কাশ্মীর ফাইলস থেকে আরআরআর: ভারতীয় সিনেমা ‘সাবালক’ হবে কবে

কাশ্মীর ফাইলস ছবিটিকে সরকারি প্রোপাগান্ডা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে
ছবি: সংগৃহীত

কোনো সিনেমা ভারতে (এবং প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে) ব্যবসায়িক সাফল্য পাওয়ার মানে এই নয় যে ছবিগুলো বিদেশি দর্শকেরা, বিশেষ করে একটি নিরবচ্ছিন্ন বৈশ্বিক প্রতিকূল প্রচারণায় ইতিমধ্যেই ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা নেওয়া বিদেশিরা একইভাবে দেখবেন বা অনুভব করবেন।

 সম্প্রতি ভারতীয় সিনেমা আমাদের সীমানা ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশে আলোড়ন তৈরি করেছে। সুখের বিষয়, তেলেগু ব্লকবাস্টার আরআরআর দুটি গোল্ডেন গ্লোবের জন্য মনোনয়ন জিতেছে। অন্যদিকে কম আনন্দের বিষয় হলো, দ্য কাশ্মীর ফাইলস ছবিটিকে ১৯৯০-এর দশকের কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিতদের জাতিগত নির্মূল করা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা গভীর আবেগ নিয়ে স্বাগত জানালেও সেটিকে একজন ইসরায়েলি নির্মাতা ‘অশ্লীল প্রোপাগান্ডা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

 এই ছবি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, এমনকি বিতর্ক কূটনৈতিক স্তরে পৌঁছে গেছে। সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের প্রতি কাশ্মীর ফাইলস–এর স্ক্রিপ্ট রাইটারের উদাসীনতায় ইসরায়েলি নির্মাতা নাদাভ লাপিদসহ অনেকে হতাশা প্রকাশ করেছেন। অবশ্য আমার কিছু চলচ্চিত্র নির্মাতা বন্ধুসহ অনেকেই আবার স্ক্রিপ্ট রাইটারের অবস্থানকে মহৎ বলে মনে করছেন।

এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দুই পরিচালকের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডাও হয়েছে। লাপিদ ছবিতে চিত্রায়িত ঘটনাগুলো আদতেই ঘটেছিল কি না, তা বলতে তঁার অক্ষমতা প্রকাশ করেছিলেন এবং ওই হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা ছবিটি দেখে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন।

লাপিদ বলেছেন, কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের প্রচার হিসেবে বানানো ছবিও শৈল্পিক হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বিখ্যাত রুশ নির্মাতা সেরগেই নিকোলোভিচ আইজেনস্তাইন ও জার্মান নির্মাতা লেনি রেইফেনস্টাহলের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এই দুজনই প্রোপাগান্ডাভিত্তিক ছবি বানাতেন। কিন্তু এখন কেউই তাঁদের সেই ছবিগুলোকে আর প্রচারমূলক ছবি বলে না। কাশ্মীর ফাইলস সে রকমই কিছু নয় বলে তিনি জোর দিয়েছেন।

ছবিটির পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী বারবার উল্লেখ করেছেন, কেউ যখন বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে মত দেয়, তখনই তারা ‘প্রোপাগান্ডা’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর কাশ্মীর ফাইলস সিনেমায় চিত্রায়িত ভয়ংকর ঘটনাগুলোর সত্যতা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই এবং তিনি তঁার ছবির গল্পের জন্য ৭০০ ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।

ভারতীয় সিনেমাকে যদি বিশ্বমানের হতে হয়, ভারতের গল্পকে যদি সত্যিই বিশ্বের জন্য গ্রহণযোগ্য করতে হয়, তাহলে আমাদের কাউকে শত্রু বা বিরোধী হিসেবে ধরে না নিয়ে ভবিষ্যতে তিন শ্রেণির দর্শকের সঙ্গেই কথা বলতে শিখতে হবে। যখন নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা দর্শকেরা গল্পের আখ্যানের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, তখনই ভারতীয় সিনেমার বয়ান বিশ্বমানের বলে প্রতিষ্ঠা পাবে। যত দিন তা না হচ্ছে, তত দিন তা ‘আমাদের প্রচার, তাদের প্রচার’ মার্কা সিনেমা হবে; সেই সিনেমা ‘আমাদের’ এবং ‘তাদের’—এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সেতুবন্ধ গড়তে পারবে না।

তবে বিতর্কটি এখন কিছুটা কমে আসছে বলে মনে হচ্ছে। সম্ভবত উভয় শিবিরেরই ইসলামবিদ্বেষ কিংবা হিন্দুবিদ্বেষ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হওয়া এর কারণ হতে পারে। কাশ্মীর ফাইলস থেকে আলোচনা এখন আরআরআর-এর দিকে সরে গেছে।

এই প্রেক্ষাপটেই আমি বহু বছর ধরে ভারতীয় সিনেমার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে অর্জিত অভিজ্ঞতা অ-ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।

ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সমালোচকদের যে মৌলিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে, তা হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি ভারতীয় ছবির দৃশ্য একজন ভারতীয় দর্শকের মনের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তা বিদেশিদের ক্ষেত্রে কাজ করে না।

আমরা ভারতের সিনেমা হলে গিয়ে হাম আপকে হ্যায় কৌন কিংবা মিস্টার ইন্ডিয়া ছবি দেখে যেভাবে উদ্বেলিত হয়েছি, বিদেশের ছাত্র বা দর্শকদের কাছে তা খুব কমই চিত্তাকর্ষক ছিল।

১৯৯০-এর দশক থেকে পরবর্তী বেশ খানিকটা সময় জুড়ে ‘বলিউড’ নিয়ে বিশ্বজুড়ে একটি বিশেষ টান ছিল, যা শাহরুখ খান থেকে শুরু করে প্রবাসী ভারতীয় নির্মাতা মিরা নায়ার ও গুরিন্দর চাড্ডার মতো নির্মাতাদের বিশেষত্ব দিয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ভারতীয় চলচ্চিত্রগুলো ভারতীয়দের বয়ান বা ন্যারেটিভকে ভারতের বাইরে এগিয়ে নিতে পেরেছে।

আরও পড়ুন

এই বাস্তবতা মাথায় রেখে, আমরা দর্শকদের রুচি, বিষয়বস্তু এবং ফর্ম সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক প্রশ্নের দিকে যেতে পারি।

আমাদের এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে যে কেন আরআরআর–এর (এবং তার আগে বাহুবলী) মতো একটি সিনেমা ভারতীয় এবং অ–ভারতীয় উভয় শ্রেণির দর্শকদের মন কাড়তে পেরেছিল।

একই সঙ্গে এটিও একটি বড় প্রশ্ন যে কেন দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এর মতো একটি সিনেমায় ১৯৯০-এর জাতিগত নির্মূলকরণের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের করুণ অবস্থা দেখে ভারতীয় দর্শকদের অনেকে অশ্রুপাত করলেও তা সব অভিনয়শিল্পীর সহানুভূতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে?

ইস্যুটি কি শুধুই কট্টর পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির, যেখানে বৈশ্বিক মানবাধিকারের মানদণ্ডে হিন্দুদের মানবাধিকার পাওয়ার যোগ্য বলে গণনা করা হয় না? নাকি আমাদের সীমানার বাইরের দর্শকদের মনে জায়গা করার মতো গল্প বলার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের সক্ষমতার সেই সীমাবদ্ধতাগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার দরকার আছে।

কার্ল ভন ক্লজউইটজ লিখেছিলেন, যুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানোর সময় তিন শ্রেণির দর্শক–শ্রোতার কথা মাথায় রাখতে হয়—সমর্থক, শত্রু এবং নিরপেক্ষ গোষ্ঠী। কিন্তু আমরা কয়েক বছর ধরে ভারতের প্রোপাগান্ডার যে গল্পগুলো দেখে আসছি, তা প্রায় একচেটিয়াভাবে প্রথমোক্ত গোষ্ঠীর প্রতি আলোকপাত করে বানানো।

আরও পড়ুন

ভারতীয় সিনেমাকে যদি বিশ্বমানের হতে হয়, ভারতের গল্পকে যদি সত্যিই বিশ্বের জন্য গ্রহণযোগ্য করতে হয়, তাহলে আমাদের কাউকে শত্রু বা বিরোধী হিসেবে ধরে না নিয়ে ভবিষ্যতে তিন শ্রেণির দর্শকের সঙ্গেই কথা বলতে শিখতে হবে।

যখন নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা দর্শকেরা গল্পের আখ্যানের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, তখনই ভারতীয় সিনেমার বয়ান বিশ্বমানের বলে প্রতিষ্ঠা পাবে। যত দিন তা না হচ্ছে, তত দিন তা ‘আমাদের প্রচার, তাদের প্রচার’ মার্কা সিনেমা হবে; সেই সিনেমা ‘আমাদের’ এবং ‘তাদের’—এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সেতুবন্ধ গড়তে পারবে না।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ভামসি জুলুরি সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক