের দাবি পূরণ নয়, দাবিদাওয়ার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কমিটি করতে দেড় মাস লাগবে কেন? সেটি কি এক সপ্তাহের মধ্যে করা যেত না? যত দিন শিক্ষকেরা আন্দোলনে আছেন, তত দিন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাও বন্ধ থাকবে।

শিক্ষকদের এই আন্দোলনের বিষয়ে ‘সতর্কবার্তা’ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। অধিদপ্তর থেকে পৃথক পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানে কতজন শিক্ষক অনুপস্থিত আছেন, তা তদারক করতে মাউশির পক্ষ থেকে স্কুলের গভর্নিং বডি ও স্থানীয় প্রশাসনকে বলা হয়েছে। 

সরকার কি মনে করে ধমক দিয়ে শিক্ষকদের ঘরে ফেরানো যাবে? অধিদপ্তরের নির্দেশনায় তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) নেতারা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তাঁরা অবস্থান কর্মসূচিতে থাকবেন।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতেও বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে ১৫ দিন অনশন করেছিলেন বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকেরা। ওই সময়ও শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণসহ কয়েক দফা দাবিতে শিক্ষকেরা আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরামের নামে। সরকারের পক্ষ থেকে তখনো বছরে ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।

শিক্ষক সমিতির একজন নেতার সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানান, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় তাঁরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এরপর শিক্ষকেরা প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদকের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘শিক্ষকেরা যখন আন্দোলনে নেমেছেন, খালি হাতে ফিরে যাবেন না।’

যে শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে থাকার কথা, তাঁরা কেন প্রেসক্লাবের সামনে খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়বেন, বৃষ্টিতে ভিজবেন? শিক্ষকদের আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এমনিতেই করোনায় তাদের স্বাভাবিক শিক্ষার কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। অনেক বিষয়ে তারা পুরো পাঠ নিতে পারেনি। যেখানে শিক্ষাবিদেরা আগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বেশি বেশি ক্লাস নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেখানে স্বাভাবিক ক্লাসই বন্ধ আছে। অথচ সরকার নির্বিকার।

শিক্ষাক্ষেত্রে একধরনের নৈরাজ্য চলছে। সরকার একের পর এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করছে। কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে উপেক্ষা করে চলেছে। কুদরাত-এ–খুদা শিক্ষা কমিশন ও ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার কথা ছিল। গত ১০ বছরেও সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে যে আইন করার কথা ছিল, সেটাও হয়নি।

প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত রাখায় শিক্ষার কী হাল হয়েছে, সেটা বেরিয়ে এসেছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের এক সাম্প্রতিক গবেষণায়। সরকারের দাবি, দেশের সাক্ষরতার হার ৭৪ শতাংশ। তাদের সবারই পড়তে ও লিখতে পারার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে দেখা যায়, পড়তে, লিখতে ও যোগাযোগ করতে পারে ৬৩ শতাংশ মানুষ। বাকি ১১ শতাংশ কী কেবল নাম সই করার জন্যই পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছে? সরকার বিনা মূল্যে সবাইকে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কৃতিত্ব দাবি করে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার একটা বড় অংশ বেসরকারি খাতে চলে গেছে। একমুখী শিক্ষার বদলে চারমুখী শিক্ষা চালু আছে। 

আরও পড়ুন

শিক্ষকেরা যে মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের দাবি করেছেন, তার যৌক্তিকতা ও সরকারের সক্ষমতা নিয়ে কেউ কেউ  প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিটি যে শতভাগ যৌক্তিক, সে কথা স্বীকার করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে সরকারের যে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন, সেটি জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেয়ে বেশি নয়।

দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা খাতে বাংলাদেশে বরাদ্দ যেমন কম, তেমনি কম শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রভাষকের মূল বেতন ২২ হাজার টাকা, সহকারী অধ্যাপকের ৩৫ হাজার ৫০০ এবং অধ্যাপকের ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। ভারতে শিক্ষকতা শুরু সহকারী অধ্যাপক দিয়ে। সহকারী অধ্যাপকদের বেতন স্কেল ৫৫ হাজার টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ৯০ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ—সব স্তরেই বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন তুলনামূলক কম। 

উন্নত জাতি গড়ে তোলার জন্য উন্নত শিক্ষা জরুরি। আর উন্নত শিক্ষার জন্য যে দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক প্রয়োজন, ভালো বেতন-ভাতা না দিলে সেটি পাওয়া সম্ভব নয়। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন একটি লেখায় বলেছিলেন, ‘আধপেটা খেয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা নামতা শেখে।’ কিন্তু আধপেটা খেয়ে তো শিক্ষকেরা তাদের পড়াতে পারেন না।’

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]