সম্প্রতি বেইজিংয়ের গ্রেট হলে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর সমকক্ষ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে উষ্ণ করমর্দনে ও দীপ্তিময় হাসি দিয়ে স্বাগত জানান। বিশ্বের দুই ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টকে স্কুলপড়ুয়া শিশুরা পতাকা নাড়িয়ে অভিবাদন জানায়। পিপলস লিবারেশন আর্মি তাদের বাদ্যযন্ত্রে সোভিয়েত আমলের মস্কো নাইটস গানের সুর তোলে। সুরের এই মূর্ছনা দেখে এটা বোঝার উপায় ছিল না যে ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খারকিভে রাশিয়া জোরদার হামলা শুরু করেছে, যার ফলেন্ত ৮ হাজারের বেশি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে।
এই সফর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে চীনের স্বীকৃতি দেওয়ার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন। সেই উপলক্ষেই সংগীতের এই আয়োজন। যদিও পুতিনের নিজের বেছে নেওয়া ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘদিনের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রাশিয়ার নেতাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ক্ষমতায় বসার পর বেইজিং সফর দিয়েই তাঁদের বিদেশ সফরের একটা রীতি চলে আসছে। কিন্তু এবারে ষষ্ঠবারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসার মাত্র ৯ দিনের মাথায় বেইজিং সফর বলে দেয় যে এই সফর পুতিনের জন্য কতটা জরুরি।
গ্রেট হল অব পিপলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পুতিনের উদ্দেশে সি চিন পিং বলেন, ‘চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক আজকের অবস্থানে অনেক কষ্টে অর্জন হয়েছে। দুই পক্ষকেই এই সম্পর্ক লালন–পালন করা প্রয়োজন।’ সি চিন পিং আরও বলেন, ‘চীনের ইচ্ছা হচ্ছে...যৌথভাবে উন্নয়ন অর্জন করবে এবং আমাদের পরস্পরের সম্পর্কিত দেশগুলো পুনর্জীবন পাবে এবং বিশ্বে ন্যায় ও সততা প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করব।’
এটা ছিল এমন এক ঐক্যের প্রদর্শন, যেটা পশ্চিমা নেতাদের নিরাশ করবে। কেননা, কয়েক মাস ধরে তাঁরা সি চিন পিংকে পথে আনার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, পুতিনকে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে সেটা চীনের স্বার্থকেই ক্ষতি করবে। সি চিন পিং সবেমাত্র ইউরোপের তিন দেশ সফর শেষে বেইজিং ফিরেছেন। এই সফরে ইউরোপীয় কমিশনের চেয়ারম্যান উরসুলা ভন ডার লেন ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ মিলে সি চিন পিংকে উপদেশ দিয়েছিলেন, যেন তিনি পুতিনের যুদ্ধযন্ত্রে সমর্থন না দেন। এখানে আরও উল্লেখ করা দরকার যে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস মার্চ মাসেই বেইজিং সফর করে গেছেন।
কিন্তু ফলাফলটা যে কী হয়েছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে সি চিন পিংকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেন তাঁর ‘উষ্ণ ও কমরেডসুলভ’ কথাবার্তার জন্য। প্রত্যুত্তরে সি চিন পিং ঘোষণা করেন, চীন ও রাশিয়ার ‘চিরস্থায়ী’ বন্ধুত্ব ‘নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে রোল মডেল হয়ে উঠেছে।’
রাশিয়ার উত্তরাঞ্চল থেকে মঙ্গোলিয়া হয়ে চীনে আসার জন্য সাইবেরিয়া-২ পাইপলাইনের নির্মাণকাজ অনেকটাই এগিয়েছে। এই পাইপলাইন দিয়ে বছরে ৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আসবে। মারসিন কাচমারস্কির বলেন, ‘পুতিন কিছু অর্জন করতে চান, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে বেইজিংয়ের ওপর।’
যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা বারবার করে টাইমকে বলে আসছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পূর্ণ তথ্য সি চিন পিং হয়তো না–ও পেতে পারেন। ইউরোপ তাঁকে এ ব্যাপারে পূর্ণ চিত্র পেতে সহায়তা করতে পারে। সি চিন পিংকে ঠিকমতো তথ্য দেওয়া হয় না, বিশেষজ্ঞরা এই ধারণার সঙ্গে পুরোপুরি ভিন্নমত পোষণ করেন। পুতিনের সঙ্গে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত সি চিন পিংয়ের ৬৩ বার দেখা হয়েছে। প্রতি দুই সপ্তাহে বা কাছাকাছি সময়ে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা একে অপরের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে শলাপরামর্শ করেন। সংবাদ সম্মেলনে দুই দেশ তাদের মধ্যে সামরিক মহড়া বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছে।
