লাদাখের ‘র‍্যাঞ্চো’ যে কারণে পাকিস্তানি চর তকমা পেলেন

গান্ধীবাদে বিশ্বাসী ওয়াংচুক। বারবার অনশন সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে পরিবেশ রক্ষার দাবি জানিয়ে আসছেনরয়টার্স

নয়নের মণি রাতারাতি কীভাবে চোখের বালি হয়ে ওঠেন, বাস্তবের ‘র‍্যাঞ্চো’ সোনম ওয়াংচুক এর নবতম দৃষ্টান্ত। লাদাখের এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও পরিবেশ সচেতক যে আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন, সরকার চাইলে এক বছর তো বটেই, আরও বহুকাল তাঁকে বিনা বিচারে আটকে রাখতে পারে।

এভাবেই পাঁচ বছর ধরে জেলে পচেছেন ভীমা কোরেগাঁও মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। পাঁচ বছর কেটে গেলেও জামিন পাননি ২০২০ সালে দিল্লি দাঙ্গার অভিযুক্তরা। সরকার চাইলে এভাবেই বছরের পর বছর সোনম ওয়াংচুককে কারাগারের অন্তরালে রেখে দিতে পারে। কারণ, সরকারি বয়ানে তিনি ‘পাকিস্তানি চর’!

যে মানুষটি দেশের সেনাদের জন্য দুর্গম তুষারাচ্ছাদিত অঞ্চলে বসবাসের উপযোগী বাসস্থান গড়ে তুলেছেন, যেখানে শরীর উষ্ণ রাখতে বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন নেই, সেই মানুষটিকে সরকার অবলীলায় ‘পাকিস্তানি চর’ বলে দাগিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করল না! লাদাখের পানি সমস্যার সুরাহায় যিনি বরফের স্তূপ তৈরি করে বিপ্লব ঘটিয়েছেন, গ্রীষ্মকালে যা দিয়ে সেচ সম্ভব, সেই মানুষটি রাতারাতি জাতির পক্ষে ‘অনিরাপদ ও বিপজ্জনক’ হয়ে গেলেন! শুধু লাদাখ নয়, গোটা দেশ বিস্মিত!

পুলিশের বড় কর্তা সোনমের পাকিস্তান যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ ও নেপাল-যোগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, ওই দুই দেশের ‘জেন–জি’ বিক্ষোভ তিনি লাদাখেও আমদানি করতে চাইছেন। ২৪ সেপ্টেম্বরের হিংসা তাঁরই প্ররোচনায়। তিনিই লাদাখে ‘আরব বসন্ত’ ঘটাতে চাইছেন। কোনো দিন যিনি হিংসার কথা বলেননি, হিংসাত্মক ঘটনার নিন্দা করে অনশন প্রত্যাহার করেছেন, তিনিই হয়ে উঠলেন খলনায়ক! অথচ হিংসার চক্রান্ত কারা করল, সেই তদন্তের ধার কাছ দিয়েও সরকার হাঁটল না!

এটা ঠিক, গত ফেব্রুয়ারিতে সোনম সস্ত্রীক ইসলামাবাদ গিয়েছিলেন এক আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে। জাতিসংঘের সহযোগিতায় পাকিস্তানের ডন পত্রিকা গোষ্ঠী ছিল সম্মেলনের আয়োজক। যদিও সেখানে তিনিই একমাত্র ভারতীয় ছিলেন না। লাদাখের পুলিশপ্রধান এসডি সিং জামওয়াল পাকিস্তানি সংযোগের প্রমাণ হিসেবে এক পাকিস্তানি ‘গুপ্তচরকে’ গ্রেপ্তার করার কথাও জানিয়েছেন। ওয়াংচুকের বাংলাদেশ ভ্রমণেরও উল্লেখ করেছেন। যদিও বিস্তারে কিছু জানাননি। সরকার স্পষ্ট বোঝাতে চাইছে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালের ভারতবিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে তিনি জড়িত; অতীতেও তিনি গৃহযুদ্ধ লাগানোর ঘটনায় উৎসাহ দিয়েছেন; এবারও অশান্তিতে উসকানি তাঁরই।

প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের এ সিদ্ধান্ত হারাকিরির শামিল কি না তা নিয়ে। সব রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যেই এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে। বিজেপির লাদাখি নেতৃত্বও সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আপামর লাদাখ উদ্বেলিত, তাঁর বদনাম ও গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে জনতার মন জেতা যায় না। ভুল সিদ্ধান্তের দরুন শান্ত মণিপুর আজও অশান্ত। ভুল পদক্ষেপ লাদাখকেও পাকাপাকি বিরূপ করে তুললে দেশের নিরাপত্তার পক্ষে তা বিপজ্জনক হবে।

ওয়াংচুককে গ্রেপ্তার করার পরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর নর্দান কমান্ডের জিওসি ইন সি লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রতীক শর্মা এবং জিওসি ইন সি ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি কোরের লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিতেশ ভাল্লা দেখা করেন উপরাজ্যপাল কবিন্দ্র গুপ্তর সঙ্গে। উপরাজ্যপাল তাঁদের ডাকেননি। সেনাপ্রধানেরা গিয়েছিলেন নিজেদের গরজে। বিপদ বোঝাতে কি?

