পণ্ডিত বইমেলা ও ১২ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায়

নদীভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে কুড়িগ্রামের মানুষফাইল ছবি

কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব ৩৩৫ কিলোমিটার। আসতে সময় লাগার কথা ৭ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। কিন্তু ১০ মার্চ ঢাকা–কুড়িগ্রাম রুটে একমাত্র ট্রেন কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে সময় লেগেছে সাড়ে ১২ ঘণ্টা। সকাল ৭টা ১০ মিনিটে কুড়িগ্রাম থেকে ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। হোটেল মিজান ইন থেকে ঠিক সাতটায় স্টেশনে এসে শুনলাম বিলম্ব হবে। ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। 

ঢাকা থেকে যে ট্রেনটি কুড়িগ্রাম আসে, সেটাই আধা ঘণ্টা পর এখান থেকে ছেড়ে যায়। ছোট্ট, ছিমছাম কুড়িগ্রাম স্টেশন। পুরোনো লাল ইটের দালান। সামনে বিস্তীর্ণ সবুজ। স্টেশনের কর্মকর্তারা জানালেন, ঢাকা থেকে প্রায়ই ট্রেন আসতে বিলম্ব হয়। তাই বলে চার ঘণ্টা!

স্টেশনে তখন শত শত যাত্রী। এদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধদের কষ্টই বেশি। ঢাকা থেকে ট্রেনটি এল সাড়ে ১০টায়। ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিল ১০টা ৫৫ মিনিটে। 

আরও পড়ুন

ট্রেন নিয়ে কুড়িগ্রামবাসীর অভিযোগের শেষ নেই। ঢাকা–পঞ্চগড় রুটে দিনে তিনটি ট্রেন চলে। কুড়িগ্রাম রুটে মাত্র একটি। সপ্তাহে এক দিন বিরতি। এই ট্রেনের জন্যও কুড়িগ্রামবাসীকে আন্দোলন করতে হয়েছে। কয়েকজন সহযাত্রী অভিযোগ করলেন, পঞ্চগড়ে ঢাকার যাত্রী কুড়িগ্রামের চেয়ে অনেক কম। তারপরও সেখানে তিনটি ট্রেন দেওয়া হয়েছে সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলামের সময়ে। তাঁর বাড়িও পঞ্চগড়। আমাদের মন্ত্রীরা জেলাপ্রীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না। 

এবার কুড়িগ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্য চিলমারী পণ্ডিত বইমেলায় যোগদান। চিলমারী সরকারি ডিগ্রি কলেজ প্রাঙ্গণে আয়োজিত এ মেলা চলেছে ৮–১২ মার্চ। ঢাকার অনেক নামীদামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নিয়েছে। প্রতিদিনই বই নিয়ে আলোচনা হয়েছে। লেখকেরা পাঠকের মুখোমুখি হয়েছেন। উদ্যোক্তা লেখক–কবি নাহিদ হাসান ও তাঁর সহযোগীদের মতে, জ্ঞানের স্পৃহা নিয়ে যাঁরা বইমেলায় আসেন, তাঁরাই তো পণ্ডিত। তাহলে পণ্ডিত বইমেলা নামে দোষ কী? 

চিলমারী জায়গাটি ছোট, কিন্তু বইমেলার আয়োজক ও সংগঠকদের হৃদয় বড়। তঁারা সেখানে কেবল কুড়িগ্রামের লেখকদের একত্র করেননি, বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লেখক-শিল্পীদেরও এনেছেন। 

কুড়িগ্রামে দুটি স্থলবন্দর আছে। ভূরুঙ্গামারীর সোনাহাট ও রৌমারীর তুরা। কিন্তু এখানে ইমিগ্রেশন বিভাগ নেই। ফলে ব্যবসায়ীদের সীমান্ত পারাপারে সমস্যা হচ্ছে। কুড়িগ্রামে ধান ছাড়া প্রচুর আলু, সবজি ও ভুট্টা হয়। আলু সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় কোল্ডস্টোরেজ না থাকায় অনেক সময় আলু পচে যায়। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠলে কৃষকেরা শস্যের ন্যায্য দাম পেতেন। বিদেশেও রপ্তানি করতে পারতেন। 

পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছিলেন গণশিল্পী অসিতগিরি বন্দ্যোপাধ্যায়। মেলা উদ্বোধন করেন এমন একজন মানুষ, যাঁর সঙ্গে কুড়িগ্রামবাসীর নাড়ির যোগ দীর্ঘদিনের। ৭৬ বছর বয়সী আবুল হোসেন নিজেকে রাজনৈতিক কর্মী বলে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন। তিনি চুয়াত্তর থেকে আটাত্তর সাল পর্যন্ত কুড়িগ্রামে ছিলেন একটি বিদেশি সংস্থার পরামর্শক হিসেবে। সংস্থাটি দুর্ভিক্ষে মা–বাবা হারানো শিশুদের পুনর্বাসন করে। তাদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে। পরে অন্যান্য সেবামূলক কাজও করেছে। সংস্থাটি এখনো কুড়িগ্রামে গরিব মানুষের উন্নয়নে কাজ করছে। কিন্তু আবুল হোসেন চলে গেছেন তাঁর জন্মভিটা খুলনায়।  

