শ্রীলঙ্কায় মোবাইল সাংবাদিকতা যখন গণতন্ত্র চর্চার হাতিয়ার

গত সাত বছরে শ্রীলঙ্কার প্রায় এক হাজার সাংবাদিক মোবাইল সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকতা নৈতিকতার শিক্ষা পেয়েছেন। তার সমাপনী সম্মেলন।

মোবাইল জার্নালিজম বা মোজো কি গণতন্ত্র চর্চার হাতিয়ার হতে পারে? এর জবাব একই সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’। হ্যাঁ, কারণ একমাত্র মোবাইল ফোনে ভর করেই সাধারণ মানুষ এখন তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন এবং তা বৃহৎ পরিসরে। আবার সব মানুষ যখন কোনো প্রথা বা নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিজ নিজ বক্তব্য প্রকাশ করতে থাকবেন, তখন নিঃসন্দেহে তা বিশৃঙ্খলার কারণ হবে। এ ছাড়া ঝুঁকি থাকে ভুয়া সংবাদ প্রচারেরও। তবে যখন ক্ষমতাবান ও ধনীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, সংবাদমাধ্যমও চাপা পড়ে যায় সাধারণের প্রতিনিধিত্ব, এমন সময়ে মোবাইল ফোন হতে পারে মতপ্রকাশের মোক্ষম এক হাতিয়ার।  

মোবাইল সাংবাদিকতার সাহায্যে গণতন্ত্র চর্চার প্রয়াস নিয়ে গত ২৪ ও ২৫ জুন শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মোজোলংকা, দেশটির প্রথম মোবাইল সাংবাদিকতাবিষয়ক সম্মেলন। ইউএসএইডের অর্থায়নে, মিডিয়া এমপাওয়ারমেন্ট ফর আ ডেমোক্রেটিক শ্রীলঙ্কা নামের একটি প্রকল্পের আওতায় গত সাত বছরে শ্রীলঙ্কার প্রায় এক হাজার সাংবাদিক মোবাইল সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকতা নৈতিকতার শিক্ষা পেয়েছেন। তারই সমাপনী এই সম্মেলন।

দ্বীপরাষ্ট্রটির আনাচেকানাচে থেকে সাংবাদিক এবং সাধারণ নাগরিকেরা এসেছিলেন সম্মেলনে অংশ নিতে। শ্রীলঙ্কায় মূলত দুটি ভাষা চলে, রাষ্ট্রভাষা সিংহলীর সঙ্গেই বাস করেন তামিলভাষীরা। তাঁদের ভাষাগত কোনো সাদৃশ্য নেই, একে অপরের ভাষাও খুব একটা বোঝেন না। তা–ও দীর্ঘ সংঘাতের পরে তাঁরা সহাবস্থানে এসেছে। তাই দুই ভাষাতেই মোবাইল কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের কাজকে প্রদর্শনের ব্যবস্থা ছিল। সুযোগ ছিল মোবাইল দিয়ে কনটেন্ট বানানো শেখার। আয়োজকেরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন মোবাইল সাংবাদিকতা থেকে যেন সাংবাদিকতার নৈতিকতা বাদ না পড়ে, তথ্যের সত্যতা রক্ষা পায় এবং গণসাংবাদিকতার পরেও গণমাধ্যমের মূলনীতি ব্যাহত না হয়।

দুই দিনের অনুষ্ঠানে মোট ১৮টি সেশন ছিল।

বহির্বিশ্ব শ্রীলঙ্কার অবস্থান এখনো একটি নাজুক রাষ্ট্র হিসেবে। তীব্র অর্থনৈতিক দুরবস্থায় গত বছর ঘটে যাওয়া বড় বিক্ষোভের আগে থেকেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায় ছিল দেশটি। বিপ্লব আরেকটি অস্থিরতার সাক্ষ্য দিয়ে গেছে।

