প্রতিবন্ধী মানুষটার দিকে তাকান, তার প্রতিবন্ধিতার দিকে নয়

আজ ৩ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে, ৩১তম প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস এবং ২৪তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস।

দিনটি কী নামে পালিত হয়? ‘প্রতিবন্ধী দিবস’ নাকি ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দিবস’? প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে কখনো ‘প্রতিবন্ধী’ বা ‘অক্ষম’ বলবেন না। বলুন ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা হলো বিশ্বের বৃহত্তম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং এই জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশে বসবাস করে। অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, বর্তমান পৃথিবীতে এক বিলিয়নের বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ এবং এর মধ্যে ৭৮৫ মিলিয়নের বয়স ১৫-৫৯ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ তারা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশ।

সর্বশেষ জনশুমারি অনুসারে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, অর্থাৎ প্রতি দশ জনে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ মোট ১২টি প্রতিবন্ধিতা চিহ্নিত করেছে: ১. অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার, ২. শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, ৩. মানসিক অসুস্থতাজনিত  প্রতিবন্ধিতা, ৪. দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, ৫. বাক্প্রতিবন্ধিতা, ৬. বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, ৭. শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, ৮. সেরিব্রাল পালসি, ৯. ডাউন সিনড্রোম, ১০. শ্রবণ-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, ১১. বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা ১২. অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা।
প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে আমরা হয়তো সাধারণভাবে কিছু কিছু জিনিস জানি না বা জানলেও প্রয়োগে সতর্ক হই না, সেগুলোর কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। যেমন ধরুন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সাহায্য করতে চাইলে তাকে জিজ্ঞাসা করে সাহায্য করতে হবে। কারণ তার প্রয়োজনটা সে–ই জানাতে পারবে সঠিকভাবে, অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি তা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারবে না।

একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে হলে প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলুন এবং তাকে ডাকতে হলে বা সম্বোধন করতে হলে প্রথমেই তার নামটি জেনে নিয়ে তার সঙ্গ কথা বলুন বা ডাকুন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে রাস্তা পার করে দিতে চাইলে তাকে আপনার কনুই ধরতে দিন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি যেখানে অবস্থান করবেন, সেখানে দরজা খোলা রাখুন, দরজা অর্ধেক খোলা রাখবেন না এবং আকস্মিকভাবে তার হাত ধরবেন না।

হুইলচেয়ারে বসা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে হলে পারলে একটু ঝুঁকে তার সমাবস্থায় গিয়ে কথা বলুন। আবার ধরুন, হুইলচেয়ারে বসা কোনো ব্যক্তিকে আপনি সহায়তা করতে চান, কিন্তু কখনোই তার অনুমতি ছাড়া হুইলচেয়ার ধরবেন না।
শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সময় তার সামনে বসুন, পেছনে বসে কথা বলবেন না এবং খেয়াল করুন যে আপনার ঠোঁটের নাড়াচাড়া উনি খেয়াল করতে পারছেন কি না। প্রয়োজনে, কাগজ-কলম ব্যবহার করুন। মনে রাখবেন, শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সাধারণত অন্ধকারে যেতে ভয় পায়, ঘরে পর্যাপ্ত আলো জ্বালিয়ে রাখুন। শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে রাতে কোথাও যেতে হলে সঙ্গে টর্চ রাখুন।  

মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কথা শোনার জন্য সময় নিন, মনোযোগসহকারে শুনুন এবং ধরে নেবেন না যে তাঁর কোনো জ্ঞান বা মতামত নেই। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ভয় পাবেন না। মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী একজনের কাছ থেকে আপনার বাচ্চাকে সরিয়ে নেবেন না, এতে করে তাঁকে আঘাত করা হবে।
প্রতিবন্ধী শিশুর পিতা–মাতাকে করুণা দেখাবেন না। কেননা প্রত্যেক শিশু তার মা–বাবার কাছে মূল্যবান। প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে সাধারণ অন্য দশটা শিশুর মতোই আচরণ করুন। কোনো ব্যক্তির প্রতিবন্ধিতা নিয়ে তাকে কটূক্তি বা তাকে অবহেলা করবেন না। আমরা না বুঝেই অনেক সময় হুইলচেয়ারে বসা মানুষটার সঙ্গে মেপে মেপে কম গুরুত্ব দিয়ে কথা বলি, শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিটির সঙ্গে অনাবশ্যকভাবে জোরে কথা বলি, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিটির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন না করে পাশের জনের মাধ্যমে কথা বলতে চাই, এর কোনোটাই কাম্য হতে পারে না।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের (২০১৩) আলোকে প্রণীত বিধিমালা এবং জাতীয় কর্মপরিকল্পনার আওতায় গঠিত উপজেলা, জেলা ও জাতীয় সমন্বয় কমিটিগুলো কার্যকর থাকুক প্রশ্নাতীতভাবে। সরকারি–বেসরকারি, সুশীল সমাজ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনসমূহের সমন্বিত ও উদ্যোগ ভালো উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হোক। সরকারের আসছে শিক্ষানীতিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একীভূত শিক্ষার কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখিত হোক। আমরা জানি যে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে সব চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ১ শতাংশ কোটা বরাদ্দ আছে। সরকারের সহযোগিতা সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির হাতে পৌঁছে যাক। আমারদের অবকাঠামো প্রতিবন্ধীবান্ধব হোক। আমরা যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য আরও প্রশিক্ষণ ও কাজের জায়গা ও পরিবেশ তৈরি করতে পারি।

আরও পড়ুন

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ অনুসারে, প্রতিবন্ধিতা অর্থ যেকোনো কারণে ঘটিত দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ীভাবে কোনো ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত বা ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা বা প্রতিকূলতা যা উক্ত ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত ও পরিবেশগত বাধার পারস্পরিক প্রভাব তৈরি করে এবং যে কারণে উক্ত ব্যক্তি সমতার ভিত্তিতে সমাজে পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণে বাধাগ্রস্ত  হতে পারে। সুতরাং, আসুন শুধু মনে রাখি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আসলে প্রতিবন্ধী নয়, তারা মানুষ।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এবারের আন্তর্জাতিক দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনমুখী পদক্ষেপ: প্রবেশগম্য ও সমতাভিত্তিক বিশ্ব বিনির্মাণে উদ্ভাবনের ভূমিকা।’

একবিংশ শতাব্দীতে উন্নয়নের সংজ্ঞাকে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের’ পরিমাপে যাচাই করা হয়। যে উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি নেই, সে উন্নয়ন একবিংশ শতাব্দীতে অচল। বাংলাদেশের সব সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত আছে। তা ছাড়া সকারের সামাজিক নিরাপত্তাসেবার আওতায় প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাসেবার ‘সুবর্ণ কার্ড’ সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যেন পেতে পারে, সে জন্য সহযোগিতার হাত বাড়ান। ‘অন্তর্ভুক্তি’ হোক সব উন্নয়ন-আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের উন্নয়ন ভাবনা যেমন নারীর জন্য, শিশুর জন্য, কিশোর–কিশোরীদের জন্য, প্রবীণদের জন্য, তেমনি হোক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য।

আপনার সামনে বসা প্রতিবন্ধী মানুষটার দিকে তাকান, তার প্রতিবন্ধিতার দিকে নয়। কারণ, তার প্রতিবন্ধিতার দিকে তাকালে আপনি কখনোই ওই মানুষটাকে দেখতে পাবেন না। আসুন মনে রাখি, আমরা সবাই আসলে সাময়িক অপ্রতিবন্ধী, যেকোনো সময় আমরা যে কেউ যেকোনো রকম প্রতিবন্ধিতার শিকার হতে পারি।

  • মাসুমা বিল্লাহ প্রোগ্রাম হেড, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি, ব্র্যাক