কুড়িগ্রাম দেশের অন্যতম দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা। একসময় মঙ্গার প্রকোপ ছিল। সেটা কাটিয়ে উঠলেও এখনো সেখানকার মানুষ পিছিয়ে আছেন। স্থানীয় সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে জানতে চাইলাম মঙ্গা তো চলে গেছে, কুড়িগ্রামের এক নম্বর সমস্যা কী? তাঁরা বললেন, নদীভাঙন। নদীভাঙনের কারণে ২০ হাজার লোক উদ্বাস্তু হয়ে বাঁধের পাশে ঠাঁই নিয়েছে। কিন্তু বাঁধের কাজটিও আর এগোচ্ছে না।

আরও পড়ুন

সেই সঙ্গে তঁারা আরও যোগ করলেন, কুড়িগ্রামে কর্মসংস্থান নেই। এখান থেকে প্রতিদিন ২০০ বাস ঢাকায় আসা–যাওয়া করে। যাত্রীদের বেশির ভাগই শ্রমিক। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্পকারখানায় কাজ করেন। আছেন মৌসুমি শ্রমিকও। 

জিজ্ঞেস করলাম, কুড়িগ্রাম থেকে বিদেশে চাকরি করতে যান এ রকম মানুষের সংখ্যা কেমন? উত্তরে একজন বললেন, খুবই কম। এখানকার মানুষের কাছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরই বিদেশ। কোনো কোনো এলাকায় কুড়িগ্রাম পল্লিও গড়ে উঠেছে। 

কুড়িগ্রামে নাগরিক সমাজেরও দু–চারজনের সঙ্গে কথা হয়। তঁারা বললেন, ‘আমাদের এলাকাটি খুব অবহেলিত। আপনারা লিখুন’। তঁাদের ধারণা, প্রথম আলোতে লিখলে কাজ হয়। সমস্যার সমাধান মেলে। কুড়িগ্রামের নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একজন বললেন, এখানে কোনো শিল্পকারখানা নেই। একটি টেক্সটাইল মিল ছিল, সেটিও বন্ধ। বিসিক মুমূর্ষু।

কুড়িগ্রামে দুটি স্থলবন্দর আছে। ভূরুঙ্গামারীর সোনাহাট ও রৌমারীর তুরা। কিন্তু এখানে ইমিগ্রেশন বিভাগ নেই। ফলে ব্যবসায়ীদের সীমান্ত পারাপারে সমস্যা হচ্ছে। কুড়িগ্রামে ধান ছাড়া প্রচুর আলু, সবজি ও ভুট্টা হয়। আলু সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় কোল্ডস্টোরেজ না থাকায় অনেক সময় আলু পচে যায়। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠলে কৃষকেরা শস্যের ন্যায্য দাম পেতেন। বিদেশেও রপ্তানি করতে পারতেন। 

কুড়িগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা বেহাল থাকার কথা জানা যায় ৯ মার্চ প্রথম আলোর খবরেও। দুই মাস ধরে বন্ধ আছে কুড়িগ্রামের চিলমারী-রৌমারী নৌপথে ফেরি চলাচল। ১০ জানুয়ারি যানবাহন চলাচলের সময় রৌমারীর কুটিরচর এলাকায় পুরোনো একটি সেতু ভেঙে যায়। ওই দিন থেকে ওই পথে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

যানবাহন না থাকায় চিলমারী-রৌমারী নৌপথে ফেরি চলাচলও বন্ধ আছে। ফেরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়েছে। চিলমারী একসময় আন্তর্জাতিক নৌবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কুড়িগ্রামবাসীর প্রত্যাশা, এটি ফের পুরোনো গৌরব ফিরে পাক। মন্ত্রীরা কথাও দেন, কাজ হয় না। 

তবে কুড়িগ্রামে এসব হতাশার মাঝেও আশার খবর আছে। কুড়িগ্রামে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ভর্তি শুরু হওয়ার কথা। তবে তাঁদের প্রধান চাওয়া হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি চালু হোক। এতে পুরো এলাকার চেহারা বদলে যাবে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে সেখানে অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। 

লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালু হলে বৃহত্তর রংপুরের তিন জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে যেমন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে, তেমনি মানুষের কর্মসংস্থানও বাড়বে। কয়েক দিন আগে ভুটানের রাষ্ট্রদূত চিলমারী ঘুরে গেছেন, সেখানে একটি ভুটানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ার কথা।  

আমরা যখন ট্রেনে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম, শীর্ণকায় তিস্তা দেখে মন বিষণ্ন হয়ে গেল। দুই পাড়ের বিস্তীর্ণ বালুকারাশির মধ্যে বইছে জলের ক্ষীণধারা।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]