বন্ধু হও, শত্রু হও

‘নববর্ষ ১৪৩০ আমাদের সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা দিক। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাব।’

জোড়াসাঁকোয় বসে রবীন্দ্রনাথ ১৩০১ সালের পয়লা বৈশাখে লিখেছিলেন ‘নববর্ষে’ কবিতাটা। তাতে তিনি লিখেছিলেন:
‘নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন
বর্ষ হয় গত!
আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন
করিলাম নত।
বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও,
ক্ষমা করো আজিকার মতো
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নববর্ষে বন্ধুর কাছে হাত বাড়িয়েছেন, শত্রুর কাছেও হাত বাড়িয়েছেন, বলেছেন, পুরোনো বছর চলে গেছে, পুরোনো অপরাধ যত আছে, আজকের নতুন দিনে তা ক্ষমা করে দাও। রবীন্দ্রনাথের কবিতাটা রচিত হওয়ার ১২৯ বছর পরে একই কথা নতুন করে নিজের অন্তরে ধারণ করার চেষ্টা করি, বন্ধুজন এবং শত্রুজনকে ডেকে ডেকে বলি:
করো সুখী, থাকো সুখে প্রীতিভরে হাসিমুখে
পুষ্পগুচ্ছ যেন এক গাছে—
তা যদি না পার চিরদিন,
একদিন এসো তবু কাছে।

একই গাছের ফুলের মতো আমরা সুন্দরভাবে পাশাপাশি থাকব। বন্ধু এবং শত্রু। চিরদিন যদি কাছে নাও থাকি, এক দিনের জন্যও যেন পাশে যাই, কাছে টেনে নিই। এই কবিতার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। আমাদের সেটা মনে পড়বেই নববর্ষের সকালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৭ সালে লিখেছেন:

‘আজ বাংলা বর্ষ, ১৫ এপ্রিল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি নুরে আলম সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম আরও কয়েকজন রাজবন্দী কয়েকটা ফুল নিয়ে ২০ সেল ছেড়ে আমার দেওয়ানিতে হাজির। আমাকে সব কয়েকটা গোলাপ ফুল দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাল।... জেলের ভেতরে ছোট ছোট জেল, কারও সাথে কারও দেখা হয় না—বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দীদের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। বিকেলে পুরোনো সেলের সামনে নুরে আলম সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম ও হানিফ খান কম্বল বিছাইয়া এক জলসার বন্দোবস্ত করেছে। বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার, শুধাংশু বিমল দত্ত, শাহ মোয়াজ্জেমসহ আরও কয়েকজন ডিপিআর ও কয়েদি, বন্দী জমা হয়ে বসেছে। আমাকে যেতেই হবে সেখানে, আমার যাওয়ার হুকুম নাই, তবু আইন ভঙ্গ করে কিছু সময়ের জন্য বসলাম। কয়েকটা গান হলো, একজন সাধারণ কয়েদিও কয়েকটা গান করল। চমৎকার গাইল।...আমি কারাগার থেকে দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।

‘১০ সেল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী আমাকে শুভেচ্ছা জানাইয়া এক টুকরা কাগজে নিম্নলিখিত কবিতাটি লিখে পাঠায়,
আজিকে নতুন প্রভাতে নতুন বরষের আগমনে
মুজিব ভাইকে—
বন্ধু হও শত্রু হও যেখানে যে কেহ রও
ক্ষমা করো আজিকার মত
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত।’

২.

