রেইনি ঢাকা: এই মনোটনাস শহরে বৃষ্টিমুখর ঈদ

বৃষ্টিমুখর ঈদের সকাল। রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন এলাকা

ভোর না হতেই মেঘের দামামা। তুমুল বৃষ্টি। সূর্য ওঠার কালে অন্ধকার হয়ে আসে পৃথিবী। আর কী বিদ্যুৎ চমকানিতে চমকে যায় পিলে! আহা, প্রচণ্ড দাবদাহের সময় এমন বৃষ্টির জন্যই ছিল কত প্রতীক্ষা। বর্ষা তো আগেই শুরু হয়েছে, বৃষ্টিও। তবে আজকের বৃষ্টি অন্য রকম। কারণ, আজ ঈদের দিন। ঈদুল আজহা। আমরা যাকে কথায় কথায় ‘বড় ঈদ’ বলি। ফলে বজ্রপাতের গুড়ুম গুড়ুম শব্দকে মনে হলো যেন কামানের গোলা। ঈদের আগমনে একসময় রাজা-বাদশাহরা কামান দাগিয়ে উদ্‌যাপন করতেন। তেমনটিই যেন মনে হলো।

ঈদের দিন যেহেতু, বিছানায় শুয়ে থাকার সুযোগ নেই। ঈদের জামাতে তো যেতেই হবে। ছোটবেলায় ঈদের সকাল মানে মায়ের নানা ব্যস্ততা। হাঁক–ডাক দিয়ে আমাদের ডেকে তোলা। তারপর গোসল সেরে, পাঞ্জাবি পরে, আতর মেখে ঈদগাহের জন্য প্রস্তুত হওয়া। ঈদগাহে যাওয়ার আগে মিষ্টান্ন মুখে দেওয়া নাকি রেওয়াজ, আমাদের প্রিয় নবীজি সেটা করতেন। আম্মা সেমাই বা খেজুর মুখে তুলে দিতেন আমাদের।

খাঁ খাঁ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। রাজু ভাস্কর্য।

পরিবারের সেই ঈদ মিস করছি এবার। অফিসের কাজে ঢাকায়ই থাকতে হলো। মেস বাসায় আরও একজন এবার ছুটি পাননি। তিনি পুলিশ কর্মকর্তা। ঈদের দিন পুলিশ, চিকিৎসক, নার্স, সাংবাদিক, এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মীসহ আরও কত মানুষ এভাবে ঈদ করেন! তাঁদের সেই বেদনাময় ঈদের স্পর্শ পেলাম আমিও। আগেও কয়েকবার ঢাকাতে একাকী ঈদ কাটাতে হয়েছিল। প্রথম প্রথম একটু বেশি খারাপ লাগত, সেটি এখন কমে এসেছে বলা যায়।

ঘর থেকে, পরিবার থেকে দূরে থাকলেও, কিছুটা বিষাদময়তা কাজ করলেও, ঈদ বলে কথা—মনে আনন্দ ভর করবেই। কিন্তু বৃষ্টিতে বাধল বিপত্তি। চিলেকোঠার বাসায় বৃষ্টি দেখতেও দারুণ লাগছিল। মনে মনে আউড়ে যাচ্ছিলাম, ‘নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে/তিল ঠাঁই আর নাহি রে।/ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’।

কিন্তু আমার যে ঘরের বাইরে যেতেই হবে। ঈদগাহে না গেলে যে ঈদের আনন্দ পুরো হয় না।

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পশু কোরবানি। রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন এলাকা

এই ইহজীবনটা ছাতাহীনই কেটে গেল। কারও ছাতা নিয়ে বের হয়ে কতবার যে হারিয়ে ফেলেছি, ফলে নিজের ছাতার ওপর ভরসা করতে পারি না। ভিজে ভিজে ঘর থেকে বের হওয়া বা ঘরে ফেরা—আজীবন এভাবেই বর্ষাকাল বা বৃষ্টির মৌসুম পার করে দিয়েছি। তবু কী মনে করে যেন গতকাল একটা পুরোনো ভাঙা ছাতা সারালাম, তাও এক সাবেক রুমমেটের ফেলে যাওয়া। সেটিই দেখি আজ কাজে লাগল।

এলাকার মসজিদে ঈদের জামাত শেষ। ভবনের নিচে ও গলিতে অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মানুষ পশু কোরবানি দিচ্ছেন। বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে শিশুরাও নেমে এসেছে ছাতা হাতে। সবাই ভিজে টইটম্বুর। নারীরা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিমুখর কোরবানির অন্য রকম এক দৃশ্য। প্রায় গোট দেশেই আজ বৃষ্টি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সেই পূর্বাভাস আগেই দিয়ে রেখেছে। তাদের সেই পূর্বাভাসও ঠিকঠাক ফলে গেল, সেটি অবশ্যই অবাক করা ব্যাপার বলতে হবে।