সিংহলি শব্দ ‘আরাগালইয়া’ বা ইংরেজি রেভল্যুশন বিশ্বে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ সংকট বিশদভাবে তুলে ধরলেও দেশটিকে বড় কোনো বদল দিতে পারেনি। সবকিছু থেমে যাওয়ার পরেও বিশ্ববাসীর মনে প্রশ্ন রয়ে গেছে, শ্রীলঙ্কা কি এখন নিরাপদ? সেখানে আন্দোলন কি এখনো চলছে? এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিকও নয়। মাত্র এক বছর আগে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের সর্বোচ্চ শক্তির বহিঃপ্রকাশ করেছে। সেই শক্তির উপযোগ তৈরি করাই ছিল মোজোলঙ্কার লক্ষ্য।

দুই দিনের অনুষ্ঠানে মোট ১৮টি সেশন ছিল। শুরুর মূল বক্তব্য চমকে দেন অভিজ্ঞ মোবাইল জার্নালিস্ট গ্লেন মুলকাহি। তাঁকে মোবাইল সাংবাদিকতায় পথিকৃৎ বলা হয়।

প্রায় পনেরো বছর আগে আয়ারল্যান্ডের জাতীয় গণমাধ্যম আরটিইতে ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করে সংবাদ তৈরির মাধ্যমে শুরু হয় মোবাইল সাংবাদিকতার যাত্রা। মোবাইল সাংবাদিকতার শিক্ষার সবচেয়ে পুরোনো এবং প্রতিষ্ঠিত সংস্থা মোজোফেস্টের কর্ণধারও তিনি। মূলকাহিনির তাঁর মূল বক্তব্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগ্রাসনে মোবাইল সাংবাদিকতার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন। মূলত তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শক্তিকে ব্যবহার করে সাংবাদিকতার কাজতে আরও নিখুঁত করার বিষয়ে আলোকপাত করেন।

দ্বিতীয় সেশনে কথা হয় সাধারণ মানুষদের সংবাদ তৈরির প্রবণতা নিয়ে আলোচনা হয় ভুল তথ্য প্রচার এবং সাংবাদিকতা সতর্কতারও। এর ফাঁকে ফাঁকে চলে মাস্টারক্লাস, কীভাবে একটা মোবাইল ফোন দিয়েই শুরু করা যায় সাংবাদিকতা, কীভাবে বলতে হবে গল্প অথবা কেমনই হবে নতুন যুগের দর্শকদের চাহিদা।

মাত্র এক বছর আগে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের সর্বোচ্চ শক্তির বহিঃপ্রকাশ করেছে। সেই শক্তির উপযোগ তৈরি করাই ছিল মোজোলঙ্কার লক্ষ্য।

থমসন ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষক ও কমিউনিকেশন এডিটর ক্যাথরিন ম্যাকি সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মোবাইল ফোন দিয়ে সংবাদ উপস্থাপনের গোপন সূত্র শেখান। ব্রিটিশ ব্রডকাস্ট করপোরেশনে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকা এই সাংবাদিক জানান, মাধ্যম বা ধরন যতই বদলাক না কেন, সংবাদকে যতটা সম্ভব মানবঘনিষ্ঠ হতে হবে। সেখানে সাংবাদিকের বর্ণনা যেন কখনো সাধারণ মানুষের বক্তব্যকে ছাপিয়ে না যায়। তিনি আরও বলেন, সংবাদ হোক বা হালের কনটেন্টের দর্শক ধরে রাখতে হলে কে, কী, কেন, কোথায়, কখন, কীভাবে প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে।

প্রথম দিনের শেষ বেলা কাটে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাম্প্রতিক বিপ্লবের সংবাদ তৈরির অভিজ্ঞতা ভাগ করার মধ্য দিয়ে। তাঁরা বলেন, এমন বিপ্লবের মতো অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মোবাইল সাংবাদিকতা কতটা নিরাপদে এবং দ্রুত তাদের সংবাদ তৈরিতে সহায়তা করেছে।