সিডনির নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন-রাশিয়া সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার কারোলেভ মনে করেন, পশ্চিমা যেকোনো দেশের চেয়ে ইউক্রেন ও রাশিয়ার ব্যাপারে বেশি জানেন সি চিন পিং।
প্রকৃতপক্ষে সি চিন পিংকে চাপে রাখলে তিনি ঠিকপথে থাকবেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই যুক্তির পক্ষে সত্যি সত্যি কোনো তথ্য–প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। সাড়ে ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা মাথায় নিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যবস্থায় যখন তীব্র সমস্যায় পড়েছে রাশিয়া, সে সময় চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক নির্ভরতায় কেবল বাড়িয়েছে। ২০২৩ সালে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল ২৪০ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। এক বছর আগের তুলনায় ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। অস্ত্র বিক্রি এড়িয়ে সি চিন পিং চীনের ফার্মগুলোকে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করার অনুমতি দিয়েছে। যেটা রাশিয়ার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞাকেই ফালতু বিষয়ে পরিণত করেছে।
সম্প্রতি অবশ্য ওয়াশিংটন যেসব পণ্য বেসামরিক ব্যবহারের পাশাপাশি সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়, সেগুলো রাশিয়াতে যেন রপ্তানি না হয়, চীনের প্রতি সেই হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এর মানে শুধু ড্রোন, হেলমেট, ভেস্ট বা বর্ম ও রেডিও নয়, প্রযুক্তির কথাও তারা বলেছে।
চূড়ান্তভাবে, পশ্চিমাদের পাহাড়সম চাপ এড়িয়ে পুতিন ও সি চিন পিং তাঁদের বন্ধুত্বকে অটুট রেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা যে পতনশীল এবং ক্ষয়িষ্ণুতার সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে, তারা দুজনে এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন। চীনের কৌশলগত স্বার্থ যেমন, বাণিজ্য ও প্রযুক্তি থেকে শুরু করে মানবাধিকার ও তাইওয়ানের মর্যাদা—সবকিছুতেই যুক্তরাষ্ট্রের আঘাত করে চলায়, এই ধারণাকেই সামনে আনে যে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপই হচ্ছে।
সম্প্রতি বাইডেন প্রশাসন আমেরিকান শ্রমিকদের চীনের অন্যায্য প্রতিযোগিতা থেকে সুরক্ষা দিতে দেশটি থেকে আসা পণ্যের আমদানির ওপর নতুন শুল্ক ঘোষণা করেছে। এ ব্যাপারে ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোর নিরাপত্তা স্টাডিজের প্রভাষক মারসিন কাচমারস্কির বলেন, এখানে একমাত্র প্রশ্ন হলো, বাইডেনের শুল্ক বসানোর এই সিদ্ধান্ত সি চিন পিংকে কি খোলাখুলিভাবে রাশিয়াকে আরও কিছু দেওয়ার সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাবে, নাকি তাঁকে ঠিক পথে ধরে রাখা যাবে?
এটা পরিষ্কার যে চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চান পুতিন। সে উদ্দেশ্যেই তিনি বেইজিংয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নিরাপত্তা কাউন্সিলের সচিব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, সবচেয়ে বড় ব্যাংকগুলোর প্রধানেরা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে নিয়ে যান। রাশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে পুতিন চান চীনের পুঁজিবাজারে প্রবেশ করতে ও চীনের মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহার করতে।
রাশিয়ার উত্তরাঞ্চল থেকে মঙ্গোলিয়া হয়ে চীনে আসার জন্য সাইবেরিয়া-২ পাইপলাইনের নির্মাণকাজ অনেকটাই এগিয়েছে। এই পাইপলাইন দিয়ে বছরে ৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আসবে। মারসিন কাচমারস্কির বলেন, ‘পুতিন কিছু অর্জন করতে চান, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে বেইজিংয়ের ওপর।’
চার্লি ক্যাম্পবেল, টাইম-এর সংবাদদাতা, এশিয়ার ব্যবসা, প্রযুক্তি ও ভূরাজনীতি তাঁর কাজের ক্ষেত্র
টাইম থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনুবাদ মনোজ দে