বাজেটে বরাদ্দের বৈষম্য থেকে মুক্তি পাক বিচার বিভাগ

সুপ্রিম কোর্টফাইল ছবি

‘ট্রিকল–ডাউন ইকোনমি থিওরি’ বা ‘চুইয়ে পড়া অর্থনীতি তত্ত্ব’ অর্থনীতির একটি পরিভাষা। এর মূল কথা হলো ধনীর অতিরিক্ত সম্পদ যদি কোনোভাবে উপচে বা চুইয়ে সমাজের অল্প আয়ের মানুষের কাছে আসে, তা তাদের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। চুইয়ে পড়া অর্থনীতির তত্ত্বের ক্ষেত্রে আমজনতার কাছে উন্নয়নের ফসল পৌঁছার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বৈষম্যের ক্রমবৃদ্ধিকে প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে ধরা হয়।

বেশি উন্নয়ন হলে সম্পদের স্থিতির জন্য কাজ বন্ধ রাখা, ছুটি বাড়ানোর মতো প্রণোদিত সুবিধার কথা পশ্চিমের উন্নত দেশে শোনা যায়। কিন্তু পশ্চিমের বিপরীত চিত্রই দেখি আমাদের এখানে। যেমন কিছুদিন আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকাজ বন্ধ ছিল কিছু সময়, সংস্কারের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছাদ থেকে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির পানির কারণে। ভাবা যায়, প্রধান বিচারপতির এজলাসেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমন নানা অনুঘটক সঙ্গী করে আমাদের বিচার বিভাগের এ পর্যন্ত আসা।

সামনেই আরেকটা বাজেট। বাজেট পেশ ও পাসের আগেই রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ বিচার বিভাগের বাজেট নিয়ে তাই কিছু বলা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে সুপ্রিম কোর্টের জন্য বরাদ্দ ছিল ২০৯ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য ১ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব পেশ করা হয়। আর সুপ্রিম কোর্টের জন্য ২৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে সত্য। কিন্তু মোট বাজেটের বিবেচনায় তা একেবারেই নগণ্য। এবার কি অন্যথা হবে?

রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটি অথচ অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের চেয়েও কম (ড. শাহদীন মালিক বিচার বিভাগের বাজেট প্রসঙ্গে এই মন্ত্রণালয়ের রেফারেন্স দিয়ে থাকেন)।

‘নিজ শক্তির ওপরে বৈরাগ্য ও শৈথিল্যের ভার’ নাকি অন্য কোনো কারণে বিচার বিভাগের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে প্রথিতযশা আইনজীবীদের কোনো চিন্তাচর্চা চোখে পড়ে না। তবে এ ক্ষেত্রে প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। যদিও পত্রিকার উপসম্পাদকীয় কি আর অটল আমলাতন্ত্রকে টলাতে পারে? 

পরিকাঠামো উন্নয়নের স্মারক, তাই এই খাতে বরাদ্দ বেশি থাকবে স্বাভাবিক। কিন্তু আইনি পরিষেবায় প্রত্যেকের সমান অধিকার। অর্থনীতির পরিভাষায় ‘পাবলিক গুডস’ আর আইনের পরিভাষায় যেটিকে ‘অ্যাকসেস টু জাস্টিস’ বলা হয়, তা নিশ্চিত করতে বাজেট বরাদ্দ যেন যথাযথ হয়, এ নেহাত সাধারণ চাওয়া। পরিকাঠামো হোক বা পরিবেশ, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা অথবা শিক্ষা-স্বাস্থ্য একই সঙ্গে সার্বিকভাবে আরও ভালো প্রশাসনের জন্য বেশি বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। 

স্বাধীনতা লাভের পর ইতিহাসের বিভিন্ন সময় নানা প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও দেশের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এর বেশির ভাগ অংশজুড়েই আমরা দেখি বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা নানা পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের শেষ অবলম্বনের ভূমিকা পালন করেছে। যদিও কেন্দ্রীকরণের প্রবণতাসম্পন্ন নির্বাহী বিভাগে ক্ষমতার অভূতপূর্ব ঘনীভূতকরণের ফলে বিচার বিভাগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রা অর্জনের পথে আজও সংগ্রামরত। এরপরও আইনের শাসনের প্রকৃত আশ্রয় বিবেচিত হয়ে একটি দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রমাণের পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে বিচার বিভাগ। 

বিচার বিভাগের আত্মবীক্ষণ এবং সবার জন্য ন্যায়বিচারকে বাস্তবে পরিণত করার উপযুক্ত সময় বোধ করি এখনই। কিন্তু চোখ রাঙায় বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ অপ্রতুল বাজেট।

আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক মিথস্ক্রিয়ার বিষয়টি বোঝা উচিত। একই সঙ্গে সমগ্র ব্যবস্থার সামনে উপস্থিত চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতাও খতিয়ে দেখে তার সমাধান খুঁজে বের করা দরকার। বিচার বিভাগের আত্মবীক্ষণ এবং সবার জন্য ন্যায়বিচারকে বাস্তবে পরিণত করার উপযুক্ত সময় বোধ করি এখনই। কিন্তু চোখ রাঙায় বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ অপ্রতুল বাজেট। বাজেট এখন আর ‘এক্সিকিউটিভ প্রিরোগেটিভ’ বা নির্বাহী বিশেষাধিকার নয়, পশ্চিমের দেশগুলোতে বাজেট প্রণয়নের প্রায় সব পর্যায়ে বিচার বিভাগ তার প্রয়োজন অনুযায়ী অংশ নেয়। 

‘ভারত-বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা: দক্ষিণ এশিয়ার একবিংশ শতাব্দীর সাংবিধানিক আদালত’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে গেল গত ফেব্রুয়ারিতে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে দারুণ সফল একটি সম্মেলন ছিল। এর রিভিউ মিটিংয়ে আরও বড় পরিসরে বেশিসংখ্যক দেশের উপস্থিতিতে এ ধরনের সম্মেলন আয়োজনে প্রাথমিক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় অপ্রতুল বাজেট।

ওই সম্মেলনে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত আমাদের একজন চৌকস আইনজীবীকে অনানুষ্ঠানিক আলাপে বিচারপতি না হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি সততার সঙ্গে অপর্যাপ্ত অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলেন। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারপতির পারিতোষিক বেশ কম। যথাযথ পারিতোষিক প্রণোদনা চৌকস ও মেধাবী আইনজীবীদের বেঞ্চে যোগদানের সংশয় দূর করতে পারে।

স্বাধীনতার পর প্রথম বাজেটের মৌলিক বিবেচনা ছিল সামগ্রিক অর্থে সাংবিধানিক অঙ্গীকার পূরণে রাজনৈতিক দর্শনের ‘সুপ্রিমেসি’। এরপর তো কেটে গেছে অর্ধশতাব্দীর বেশি। ধারে-ভারে বিপুলাকার ধারণ করেছে বাজেটের কলেবর। এখন তাই রাষ্ট্রের ‘পলিটিকো-লিগ্যাল’ দর্শনের সঙ্গে আর্থিক নীতির মিথস্ক্রিয়ার ফল (বিভাগের জন্য যথাযথ বাজেট) দেখতে আর কত অপেক্ষায় থাকতে হবে?

এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট