ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি নির্মাতার একসঙ্গে বার্লিন জয়

এবারের উৎসবের শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্র হিসেবে পুরস্কার পায় ইসরায়েলি নির্মাতা ইউভাল আব্রাহাম এবং ফিলিস্তিনি নির্মাতা বাসেল আদ্রার যৌথ পরিচালনায় নির্মিত ছবি ‘নো আদার ল্যান্ড’ছবি : লেখক

আন্তর্জাতিক বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের (যাকে এখন আদর করে ‘বার্লিনালে’ বলে ডাকা হয়) সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা ৩২ বছরের। কিন্তু এবারের মতো উৎসব ঘিরে এতটা রাজনৈতিক বিতর্ক আর উত্তেজনা আগে কখনো দেখিনি। যদিও এর জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন সময়ে ছবি নির্মাতা বা বিচারকেরা উৎসবে প্রদর্শিত ছবি বা পুরস্কার নিয়ে বহুবার বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন।  

বার্লিনালে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি চলচ্চিত্র উৎসবের একটি। এই আয়োজন আমাদের সময়ের সব বিতর্কিত বিষয়কে বারবার জড়ো করেছে। সেটা শুধু ফিল্মেই নয়, বাইরের আলোচনায়ও উসকে দিয়েছে।

১৯৭০ সালে বার্লিনালের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে জার্মান চলচ্চিত্র ‘ও.কে.’ (পরিচালক মিশাএল ফেরহোফেন) দেখানো হয়। যেখানে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন সেনা দ্বারা একটি ভিয়েতনামী মেয়েকে ধর্ষণের কাহিনিকে বিষয় করা হয়েছিল। সেই বছর জুরি-সভাপতি আমেরিকান পরিচালক জর্জ স্টিভেনস ছবিটিকে উৎসব থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি করেছিলেন।

এর প্রতিবাদে দর্শক, নির্মাতা আর চলচ্চিত্র সমালোচকদের এত দুর্বার আন্দোলন শুরু হয় যে উৎসব পরিচালকেরা তাঁদের পদত্যাগের প্রস্তাব দেন এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই উৎসব বন্ধ করে দিতে তাঁরা বাধ্য হন। এর পরের বছরই, ১৯৭১ সালে উৎসব আয়োজকেরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগের পাশাপাশি ‘ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম অব ইয়াং সিনেমা’ নামে আরেকটি বিভাগ যোগ করেন।

উদ্দেশ্য ছিল যত রকম ‘রাজনৈতিক' বা নিরীক্ষাধর্মী ছবি—সবই ওই বিভাগে দেখানো হবে, যাতে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগকে সব রকম বিতর্ক থেকে রক্ষা করা যায়।

বিগত পাঁচ দশকে এই পুরো বার্লিন উৎসব এখন আমূল পাল্টে গেছে এবং এর পরিধিও বেড়েছে অনেক। দুটি থেকে বেড়ে বর্তমানে বিভাগ হয়েছে ১৪টি। আজকাল বিতর্কিত বা নিরীক্ষাধর্মী, যে ছবিই হোক না কেন, যেকোনো বিভাগেই তার স্থান পেতে কোনো বাধা নেই। প্রদর্শিত ছবি নিয়েও এখন আর তেমন কোনো উচ্চবাচ্য হয় না।

এবারের উৎসবের গোলযোগ সিনেমাসংক্রান্ত নয়, বরং বিশ্বরাজনীতি। শুরুর আগে থেকেই রাজনৈতিক মহলে বার্লিনালে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। কারণ, আয়োজকেরা জার্মান দক্ষিণপন্থী একটি রাজনৈতিক দল ‘এএফডি’র কিছু সংসদ সদস্যকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন, যেটা উৎসবের প্রটোকল অনুযায়ী সংসদের সব দলের ক্ষেত্রেই করা হয়।