দ্বিতীয় দিন ছিল রোববার, শ্রীলঙ্কায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ছুটির দিনের আরাম ছেড়ে সকালেই অংশগ্রহণকারীরা অংশ নেন কার্যক্রমে। সেদিনের আকর্ষণ ছিলেন বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনের সাবেক প্রধান পরামর্শক ও হেওয়ার্ড ব্ল্যাক মিডিয়ার মাল্টিমিডিয়া পরামর্শক ডেভিড হেওয়ার্ড। গণমাধ্যমের নৈতিকতা বিষয়ে কারণ সাংবাদিকতা কাগজে–কলমে হোক কি মোবাইল ফোনের ক্যামেরায়, নৈতিকতা জানতে হবে সব মানুষকেই, এ বিষয়টিই আবার মনে করিয়ে দেন তিনি।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় মোবাইল সাংবাদিকতার একটা আলাদা জায়গা আছে। এর কারণ শ্রীলঙ্কার জনপ্রিয় মোবাইল সাংবাদিক কেসি সারাঙ্গা। তামিল এ তরুণ মোবাইল ফোনের সাহায্যেই একটা নিউজরুম চালান। এখন পর্যন্ত প্রায় হাজারজন সাংবাদিককে মোবাইল ফোনে সাংবাদিকতা করার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। সারাঙ্গা মোবাইল ফোন দিয়ে টিভি স্টেশন চালানো শেখান। এ লেখার লেখক বাংলাদেশি সাংবাদিক মাকসুদা আজীজ শেখান মেটাডেটা ব্যবহার করে দর্শক চেনার কৌশল। ইউক্রেন থেকে অনলাইনে যোগ দেন ইউক্রেনের সাংবাদিক দিমা খিলচেঙ্কো, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে মোবাইল ফোন হাতে তাঁদের টিকে থাকার কৌশল শেখাতে।

যখন একটা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়, সে দেশের সংবাদের বড় অংশ জুড়ে থাকে রাজনৈতিক খবর। রাজাদের প্রতি পদক্ষেপের খবরের পেছনে হারিয়ে যায়, অর্থনীতি, নাগরিক অধিকার, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও। সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয় সাধারণ মানুষের গল্প, ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানবাধিকার। শ্রীলঙ্কাও এর ব্যতিক্রম নয়। তারপরেও মোবাইল সাংবাদিকতার শিক্ষা নবীন শ্রীলঙ্কান সাংবাদিকদের খবর উপস্থাপনের এক নতুন ধারার সন্ধান দেয়। এর প্রভাব দেখা যায়, মোবাইল সাংবাদিকতা প্রতিযোগিতার প্রতিযোগীদের কাজে। পেশাদার ও অপেশাদার মোবাইল সাংবাদিকদের কাজে উঠে আসে পা ছাড়া জেলের গল্প, সার্কাসে কাজ করা মানুষদের কথাও।

মোজোলঙ্কা শেষ হয় মোবাইল সাংবাদিকতা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়ার মধ্য দিয়ে। দুই দিনের এই সম্মেলন শেষ হওয়ার সঙ্গে শেষ হয় না মোবাইল সাংবাদিকতার শিক্ষা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হোক কি গণতন্ত্রের চর্চা—এর আওতায় এখনো আসা বাকি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের, সেই চিন্তা থেকে মোজোলংকার আয়োজক ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইরেক্স শুরু করেছে মোজোলংকা একাডেমির। দূরশিক্ষার মাধ্যমে প্রশিক্ষক ডেভিড হেওয়ার্ড বছর ভরে বিশ্বের যেকোনো মানুষকে শেখাবেন মোবাইল সাংবাদিকতার কৌশল।

https://mojolanka.lk/academy/ লিঙ্কে পাওয়া যাবে সেই শিক্ষা।

  • মাকসুদা আজীজ স্বাধীন সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতা প্রশিক্ষক
    ইমেইল: [email protected]