সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনায় দ্বিগুণ হবে দাকোপের অর্থনীতি

উপকূলীয় উপজেলা দাকোপে পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজনফাইল ছবি : প্রথম আলো

খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ। এই অঞ্চল বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বিশেষ মনোযোগের দাবিদার। ইতিমধ্যে দূরদর্শী নানান উদ্যোগে অঞ্চলটির কৃষি ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।

সমুদ্র উপকূলবর্তী এই অঞ্চলের প্রায় দেড় লাখ জনগোষ্ঠীর ৬৬ দশমিক ০৭ শতাংশই কৃষিনির্ভর। তবে সেখানে লবণাক্ততা, পানীয় জলের সংকট এবং অনিয়ন্ত্রিত জোয়ার-ভাটা এখনো অগ্রগতির পথে বড় বাধা। এসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টার পাশাপাশি কৌশলগত ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা দরকার।

দাকোপ উপজেলায় প্রায় ১৮ হাজার ৬৫৭ হেক্টর কৃষিজমিকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে পরিচালিত স্লুইসগেটগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এই গেটগুলোর নির্মাণ ও সংস্কারকাজ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

দুর্ভাগ্যবশত, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে গেটগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে। প্রতিদিন দুইবার জোয়ার-ভাটার সময় লোনাপানির সঙ্গে আসা পলি অভ্যন্তরীণ শাখা নদী ও খাল-বিলগুলো ভরাট করছে, যা পানি ধারণের ক্ষমতা ও নিষ্কাশনব্যবস্থাকে স্থবির করে দিচ্ছে। এই প্রবণতা রোধে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বৈজ্ঞানিক মডেল অনুসরণ করে একটি সুনির্দিষ্ট অপারেটিং–পদ্ধতি (এসওপি) প্রণয়ন করতে পারে।

বর্ষাকাল শেষে পানি মিষ্টি থাকা অবস্থায় স্লুইসগেটগুলো কঠোরভাবে বন্ধ রেখে একদিকে মিঠাপানি সংরক্ষণ, অন্যদিকে পলিবাহিত জোয়ারের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। গেট পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত পানি ব্যবহারকারী দলকে (ডব্লিউইউএ) প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সুযোগ দিয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।

সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় উপকূলীয় কৃষকদের মধে৵ লবণসহিষ্ণু জাতের বীজ সরবরাহ ও আধুনিক কৃষিপদ্ধতি প্রচলনের মাধ্যমে যে সহযোগিতা করছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। দাকোপে তরমুজসহ বিভিন্ন রবিশস্যের বিপুল উৎপাদন এখানকার অর্থনীতির চালিকাশক্তি।

স্লূইসগেটের মাধ্যমে সেচের জল নিশ্চিত হলে প্রায় ১৮ হাজার ৬৫৭ হেক্টর জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা সম্ভব হবে। এই সম্ভাবনার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অফ–সিজন তরমুজ চাষের জন্য উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর মাচাপদ্ধতি এবং পরাগায়ন নিশ্চিতকরণের জন্য মৌমাছি পালনকে প্রণোদনা দিতে পারে। এর ফলে সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনে অন্তত ২৫ তেকে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।

সমন্বিত বিনিয়োগ এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন

এই কৌশলগত ও টেকসই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে অবকাঠামোগত মেরামত, খাল পুনঃখনন এবং প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের জন্য একটি সমন্বিত সরকারি বিনিয়োগের প্রয়োজন। এই বিনিয়োগের সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিটি বাড়িতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের (রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং) ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যা শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট নিরসনে একটি স্থায়ী সমাধান দেবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ হবে উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকীকরণ নিশ্চিত করা, যা কৃষি ও জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় স্থিতিশীলতা দেবে। এই সমন্বিত ও লক্ষ্যভিত্তিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর বার্ষিক আয় দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পাবে। যা কেবল দাকোপের অর্থনৈতিক চিত্রই নয়; বরং সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করলে দাকোপ অচিরেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক নতুন মডেল হিসেবে আবির্ভূত হবে।

সেখ ফরিদ আহমেদ, যুগ্ম সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়

*মতামত লেখকের নিজস্ব