রাস্তাঘাট সুনসান। একে তো বৃষ্টি, সঙ্গে ঈদের দিন। ঢাকা শহর তখন ফাঁকা, গড়ের মাঠ। ভাগ্যিস একটা সিএনজি অটোরিকশা হাজির হলো দেবদূতের মতো। ততক্ষণে ছাতা মাথায় দিয়েও বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ হলো না। চারিদিক থেকে বৃষ্টির ছাঁটের হামলায় পুরোপুরি পরাস্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে ঈদের দ্বিতীয় জামাত পাওয়া গেল। মুসল্লিরা ভিজতে ভিজতে আসছেন। আগের জামাতের মুসল্লিরা ভিজতে ভিজতে ঘরে ফিরছেন। স্বাভাবিকভাবেই মুসল্লির সংখ্যা কম মনে হলো। এমন বৃষ্টিতে আসলে ঘর থেকে বের হওয়াই দায়। বিশেষ করে বাচ্চাকাচ্চা, অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য।

একদিকে ভেতরে খতিবের বয়ান চলছিল। অন্যদিকে বাইরে বৃষ্টি। ঈদের জামাত শেষ হয়ে, খুতবাও শেষ। বৃষ্টি তবু শেষ হয় না, যেন গতি আরও বাড়ে। অনেকে ভিজতে ভিজতে, ছাতা মাথায় বা মোটরগাড়িতে করে বেরিয়ে গেল। অনেকেই অপেক্ষায় থাকলেন বৃষ্টি শেষ হওয়ার।

যারা দ্রুত চলে গেলেন, বোঝাই যাচ্ছে, কোরবানির পালা শেষ করতে হবে। তবে যা বৃষ্টি, মনে হচ্ছে না, আজকে ঢাকা শহরের সবাই পশু কোরবানি দিতে পারবে। না পারলেও আরও দুই দিন তো আছেই। এই বৃষ্টিতে অনেক জায়গায় জলাবদ্ধতা তৈরি হবে। পশু কোরবানির রক্ত ও বর্জ্যে একটি করুণ দৃশ্য তৈরি হবে। এ নিয়ে পক্ষ–বিপক্ষে তর্ক–বিতর্ক চলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর জন্য যে মূলত দায়, শহরের পানি নিষ্কাশন অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পিত নগরায়ন, সেই আলোচনা ঢাকা পড়ে যাবে।

ঈদের জামাত শেষে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরছে মুসল্লিরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ।

মসজিদে বসে আছি। বৃষ্টির গতি কমে আসার অপেক্ষায়। ছোটবেলা থেকেই ঈদের জামাত শেষে একটি দৃশ্য দেখে আসছি—সবাই কবরস্থানে গিয়ে ময়মুরব্বি ও স্বজন-পরিবারের মরহুম সদস্যদের কবর জিয়ারত করতেন। গ্রামে পারিবারিক কবরস্থান তিন দিকে পাহাড়ঘেরা এক ধানখেতের মাঝখানে ছোট টিলার ওপরে। গ্রামের ঈদ মানেই এক থেকে দেড় কিলোমিটার হেঁটে কবরস্থানে চলে যাওয়া।

ঈদে না থাকা স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। সেই স্মৃতি মনে উঠতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবর জিয়ারতের জন্য দাঁড়ালাম। মসজিদের করিডর থেকেই দেখা যায় কবির কবর। ‘মসজিদের পাশে আমার কবর দিয়ো ভাই’—কবির লেখা গজলের সেই আকুতিই তাঁর জীবনে সত্য হলো। আর রোজার ঈদ মানেই তো তাঁর লেখা— ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে, এল খুশির ঈদ।’ ঈদের দিন মানেই তো এই গান গাওয়া। এই গান গেয়ে গেয়ে আমাদের বড় হওয়া, অনেকের বুড়োও হওয়া। রোজার ঈদ না হোক, কোরবানির ঈদে সেই কবির কবর জিয়ারত করছি ভেবেই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হলো।

জাতীয় কাজী নজরুল ইসলামের কবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের করিডর থেকে

মসজিদ থেকে বের হতে হতে বৃষ্টি তখন গুঁড়ি গুঁড়ি। বাইরে দুই বেলুন বিক্রেতা দাঁড়িয়ে আছেন দেখলাম। তাঁদের একজনের সঙ্গে কথা বললাম। নাম মো. আলমগীর। বাড়ি চাঁদপুর। ‘বিক্রি কেমন হলো?’ ‘এক টাকাও না।’ কারণ, বৃষ্টির দিনে বাবা-চাচা-ভাইদের সঙ্গে তেমন বাচ্চাকাচ্চারা ঈদের জামাতে আসেনি। ‘অন্য বছর কেমন বিক্রি হতো?’ ‘অন্তত ১৫০০ টাকা।’ আহা রে, বেচারার জন্য খারাপই লাগল। আলমগীরদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দিকেই পা বাড়ালাম। রাজু ভাস্কর্যকে ঘিরে যে টিএসসি অন্যদিন গমগম থাকে, ঈদের দিন সেখানে অদ্ভুত নীরবতা। যেন এই নীরবতাই