গতকালের (১৩ এপ্রিল ২০২৩) প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় সুখবর আছে। দেশে দারিদ্র্য কমেছে। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালে দারিদ্র্য ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, দেশে এখন অতিদারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬। ছয় বছর আগে যা ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। আমরা যদি আরেকটু চেষ্টা করি, আর ৬ বছর পরে কি আমাদের দেশের অতিদরিদ্র শূন্যের কোঠায় আনতে পারব না?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এ জরিপে আরেকটা তথ্য আছে তা হলো, বৈষম্য বাড়ছে। ‘২০২২ সাল শেষে গিনি সহগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯৯ পয়েন্ট। ২০১৬ সালে গিনি সহগ ছিল দশমিক ৪৮২ পয়েন্ট। সাধারণত দশমিক ৫০০ হলেই একটি দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেদিক থেকে অতি সামান্য দূরে আছে বাংলাদেশ।’

কোভিডের মতো বড় আঘাত এবং ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও যে আমাদের দারিদ্র্য কমছে, এটা আমাদের একটা অনেক বড় অর্জন। এই অর্জনের কৃতিত্ব আমাদের উদ্‌যাপন করতে হবে। সরকারসহ দেশের ১৭ কোটি মানুষকে কৃতিত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি বৈষম্য কমানোর উদ্যোগও নিতে হবে। দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা কমছে, কিন্তু এখনো তা ১৮ ভাগ, মানে প্রতি পাঁচজন মানুষের একজন গরিব। তিন কোটিরও বেশি মানুষ গরিব। তিন কোটি মানুষকে গরিব রেখে আমরা আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে পারি না, আবার দারিদ্র্য কমার হার অব্যাহত রাখার জন্য আমরা আত্মবিশ্বাস নিশ্চয়ই ধরে রাখব।

আজ পয়লা বৈশাখে বঙ্গবন্ধুর কতগুলো কথা আপনাআপনিই স্মরণে আসে। তিনি বলেছেন: ‘বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না।’ বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে তো কিছুই নাই। এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা শুরু করেছে। পাকিস্তানকে শাসকগোষ্ঠী কোন পথে নিয়ে চলেছে, ভাবতেও ভয় হয়। আজ দলমত-নির্বিশেষে সকলের এই জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত।’(৩০ জুন ১৯৬৬) ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীতে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি কী চাই? আমি চাই, আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসেখেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক।’

গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না, দেশের সব মানুষের কাছে যায় না, উন্নয়ন অর্থবহ হয় না, এই নিয়ে অমর্ত্য সেন বইয়ের পরে বই লিখে চলেছেন। তিনি বলছেন, যে দেশে গণতন্ত্র আছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না। ২০০৪ সালে প্রথম আলোয় মতিউর রহমানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘অনেক সময় লোকে প্রশ্ন করেন, গণতন্ত্রের ফলে উন্নয়ন হবে কি হবে না। প্রথমেই মানতে হবে, গণতন্ত্র উন্নয়নের একটা অংশ। যেমন ডিম সেদ্ধ করতে হলে জল ফোটানো দরকার। এই না যে ফোটানো জলটা আমরা খাব। বরং তা দিয়ে ডিমটা সেদ্ধ হবে। কিন্তু গণতন্ত্র জিনিসটা তো ঠিক গরম জলের ব্যাপার না। গণতন্ত্র অবশ্যই উন্নয়নের একটা অংশ। আপনি খুব ধনী হলেন, কিন্তু কথা বলার স্বাধীনতা পেলেন না। এমনকি সেই সব দেশে সাধারণ মানুষ তাদের মতামত প্রকাশ করলে তাদের জেলে দেওয়া হয়, সেই সব দেশ উন্নত দেশ—এ রকম কথা বলতে পারা যায় না।’

নববর্ষ ১৪৩০ আমাদের সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা দিক। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাব। উন্নয়ন হচ্ছে, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে, এই উন্নয়ন হতে হবে সবার জন্য। শুধু তাদের জন্য নয়, যারা সোনায় মোড়ানো জিলাপি খাবে। আর উন্নয়নকে টেকসই করতে হবে গণতন্ত্রকে মজবুত করে, বাক্‌স্বাধীনতা, মানবাধিকার নিশ্চিত করে। বৈষম্য কমাতে হবে। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বুড়িমার কথা বলেছিলেন, যিনি বঙ্গবন্ধুকে দুধ খাইয়েছিলেন, কটা খুচরা পয়সা দিয়েছিলেন, তাঁর কথা স্মরণে রেখে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, “মানুষরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।”’
মানুষকে আমরা যেন ধোঁকা না দিই।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক