২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প ঘোষণা করেন, তখন থেকেই এই খাতের বিকাশের জন্য সরকার নানা রকম সুবিধা দিয়ে আসছে। বিগত দশকে এই খাতের উত্তোরত্তর প্রসার দেখে সেটি যে কেউই সহজে বুঝতে পারবে।
গত বছর প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকল্প ঘোষণা করেন। ফলে সবাই আগ্রহভরে অপেক্ষা করছিল, এই অর্থবছরের বাজেটে তার কতটুকু প্রতিফলন হয়।
এ বছরের বাজেটের শিরোনামই করা হয়েছে—উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তব্যেও সরকারের ডিজিটালাইজেশনের বিভিন্ন প্রকল্পের কথা বারবারই উল্লেখ করেছেন।
তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেটি গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৫২৬ কোটি টাকা বেশি। এ অর্থব্যয়ে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মানবসম্পদ উন্নয়ন, এ খাতের রপ্তানি আয় বাড়ানোর জন্য নেওয়া প্রকল্প এবং ই-গভর্ন্যান্স সফটওয়্যার তৈরির ক্ষেত্রে। ২০৪১ সাল নাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে যে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে, এ খাতের উপযোগী মানবসম্পদ তৈরি এখনই করতে না পারলে সেই লক্ষ্য হুমকির সম্মুখীন হবে।
আইসিটি ট্রেনিং খাতে ট্যাক্স-ভ্যাট মিলিয়ে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়, যেটি এ খাতের দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির প্রতিবন্ধক। যেহেতু তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মূল কাঁচামালই মানবসম্পদ, সেহেতু এই খাতের উন্নয়নের জন্য আইসিটি ট্রেনিংয়ের ওপর ট্যাক্স-ভ্যাট প্রত্যাহার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্যই দরকার।
দেশে ল্যাপটপসহ কম্পিউটার ও ইন্টারনেট পণ্য তৈরিতে ভ্যাট অব্যাহতি ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ছে, যেটি নিঃসন্দেহে দেশে তৈরি হার্ডওয়্যারশিল্প বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। প্রিন্টার, টোনার কার্টিজ, ইনজেক্ট কার্টিজ, কম্পিউটার প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ, কম্পিউটার, ল্যাটপট, এআইও, ডেস্কটপ, নোটবুক, নোটপ্যাড, ট্যাবসহ ৪৩টি পণ্যের ওপর এই ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। একই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত অপটিক্যাল ফাইবারে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু যেটি সর্বমহলে প্রত্যাশা ছিল, সফটওয়্যার খাতে কর অব্যাহতি ২০৩০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা, সেটি এ বাজেটে পূরণ হয়নি। উল্লেখ্য, বর্তমানে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি সুবিধা রয়েছে। যেহেতু স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ সরকারের এখন সবচেয়ে বড় অ্যাজেন্ডাগুলোর একটি, সেহেতু এ খাতে দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর–সুবিধা বাড়ানো জরুরি।
সফটওয়্যার খাতে উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট শূন্য শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে, যেটি নিঃসন্দেহে দেশীয় সফটওয়্যার বিকাশের পথে অন্তরায়। উল্লেখ্য, সফটওয়্যার সার্ভিস ও মেইনটেন্যান্সের ক্ষেত্রে গত বছরই ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সফটওয়্যার উৎপাদন ও মেইনটেন্যান্সের জন্য আলাদা আলাদা ভ্যাটের হার থাকলেও অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কর্তন করা হচ্ছে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট এসআরও থাকা জরুরি।
এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আইটিইএসের সংজ্ঞায় এখন পর্যন্ত রোবট প্রযুক্তি, স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, বিগ ডেটার মতো প্রযুক্তিগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অথচ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে এই প্রযুক্তিগুলোই হবে আগামী দিনের হাতিয়ার। শিগগিরই এ খাতগুলোকে আইটিইএসের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
বাজেটে দেশীয় সফটওয়্যার খাতের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে, যেটি অবশ্যই এ খাত নিয়ে সরকারের আন্তরিকতাকে প্রমাণ করে। আগে কিছুসংখ্যক সফটওয়্যার আমদানিতে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক বিদ্যমান থাকলেও এখন সব ধরনের সফটওয়্যার আমদানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্কের সঙ্গে ১৫ শতাংশ মূসকও আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, অপারেটিং সিস্টেম, ডেটাবেজ, সিমুলেশন সফটওয়্যার, অর্থাৎ যে ধরনের সফটওয়্যার বাংলাদেশে তৈরি হয় না, সে ধরনের সফটওয়্যারের ওপর আগে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক ছিল। এর ফলে পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহারের প্রবণতা বাড়বে। আরেকটি বড় খাত সাইবার নিরাপত্তার সফটওয়্যারেরও খরচ বাড়বে। কারণ, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সাইবার নিরাপত্তার কোনো সফটওয়্যার তৈরি হয় না।
ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইটিইএস খাতের অন্তর্ভুক্তি এবং উচ্চ করহার (বর্তমানে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ) কমানোর দাবি ছিল অনেক দিনের। সেটিও এবারের বাজেটে পূরণ হয়নি।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)–এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, স্বল্পোন্নত দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলো এবং যেসব দেশে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী মিশন রয়েছে, সেসব দেশে টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্সের জন্য একটি বাজেট বরাদ্দ রাখা। দেশীয় সফটওয়্যারের রপ্তানি বৃদ্ধিতে এই পলিসি অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারত। দুঃখজনকভাবে এবারও হয়তো আমরা সরকারকে সেটি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। আশা করি, ভবিষ্যতে সরকার সেটিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে।
পরিশেষে বলতে হয়, স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য প্রধান কাঁচামাল হিসেবে কাজ করবে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত। এই খাতকে সরকার পলিসি লেভেল থেকে যত বেশি সহায়তা দেবে, স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য তত দ্রুত পূরণ হবে। বাজেটে এই খাতের অপ্রাপ্তিগুলোকে দ্রুত পুনর্বিবেচনা করলে পরোক্ষভাবে সরকার ও দেশের জন্যই উপকার হবে।
রাশাদ কবির পরিচালক, বেসিস এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ড্রিম৭১ বাংলাদেশ লিমিটেড