সমালোচনার ঝড় এমন হয়ে ওঠে যে আয়োজকেরা উৎসব শুরুর আগেই এএফডির সংসদ সদস্যদেরকে পাঠানো আমন্ত্রণ বর্ণবাদ-দুষ্ট ওই রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের আদর্শগত বিরোধ উল্লেখ করে বাতিল করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আবার সমালোচনা হয় যে উৎসবের এই আচরণ কি আদৌ গণতান্ত্রিক হলো কি না। প্রত্যাশিতভাবেই উদ্বোধনীর দিন এএফডির সদস্যরা উৎসব প্রাঙ্গণে সরবে প্রতিবাদ মিছিল করলেন।

তবে মূল বিতর্কের জন্ম হয় উৎসবের সমাপনী দিনে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান নিয়ে। সেই সন্ধ্যার যে দৃশ্যটা সবার আগে চোখে পড়ে, তা হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্রের জন্য আন্তর্জাতিক বিচারকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে আমন্ত্রিত ভেরেনা পারভেল তাঁর পিঠে ‘সিজ ফায়ার নাউ’ লেখা একটি কাপড় লাগিয়ে ঘুরছেন।

তাঁর পিঠের মিনি-ট্রান্সপারেন্ট এমন অদ্ভুতভাবে ঝুলেছিল যে দেখে মনে হচ্ছে এই সুইস চলচ্চিত্র নির্মাতা ভেবেছিলেন উৎসব মঞ্চে সেন্সর পাশ কাটিয়ে তার বক্তব্য প্রচার করতে হবে। পিঠের লেখাটি দেখে আমাদের কারও বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান বন্ধের দাবি করছেন। সমাপনী অনুষ্ঠান রাজনৈতিক বিতর্কে জড়াবে—এটা ছিল তার পূর্বাভাস।

এবারের উৎসবের শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্র হিসেবে পুরস্কার পায় ইসরায়েলি নির্মাতা ইউভাল আব্রাহাম এবং ফিলিস্তিনি নির্মাতা বাসেল আদ্রার যৌথ পরিচালনায় নির্মিত ছবি ‘নো আদার ল্যান্ড’। বাসেল বেড়ে উঠেছেন পশ্চিম তিরে (ওয়েস্ট ব্যাংকে), যেখানে প্রতিনিয়ত ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং ইহুদি সেটেলাররা ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ভেঙে তাদের বারবার বিতাড়ন করে।

বিতাড়িত মানুষেরা কিছুদিন পর আবার ফিরে এসে বসতবাড়ি তৈরি শুরু করেন। ইসরায়েলিরা এসে সেগুলো আবার গুঁড়িয়ে দেন। এভাবে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে কয়েক দশক ধরে। পাঁচ বছর আগে এই এলাকার ফিলিস্তিনি তরুণ বাসেল আদ্রার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁরই সমবয়সী ইসরায়েলি সাংবাদিক ইউভাল আব্রাহামের।

সেই থেকে তাঁরা এ ছবির কাজ শুরু করেন। তাঁদের নিজেদের পাঁচ বছরের সংগৃহীত ফুটেজ এর সঙ্গে যোগ হয় বাসেল আদ্রার পরিবারের ২০ বছর আগে থেকে তোলা এই এলাকার নির্যাতনের বিশাল ভিডিও ফুটেজের ভান্ডার। পুরস্কার দেওয়ার আগে বিচারক ভেরেনা পারভেল বলেন,  ‘“নো আদার ল্যান্ড” আমাদের জন্য অন্য কোনো ছবির সঙ্গে তুলনীয় নয়। এখন পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের অবৈধ সামরিক দখলদারি এবং প্রতিনিয়ত অবৈধ আবাসনের ভয়াবহতাকে আর অস্বীকার করা যায় না। পুরো পৃথিবী এখন দগ্ধ হচ্ছে, আর আমাদের মধ্যে অনেকেই এর থেকে মুখ ফিরিয়ে আছি। বিশ্ব যেন এই ছবিটি থেকে মুখ ফিরিয়ে না থাকে।’

জার্মানিতে এত বড় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ইসরায়েলের সরাসরি সমালোচনা সচরাচর শোনা যায় না। ভেরেনা পারভেলের এই বক্তব্যের পর ১৬০০ দর্শকে পরিপূর্ণ হল করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে—এটাও জার্মানিতে বিরল  ঘটনা যে এ ধরনের বক্তব্যের বিপরীতে দর্শকসারি থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসে না। কিন্তু সেই সন্ধ্যায়  ইসরায়েলের সমালোচনার এটা ছিল মাত্র শুরু।

পুরস্কার নিতে এসে ফিলিস্তিনি বাসেল আদরা বললেন, ‘…আমার এই পুরস্কার প্রাপ্তি উদ্‌যাপন করতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ, এই মুহূর্তে আমার দেশে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। আমি এখন যেহেতু বার্লিনে আছি, তাই আমি জার্মান সরকারকে আহ্বান করব তারা যেন ইসরায়েলে আর কোনো অস্ত্র সরবরাহ না করে।’ তাঁর সহযোদ্ধা ইউভাল আব্রাহাম এগিয়ে এসে তাঁর নিজ দেশের সরকারকে সরাসরি “বর্ণবাদী” বলে অভিযোগ করেন, ‘আমরা দুজন আজ আপনাদের সামনে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। আমি আর বাসেল সমবয়সী। আমি একজন ইসরায়েলি আর বাসেল ফিলিস্তিনি। দুদিন পর আমরা একটা দেশে ফিরে যাব, যেখানে আমাদের সম–অধিকার নেই।


‘আমি থাকব একটা সিভিল আইনের ভেতর আর বাসেলকে থাকতে হবে একটা সামরিক আইনের ভেতর। আমরা মাত্র আধা ঘণ্টা দূরত্বের মধ্যে বসবাস করি। আমার ভোট দেওয়ার অধিকার আছে অথচ বাসেলের সে অধিকার নেই। আমি দেশের যেকোনো জায়গায় চলাফেরা করতে পারি কিন্তু লাখ লাখ ফিলিস্তিনির মতো বাসেলকে এক জায়গায় বন্দী জীবন যাপন করতে হয়। আমাদের ভেতরকার জাতিগত বিদ্বেষ ও এই অসমতার একটা শেষ দরকার এবং আমাদের সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান দরকার।’

জার্মানির মাটিতে একজন ইসরায়েলি নাগরিকের মুখে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সমালোচনা এক বিরল ঘটনা। কিন্তু তাঁর কথার বিপরীতেও কোনো বিরূপ দর্শক প্রতিক্রিয়া হলো, বরং করতালির শব্দ এবার যেন আরও একটু বাড়ল।

পুরো সন্ধ্যায়ই একের পর এক পুরস্কার বিজয়ীরা মাইকে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে চললেন। শুধু তা–ই নয়, ‘এনকাউন্টারস’ বিভাগের শ্রেষ্ঠ ছবি ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’–এর পরিচালক বেন রাসেল মঞ্চে এলেন ফিলিস্তিনিদের কুফিয়া চাদর গায়ে জড়িয়ে, যেটা দেখতে জার্মানরা আদৌ অভ্যস্ত নয়। তিনি ধন্যবাদ দেওয়ার সময় ইসরায়েলকে গাজায় ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগ করলেন।

একই বিভাগের শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার বিজয়ী ব্রাজিলিয়ান নির্মাতা হুলিয়ানা রোখাস সবাইকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের আহ্বান জানান। এমনকি সব শেষে উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গোল্ডেন বিয়ার’ বিজয়ী ছবি ‘দাহোমে’র সেনেগাল-ফরাসি নির্মাতা মাতি দীওপও বলতে ভুললেন না ‘আই স্ট্যান্ড ইন সলিডারিটি উইথ প্যালেস্টাইন।’ ‘দাহোমে’ একটি প্রামাণ্যচিত্র, যা বেনিন থেকে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক আমলে লুণ্ঠন করা কিছু কাঠের মূর্তির বাড়ি ফেরার গল্প বলে। বার্লিনালেতে এই নিয়ে পরপর দুবার একটি প্রামাণ্যচিত্র গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কারে ভূষিত হলো।

বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরস্কার উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেওয়াটা অবশ্যই বোধগম্য। এরপরও এটা দুঃখজনক যে পুরো সন্ধ্যায় শুধু উৎসব আয়োজকদের ভাষণে একবার ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলের ওপর হামাসের নৃশংস আক্রমণ আর নিরপরাধ জিম্মি সংকটের কথা উল্লেখ করা হয়। এই সন্ধ্যার এই একপেশে সমর্থনের একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরদিন হবে সেটা আমি নিশ্চিত ছিলাম এবং সকালে পত্রিকা খুলে দেখলাম হয়েছেও তাই।

শুধু তা–ই নয়, ‘এনকাউন্টারস’ বিভাগের শ্রেষ্ঠ ছবি ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’–এর পরিচালক বেন রাসেল মঞ্চে এলেন ফিলিস্তিনিদের কুফিয়া চাদর গায়ে জড়িয়ে, যেটা দেখতে জার্মানরা আদৌ অভ্যস্ত নয়।
ছবি : লেখক

‘বার্লিনালের মঞ্চে ফিলিস্তিনি শো’, ‘উৎসব মঞ্চে পুরস্কার বিজয়ীদের ইসরায়েলবিরোধী বিষোদ্‌গার’, ‘এই উৎসব আমাদের লজ্জা’—একের পর এক মুখরোচক শিরোনাম পেলাম প্রায় প্রতিটি জার্মান দৈনিকের সাংস্কৃতিক পাতায়। এমনকি জার্মানির সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ক্লাওডিয়া রোট এবং বার্লিনের মেয়র কাই ভেগ্নারও উৎসব আয়োজকদের কঠোর সমালোচনা করলেন। তাঁদের মতে, বিজয়ী বক্তাদের ইসরায়েলবিরোধী, ‘অ্যান্টিসেমিটিক’ (ইহুদিবিদ্বেষী) বক্তব্যের বিপরীতে কোনো প্রত্যুত্তর না দেওয়া ঘোরতর অন্যায়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এঁরা দুজনও সেদিন সন্ধ্যায় দর্শকদের মধ্যে বসেছিলেন এবং ধারণকৃত ভিডিওতে তাঁদের হাতও করতালির সময় সক্রিয় দেখা যাচ্ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাপারটা তাঁদের জন্য যদি এতই আপত্তিকর হয়, তাহলে তাঁরা মঞ্চে উঠে এসে কিছু বললেন না কেন? তাঁদের একজন কিছু বলতে চাইলে সে ক্ষেত্রে কেউ তাঁদের বাধা দেওয়ার সাহস পেত না। বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদেরা তাই সরাসরি মন্ত্রী মশাইকেই এই ‘বিপর্যয়ের’ জন্য দায়ী করেন। কেউ কেউ তাঁর পদত্যাগের দাবিও তুললেন। এদিকে উৎসব আয়োজকদের ভাষ্য, পুরস্কার বিজয়ীরা মঞ্চে এসে যা বলবেন, সেটা তাঁদের বাক্‌স্বাধীনতা এবং তা অবশ্যই উৎসব কর্তৃপক্ষের মতামত নয়, আর এর দায়দায়িত্বও তাঁরা নিতে রাজি নন।

জার্মানিতে কয়েক দশক ধরেই একই বিতর্ক বারবার বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঘুরেফিরে আসে আর তাতে কয়েকটা প্রশ্নই মুখ্য—ইসরায়েল রাষ্ট্রের সমালোচনা মানেইকি অ্যান্টিসেমিটিজম অথবা ইহুদিবিদ্বেষ? ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেওয়া মানেইনি কি হামাসের পক্ষ নেওয়া? ৭ অক্টোবরে হামাসের নিষ্ঠুর হামলার নিন্দা মানেই কি ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে যাওয়া আর ইসরায়েলের রাষ্ট্রনীতিকে সমর্থন দেওয়া?