লাদাখি জনজীবন শান্ত থাকা প্রয়োজন সেনা স্বার্থেই। ১৯৯৯ সালে কারগিলে পাকিস্তানি সেনাদের অনুপ্রবেশের খবর ভারতীয় সেনাদের দিয়েছিলেন স্থানীয় মেষপালকেরা। একইভাবে ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখের গলওয়ানের বিস্তীর্ণ এলাকাও যে চীনা সৈন্যরা দখল করেছে, লাদাখি মেষপালকেরা সেই খবরও এনেছিলেন। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া সেনার সফল হওয়া কঠিন। সোনম ওয়াংচুককে এভাবে অপবাদ দিয়ে গ্রেপ্তার আপামর লাদাখিকে ক্ষুব্ধ করেছে। এর পরিণতি শুভ হতে পারে না বলে ইতিমধ্যেই সব দল সরকারকে সতর্ক করেছে। কিন্তু সরকারের অতীত আচরণ বোঝাচ্ছে, ওয়াংচুককে দ্রুত মুক্তি দেওয়া হবে বলে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

অথচ এই মানুষটিই ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষ নিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের দ্বিখণ্ডিতকরণকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ওই দিন তাঁরা নিজেদের ‘মুক্ত’ মনে করেছিলেন। লাদাখকে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণার যে দাবি তাঁরা বহুদিন ধরে জানিয়ে আসছিলেন, তা বাস্তবায়িত হওয়ায় উল্লাস করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর বন্দনা করেছিলেন।

লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত করার স্বপ্ন দেখা শুরু তখন থেকেই। ২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনের প্রচারেও বিজেপি সে কথা শুনিয়েছিল। স্থানীয় নেতারা ভেবেছিলেন, ৩৭০ অনুচ্ছেদের জন্য যা সম্ভব হচ্ছিল না, এবার তা হয়ে যাবে। ষষ্ঠ তফসিলে গেলে লাদাখের ধূসর রুক্ষ শীতল মরু অঞ্চল এবং সেখানকার জনজাতির স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হবে। জমি, সম্পদ ও সংস্কৃতির ওপর লাদাখিরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারবেন। অথচ ঘটনা হলো পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্র সেই অধিকার লাদাখকে দেয়নি। দেবেও কি না সন্দেহ। কারণ, অনশনরত ওয়াংচুক জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী লিখিত প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি তা হতে দেবেন না।

বস্তুত, ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত করা নিয়ে লাদাখি বৌদ্ধ ও শিয়া মুসলমানদের কমিটির সঙ্গে কেন্দ্রের বৈঠকই সার। এখনো সরকার এ বিষয়ে নির্দিষ্ট রূপরেখা আন্দোলনরত নেতাদের পেশ করেনি। আশাও দেয়নি। কেন তা করা হচ্ছে না, প্রশ্ন সেটাই। সোনম ওয়াংচুকই সেই বিপদ সম্পর্কে লাদাখি জনতাকে সতর্ক করে দিয়েছেন।

লাদাখে নবায়নযোগ্য সৌরশক্তি ও জিও থার্মাল বা ভূত্বকের অভ্যন্তরে উৎপন্ন এবং সঞ্চিত তাপশক্তির বাণিজ্যকরণে বৃহৎ শিল্পপতিরা মুখিয়ে রয়েছেন। বিরল খনিজ সম্পদেও লাদাখ সমৃদ্ধ। সরকার-ঘনিষ্ঠ শিল্পোদ্যোক্তাদের লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে লাদাখের খনিজ সম্পদের ওপর। এই সম্পদের ব্যবহারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাদাখের পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নটি। সোনম ওয়াংচুক ছয় বছর ধরে এই বিপদের প্রতিই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

গান্ধীবাদে বিশ্বাসী ওয়াংচুক। বারবার অনশন সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে পরিবেশ রক্ষার দাবি জানানোর পাশাপাশি হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখন্ডের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত হলে উন্নয়নসংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে তাঁদেরই হাতে। না হলে বিপর্যয় অবধারিত। তিন লাখ জনসমষ্টির লাদাখে ফি বছর পর্যটক আসেন পাঁচ লাখের বেশি। পরিবেশের প্রতি যাঁদের অধিকাংশ যত্নবান নন। ব্যাপক হারে শিল্পের বিকাশ হলে লাদাখ হয়ে দাঁড়াবে দেশের সর্বনাশের কারণ। লাদাখিদেরই তা রুখতে হবে।

সোনম ওয়াংচুক এভাবে ক্রমেই হয়ে উঠেছেন দল–মত ও অঞ্চলনির্বিশেষে সমগ্র লাদাখের মুখ ও স্বর। শিয়াপ্রধান কারগিল ও বৌদ্ধপ্রধান লাদাখের রাজনী লেহ্ দৃঢ়ভাবে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। ঘুচে গেছে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভেদ। বিজেপি, কংগ্রেস, ন্যাশনাল কনফারেন্সসহ সব প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক হয়ে গেছেন অপ্রাসঙ্গিক। সবাইকে টপকে ২০২৪ সালে লোকসভায় জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মহম্মদ হানিফা। কেন্দ্রশাসিত লাদাখে যে কর্তৃত্ব দিল্লি এখনো দেখাতে পারছে, পৃথক রাজ্য ও ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত হলে সেই দাপট মিইয়ে যাবে। মোদি-শাহর বিজেপি কেন তা ছেড়ে দেবে?

সোনম ওয়াংচুকের গ্রেপ্তার দেশের সবচেয়ে শান্ত সীমান্ত অঞ্চলকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিল। লাদাখ দ্বিতীয় মণিপুর হয়ে উঠলে দেশের পক্ষে তা হবে নিতান্তই দুর্ভাগ্য।

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি

  • মতামত লেখকের নিজস্ব