বিষাক্ত জমিনে সাংবাদিকের বন্ধু, সাংবাদিকের শত্রু

ডেইলি স্টার কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের দেওয়া আগুন নেভাতে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাছবি : প্রথম আলো

সাংবাদিকের কাছে কেউ ‘বন্ধু’ নয়, কেউ ‘শত্রু’ও নয়। কোনো গোষ্ঠীর বিবেচনায় যেটা ‘জাতীয় স্বার্থ’ বা ‘দেশের স্বার্থ’, সেটার প্রতি সাংবাদিকের আনুগত্যের দায় নেই। সাংবাদিকের দায় কেবলমাত্র সত্য আর মানুষের কল্যাণের কাছে। অনেক বছর হলো সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা বিষয়ে পড়াতে আর প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে এই কথাগুলো বলি। এই কথাগুলো বিশ্বাস করি। এই কথাগুলো মেনে সাংবাদিকতা করি, সাংবাদিকতায় বাঁচি, সাংবাদিকতায় শ্বাস নিই।

সত্য জানানো ছাড়া সাংবাদিকের আর কোনো কাজ নেই। সত্যই মানুষের অধিকার আর কল্যাণকে রক্ষা করে, কথা বলা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজটি করতে হলে নিজেকে সব পক্ষ থেকে বিযুক্ত রেখে স্বতন্ত্র অবস্থানে দাঁড়াতে হয়, স্বাধীনতার দাবিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সে জন্যই সাংবাদিক কাউকে ‘বন্ধু’ বা ‘শত্রু’ বিবেচনা করে সাংবাদিকতা করতে পারেন না। সে জন্যই অন্য কারও চশমায় ‘জাতীয় স্বার্থ’ দেখা আর বিচার করা যায় না।

আরও পড়ুন

সত্য আর মানুষের প্রতি সাংবাদিকের এই যে দায়িত্ব, সেটা মিটিয়ে কাজ করা সহজ নয়। সেখানে বিচ্যুতি, হেলাফেলা বা ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। সামান্য একটু বিচ্যুতিতে কারও অন্যায্য ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এই কথাগুলো সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতার একেবারে গোড়ার কথা—সাংবাদিকের ওপর মানুষের আস্থার ভিত্তি, তাঁর শক্তি আর সাহসের শিকড়। কথাগুলো মেনে যে সাংবাদিক কাজ করেন, তাঁর কিন্তু ‘শত্রু’ অনেক এবং তাঁরা অর্বাচীন শক্তিধর।

থেঁতলানো বাঁধাকপি হাতে পেয়ে মেয়ে দুটির আনন্দিত মুখ মনে গেঁথে গেছে। আমাকে বলছে, আমরা সত্য আর মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতার আগুন ছড়িয়ে পড়ুক। কবি শঙ্খ ঘোষ যেমন লিখেছিলেন, ‘আয় আরও হাতে হাত রেখে, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।’

আবার পাশে দাঁড়ানোর মতো ‘বন্ধু’ও থাকেন। সৎ ও নৈতিক বন্ধু অবশ্য নিউটনের আপেলের মতো টুপ করে কোলে এসে পড়েন না, তাঁদের অর্জন করতে হয়। তবে শত্রুর ভয় অথবা বন্ধুর ভরসায় নয়, সাংবাদিককে কাজ করে চলতে হয় তাঁর নীতিনৈতিকতার দায়িত্ব থেকে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে, ১৯ ডিসেম্বরের সূচনাপর্ব থেকে, প্রথম আলোদ্য ডেইলি স্টার-এ পরিকল্পিতভাবে আগুন আর হামলার পরে এই কথাটি নতুন করে মাথায়-মনে গেঁথে নিয়েছি—থামা যাবে না, মাঠ ছাড়া যাবে না।

অসুস্থ ছিলাম, সেই রাতে ওষুধ খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরবেলা উঠে ফোন খুলে প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার আর ছায়ানটে ভয়াবহ তাণ্ডবের ছবি দেখি। বাসায় বসে থাকতে পারি না। কারওয়ান বাজার পৌঁছাই সকাল সাতটার দিকে। প্রথম আলো অফিসের দিকে হাঁটছি। বাঁ দিকে খুব সম্ভব মিল্ক ভিটা অফিসের সামনে দেখি খোলা ট্রাকে উঠে জনা কুড়ি তরুণ ব্যাপক আনন্দের সঙ্গে বিক্ষোভ করছেন। সামনের ইতস্তত জটলার মধ্যে র‍্যাবের কয়েকজন সদস্য পাহারা দিচ্ছেন। ছবি তুলতে সাহস হলো না।

প্রথম আলোর পুড়ে যাওয়া অফিসের দিকে মোড় নেব, পেছনে শুনি কে বলছেন, ‘কী আগুন লাগসে, মসজিদের পানিও নিতেসে।’ রাতে আসা সবজির ট্রাকগুলো ততক্ষণে প্রায় খালি হয়ে গেছে। রাস্তায় জমে যাওয়া পানি মানুষের পায়ে ঘষটানো সবজির রঙে সবুজ, থকথকে কাদা। পুড়ে যাওয়া অফিসের কঙ্কালের সামনে কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো। তাঁরা বললেন, পানিতে পা না দিতে। শুনলাম, একটু আগেই দমকল বাহিনীর দুজন কর্মী বিদ্যুতের শকে গুরুতর আহত হয়েছেন।

এরই মধ্যে দুটি ছোট মেয়ে সামনের বিদ্যুতের খাম্বার নিচে থাকা একটা বাক্সের দিকে যাচ্ছিল। তাদের সরিয়ে দিলেন কেউ একজন। তাকিয়ে দেখি, বাক্সের ওপর একটা থেঁতলানো বাঁধাকপি। লোকটিকে বললাম, কপিটা ওদের দিয়ে দিতে। উড়াধুরা চুল উড়িয়ে ছুটে এসে তারা কপিটা নিয়ে চলে গেল। জীবনকে চলতে হয়।

একটা ‘টেসলা’য় উঠে ডেইলি স্টার-এর সামনে থামি। দুজন ফটোসাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলি। আধপোড়া ভবনটির দিকে তাকিয়ে সেটার ছাদে সাংবাদিক বন্ধুদের সারা রাত শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আটকে থাকার কথা ভাবি।

ব্যাটারিচালিত রিকশা বা টেসলাটি নিয়ে চললাম সাতমসজিদ রোডে ছায়ানট ভবনের দিকে। পথে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর হয়ে যাই। রাতে কিছু বিক্ষোভকারী সেখানকার ভেঙে দেওয়া বাড়িটিতেও হানা দিয়েছিলেন। আমি দেখলাম, কয়েকজন মানুষ বাড়িটি দেখছেন। আগুন দেওয়া হয়েছিল কি না জিজ্ঞাসা করতে একজন নারী ঘুরে তাকিয়ে বললেন, ‘দিলে আপনার কোনো সমস্যা আছে?’

সেদিন বিকেলে আবার প্রথম আলো গিয়েছিলাম শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে দাঁড়াতে। আমাদের পাশে দাঁড়াতে আরও অনেকে এসেছিলেন
ছবি : প্রথম আলো

ছায়ানটের সামনের রাস্তায় পোড়া কাগজের একটা স্তূপ। দরজা খোলা। ভেতরে দু–তিনজন লন্ডভন্ড জিনিসপত্র গোছানোর চেষ্টা করছেন। ভাঙা হারমোনিয়াম, আসবাবপত্র। মানুষজন আসছেন। দ্বাররক্ষী বললেন ভেতরে ঢোকা যাবে না। ফিরে যাব, দেখি প্রতিষ্ঠানটির সহসভাপতি পার্থ তানভীর নভেদ্ দরজায় এসেছেন। কথা বলি। বললেন, বাদ্যযন্ত্রগুলো আর ছয়তলায় থাকা সার্ভারের ওপর আক্রোশের ঝড় গিয়েছে। (সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুনের পর এ কথাটা আবার মনে পড়ল।)

সেদিন বিকেলে আবার প্রথম আলো গিয়েছিলাম শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে দাঁড়াতে। আমাদের পাশে দাঁড়াতে আরও অনেকে এসেছিলেন। তবে সত্যিকারের সাহস আর শক্তি পেলাম যখন সন্ধ্যায় প্রথম আলোর কর্মযজ্ঞ আবার শুরু হলো, যখন রোজকার কাজের মধ্যে সহকর্মীদের দেখলাম।

একই সঙ্গে মনে হলো, সেই রাতের অভিজ্ঞতার পর সাহস আর শক্তি ধরে রাখা কতটা কঠিন হতে পারে। তবে সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা মেনে কাজ করার জন্যই ‘শত্রু’ তৈরি হয়। আবার সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা মেনে কাজ করাই সাহস আর শক্তির খুঁটির জোর।

সব সরকার আর সব রকম ক্ষমতার আক্রমণের শিকার হলে সাংবাদিক ধারণা করতে পারেন, সত্য আর মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনের জায়গায় তিনি হয়তো ভুল করছেন না। ভুল না করাটা অস্তিত্বের প্রশ্ন। জমি এখন বিষাক্ত সবুজ ঘোলানো কাদা। কিন্তু আমাদের তো কাজ থামানোর কোনো সুযোগ নেই।

থেঁতলানো বাঁধাকপি হাতে পেয়ে মেয়ে দুটির আনন্দিত মুখ মনে গেঁথে গেছে। আমাকে বলছে, আমরা সত্য আর মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতার আগুন ছড়িয়ে পড়ুক। কবি শঙ্খ ঘোষ যেমন লিখেছিলেন, ‘আয় আরও হাতে হাত রেখে, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।’

  • কুর্‌রাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা সাংবাদিক

    মতামত লেখকের নিজস্ব