এ প্রশ্নগুলোর উত্তর একেকজনের কাছে একেক রকম এবং তা সব দেশের জনগণ, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক কর্মী, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে। তবে এটা বেশ স্পষ্ট যে জার্মান সরকারের অবস্থান যেকোনো পরিস্থিতিতে বরাবরই নিঃসন্দেহে ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে।

একদিকে হামাসের কার্যক্রমের নিন্দা করলে বামপন্থীদের মধ্যে আপনি ইসরায়েলের পক্ষের অথবা ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষের লোক। আর এটাও পরিষ্কার যে এখানে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেওয়া মানেই ইসরায়েলবিরোধী, এমনকি ইহুদিবিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

জার্মান রাজনীতিবিদদের বাগ্‌বিতণ্ডার পরিণতি বার্লিন উৎসবের কদিন পরই পুরস্কৃত ইসরায়েলি নির্মাতা ইউভাল আব্রাহামের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউভাল আব্রাহাম তাঁর ‘এক্স’ অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘ডানপন্থী ইসরায়েলি জনতা গতকাল আমার খোঁজ করতে মাঝরাতে আমার বাড়িতে এসেছিল। আমার ঘনিষ্ঠ পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেওয়ায় তাঁদের ওই রাতেই অন্য শহরে পালিয়ে যেতে হয়। আমি নিজে এখনো বিভিন্নভাবে হত্যার  হুমকি পাচ্ছি এবং আমাকে আমার ইসরায়েলে ফিরে যাওয়ার ফ্লাইট আপাতত বাতিল করতে হয়েছে।

‘ইসরায়েলি গণমাধ্যম এবং জার্মান রাজনীতিবিদেরা অযৌক্তিকভাবে আমার বার্লিনালে পুরস্কার বক্তৃতাকে “অ্যান্টিসেমিটিক” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যাতে আমি মূলত ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সমতা, একটি যুদ্ধবিরতি এবং বর্ণবাদের অবসানের আহ্বান জানিয়েছিলাম।

জার্মানদের দ্বারা এই শব্দের ভয়ংকর অপব্যবহার শুধু ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি সমালোচকদের নীরব করার জন্য নয়, আমার মতো ইসরায়েলিদেরও নীরব করার জন্য ব্যবহৃত  হবে, এটা “ইহুদিবিদ্বেষ” শব্দটিকে অর্থহীন করে দেয়। আমার পরিবারের বেশির ভাগই জার্মানদের দ্বারা হলোকাস্টে খুন হয়েছিলেন।

এটি আমার জন্য প্রচণ্ড ক্ষোভের বিষয় যে ২০২৪ সালে এসে জার্মান রাজনীতিবিদেরা আমার বিরুদ্ধে এই শব্দটিকে এমনভাবে ব্যবহার করলেন, যা আমাকে, আমার পরিবারকে বিপদে ফেলেছে। সর্বোপরি, এই আচরণ আমার ফিলিস্তিনি সহপরিচালক বাসেল আদ্রার জীবনকেও ঝুঁকির মুখে ফেলেছে, যিনি সহিংস বসতিঘেরা একটি সামরিক দখলকৃত এলাকায় বাস করেন। তিনি আমার থেকে অনেক বেশি ঝুঁকিতে আছেন।’

ইউভাল আব্রাহাম তাঁর এই বার্তার শেষে জার্মান রাজনীতিবিদের উদ্দেশে একটি বাক্য ছুড়ে দেন, যাতে তাঁদের লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার কথা, ‘আপনি যদি (জার্মান হিসেবে ) হলোকাস্টের জন্য আপনার অপরাধবোধ দেখানোর উদ্দেশ্যে এটি করে থাকেন, তাহলে আমি আপনার এমন অপরাধবোধ  চাই না।’

  • শাহিন দিল-রিয়াজ, জার্মানিপ্রবাসী চলচ্চিত্র নির্মাতা।
    [email protected]