একটাই টং দোকান খোলা হয়েছে। মধু দোকান। মধুর সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। বৃষ্টি তো পড়ছেই। তবে গতি কমে গেছে। ছাতা মাথায় না রাখলেও হচ্ছে। ভিজতে ভালোই লাগছে। ফুলবিক্রেতা মেয়েরা বেকার বসে। বিকেলে হয়তো একটু ভিড়ভাট্টা হতে পারে। বিশেষ করে পুরান ঢাকার মানুষেরা ঈদের বিকেলে ক্যাম্পাসের এদিকে ঘুরতে আসে। ঘোড়ার গাড়িও চলে। আরেক ঈদে দেখার সুযোগ হয়েছিল।

টিএসসি, শাহবাগ রোড, উদ্যানের গেট। মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে।

পেটে তো কিছু দেওয়া লাগেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে ঢুকেই আরও কয়েকটা টং দোকান খোলা পেলাম। কলা-রুটি ঝুলছে। আরও অনেকে এসে ভিড় করলেন। পাশে একজন সালাম দিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বললাম।

নূর মোহাম্মদ। একজন পঙ্গু ভিক্ষুক। বাড়ি বাগেরহাট রামপাল থানায়। একসময় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। সাত বছর হলো স্ট্রোক করে এক হাত-এক পা অবশ হয়ে গেছে তাঁর। পনেরো দিন ঢাকায় ভিক্ষা করেন, বাকি পনেরো দিন গ্রামে থাকেন। পনেরো দিনের ভিক্ষার আয়েই চলে যায় বড় সংসার। ঘরে মা, বাবা, বউ, কয়েক ছেলে-মেয়ে। দুই মেয়েকে বিয়েও দিয়েছেন। কালই বাড়িতে যাবেন। বর্ষায় তেমন আয়-রোজগার নেই। হাসতে হাসতেই বললেন তিনি। সারাক্ষণ মুখে হাসি। দেখেই যেন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। যে কেউ দেখেই বুঝে যাবে, এ হাসিই আসলে এমন মানুষের মনোবল। সকালের চায়ে নূর মোহাম্মদকেই সঙ্গী করলাম।

এবার অফিসে ঢোকার পর্ব। শাহবাগের দিকে হাঁটা। বৃষ্টি একটু কমে কি বাড়ে বা বাড়ে কি কমে। কত রকমের যে বৃষ্টি দেখা হলো আজ। বৃষ্টির প্রকারভেদ নিয়ে লম্বা একটা প্রশ্নোত্তরও লেখা হয়ে যাবে। রাস্তায় কোথাও কেউ নেই। দুই–একটি গাড়ি বা রিকশার দেখা মেলে অনেকক্ষণ পরপর। এমন ফাঁকা ঢাকা শহর দেখাও চোখের আরাম। আবার এক ধরনের হাহাকারও কি প্রকাশ পায় না।

যে দিকে চোখ যায় কোথাও কেউ নেই। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা এসে যেন ঢাকা শহরের সব মানুষকে হাওয়া করে দিয়েছে। কয়েক দিনের জন্য হলেও শহুরে যান্ত্রিক বাস্তবতা কিংবা মিছে বাহানার আবাস ছেড়ে যাওয়ার স্বস্তি যেন এই ঈদ। সব ধরনের মানুষ ঈদযাত্রায় ফিরে ফিরে গেছেন যাঁর যাঁর নাড়ির কাছে। নদীর কাছে, ধানখেতের কাছে। বেড়ে ওঠা গাছের কাছে, গাছে বাসা বোনা পাখির কাছে। পুকুরঘাটের কাছে, মাছের কাছে। শৈশবের বন্ধুর সঙ্গে গলাগলি আর মুরব্বিদের সালামের স্মৃতি তরতাজা করে নেওয়ার এই তো সময়।

কাওরানবাজারের সেই ব্যস্ততাও আজ যেন ছুটিতে গেছে। অথচ গতকালও এই সময় লোকারণ্য ছিল

ঢাকার ব্যস্ততার স্বাদ নিতে আসতে হয় কারওয়ান বাজার। বিশাল রাজধানীর ভেতর এ যেন আরেক জগৎ, যে জগৎ কখনো ঘুমায় না। যেখানে দিন আর রাত সমান। সেই কারওয়ান বাজারেরও আজ ছুটি। বাজারের কুলি-মজুরদের যে কজনকে দেখলাম, কাজহীন আনন্দময় অবসরে আছেন বলে মনে হলো।

অফিসে ঢুকতে ঢুকতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পের মতো মনে হলো, ‘এই মনোরম মনোটনাস শহরে অনেক দিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো।’ কারণ, আজ ছিল ঈদের দিন।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী