অগ্নিগর্ভ আরাকান নিয়ে নতুন উদ্বেগ

পুরো রাখাইন প্রদেশই ক্রমে খালি হয়ে যাচ্ছে
এএফপি ফাইল ছবি

আগামী ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন। এটি সে দেশে বেসামরিক সরকারের অধীনে প্রথম জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু দেশটির বাংলাদেশ-সংলগ্ন রাখাইন প্রদেশে নির্বাচনী উত্তাপ নেই; বরং মানুষ যে যেদিকে পারছে, পালাচ্ছে। রাস্তায় বোমা ফাটছে; আকাশে উড়ছে সরকারি ড্রোন। পুরো প্রদেশ সন্ত্রস্ত।

বাংলাদেশে রাখাইন প্রদেশ আরাকান নামে বেশি পরিচিত। সেই আরাকানে এখন যারা পালাচ্ছে, তারা বৌদ্ধ রাখাইন। স্থানীয় মুসলমান রোহিঙ্গাদের বড় অংশ তিন বছর আগেই গণহত্যার মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাই পুরো প্রদেশই ক্রমে খালি হয়ে যাচ্ছে। থাকছে কেবল দুটো সশস্ত্র পক্ষ—মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় প্রতিরোধ যোদ্ধাদল ‘আরাকান আর্মি’।

মিয়ানমারের বড় কূটনৈতিক সফলতা হলো চীন, ভারত, জাপানসহ এশিয়ার সব প্রভাবশালী রাষ্ট্রকে তারা আরাকানে মানবাধিকার দলনের বিষয়ে নীরব রাখতে পারছে। বাংলাদেশের সামনে তাই আরাকান একই সঙ্গে এক সামরিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ

আরাকান আর্মির সঙ্গে পারছে না ‘টাটমা-ড’

মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী ‘টাটমা-ড’ নামে পরিচিত। টাটমা-ড দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রিসভায়ও তাদের তিনজন প্রতিনিধি থাকেন। পাঁচ লাখ সদস্যের বিশাল জনবল তার। গেরিলাযুদ্ধ মোকাবিলায় টাটমা-ডর বিশেষ সুনাম আছে। গত ৭২ বছর বিশ্বখ্যাত অনেক গেরিলা বাহিনীর স্বাধিকারের সংগ্রাম ঠেকিয়ে তারা ‘ইউনিয়ন-মিয়ানমার’-এর অখণ্ডতা রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু আরাকানে তারা নবীন আরাকান আর্মির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ইমেজ বাঁচাতে টাটমা-ডর জেনারেলরা আরাকানে চালাচ্ছে পোড়ামাটি নীতি। ২০১৭ সালে তারা রোহিঙ্গা গ্রামগুলো ছারখার করেছিল। এখন পুড়ছে রাখাইনদের বাড়িঘর। গত সপ্তাহে রাথিডং এলাকায় সেনা ও নৌবাহিনীর যৌথ অভিযানকালে বিমানবাহিনীও ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। এত দিন এ রকম আক্রমণে কেবল হেলিকপ্টার বহর অংশ নিত। আরাকানের আকাশে যত্রতত্র দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী।

আরাকান আর্মি কারা

মিয়ানমারে গেরিলা গ্রুপের কমতি নেই। কোনো কোনোটির বয়স ৫০-৬০ বছর। সেই তুলনায় আরাকান আর্মি অতি নবীন। ২০০৯ সাল থেকে এই সংগঠনের নাম শোনা যেতে থাকে। আরাকানকে বর্মীদের দখলমুক্ত করাই তাদের লক্ষ্য। স্বঘোষিত জেনারেল থন মাট নইঙ এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বলা হয়, আরাকান আর্মি ইউনাইটেড আরাকান লিগের সশস্ত্র শাখা, যারা হৃদয়ে লালন করে অতীতের স্বাধীন আরাকানের ইতিহাস।

তবে বর্তমান যুদ্ধের তাৎক্ষণিক সামরিক কারণ, প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে আরাকান আর্মির ঘাঁটি এলাকা গড়তে চাওয়া। এ রকম দুর্ভেদ্য সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে কাচিন, কারেন ও শানরা ইউনিয়ন মিয়ানমারে থেকেও নিজ নিজ এলাকায় নিজস্ব বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনা করছে। ঠিক ও রকম লক্ষ্য নিয়ে আরাকান আর্মির গেরিলারা দলে দলে আরাকানে ঢুকছে। চিন প্রদেশের যে পালিতোয়া এলাকা দিয়ে তারা আরাকানে ঢুকছে, সেটা বাংলাদেশের বান্দরবান-সংলগ্ন। বান্দরবান থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি পালিতোয়া শহর। এ এলাকাই এখন যুদ্ধের মূল উত্তাপকেন্দ্র। তবে আরাকান আর্মির গেরিলারা উত্তর আরাকানের প্রায় প্রতিটি গ্রামে হাজির আছে এখন। ফলে মিয়ানমারের ইতিহাস নতুন করে আরেক চিরায়ত গেরিলাযুদ্ধ দেখছে।

আরাকানে সশস্ত্র বাহিনীর পাশে সু চির দল

আরাকান যুদ্ধের প্রধান এক শিকার এই মুহূর্তের নির্বাচন। ১৯৯০-এর আগে-পরে আরাকানের রোহিঙ্গা ও রাখাইন—উভয় সম্প্রদায় সেনা শাসনের বিরুদ্ধে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির সমর্থক ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গাবিরোধী সেনা অভিযানে যেমন এনএলডি সরকার চুপচাপ ছিল, এখন রাখাইনবিরোধী অভিযানকালেও অনুরূপ ভূমিকায়। উপরন্তু যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে সু চি চাইছেন আরাকান থেকে স্থানীয় রাজনৈতিক দল ‘আরাকান ন্যাশনাল পার্টি’কে দুর্বল করে প্রদেশজুড়ে তাঁর দলকে একচেটিয়া করতে। ইতিমধ্যে মহামারির কথা বলে আরাকানের অনেক জায়গায় নির্বাচন হবে না বলে দেওয়া হয়েছে। এতে আরাকানের প্রায় ১২ লাখ রাখাইন এবার ভোট দিতে পারবেন না। মূলত আরাকান ন্যাশনাল পার্টিকে ঠেকাতে এই আয়োজন। কারণ, এই দলকে আরাকান আর্মির প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ টাটমা-ড যখন আরাকান আর্মির ওপর বোমা ফেলছে, এনএলডি তখন সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অকার্যকর করার চেষ্টা করছে। পাল্টা হিসেবে আরাকান আর্মিও এনএলডির কয়েকজন প্রার্থীকে অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি উদ্বেগের

বাংলাদেশের জন্য এই অবস্থা ভূরাজনীতির দিক থেকে উদ্বেগজনক ও গভীরভাবে তাৎপর্যময়। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত বেশি বড় নয়, ২০০ মাইলের কম। কিন্তু অশান্ত আরাকান বাংলাদেশের স্বস্তি কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এটা সত্য যে আরাকান এখনই আরাকান আর্মির পূর্ণ দখলে যাচ্ছে না। কিন্তু ক্রমে মাঠের পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে। স্থানীয় রাখাইনরা ইতিমধ্যে তাদের নীরব কর্মী হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি টাটমা-ডর আক্রমণও বাড়ছে এবং আরও বাড়বে। রাখাইনদের বাংলাদেশে শরণার্থী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের রাখাইনরা আরাকানে মানবাধিকার দলনের প্রতি দৃষ্টি কাড়তে ঢাকায় বড় ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশও করেছে। দ্বিতীয়ত, আরাকানে টাটমা-ডর নিয়ন্ত্রণ কমতে থাকলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাখাইনদের আন্তসম্পর্ক কেমন দাঁড়ায়, তার ওপরও নির্ভর করবে রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফেরার বিষয়টি। এই উভয় সম্প্রদায়ের ভেতর ক্ষুদ্র অনেক উগ্রবাদী ধারা রয়েছে, যারা পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত হতে পারে। এ রকম অস্থিতিশীলতা এই অঞ্চল দিয়ে মাদকের চোরাকারবার বাড়িয়ে দিতে পারে। যে সমস্যায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

তৃতীয়ত, আরাকান যুদ্ধে নিজেদের সামরিক ব্যর্থতা আড়াল করতে মিয়ানমার রাখাইন গেরিলাদের পেছনে বাংলাদেশের মদদ আবিষ্কার করতে পারে। ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে এ রকম প্রচারণা শুরু করেছে তারা।

বঙ্গোপসাগরে অস্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে

টাটমা-ডর বহুমাত্রিক প্রচারণা সত্ত্বেও বিশ্বসমাজ আরাকানের ঘটনাবলি পুরোপুরি অবহিত বলেই মনে হচ্ছে। সেখানে টাটমা-ডর পোড়ামাটি নীতির বিরুদ্ধে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা প্রায়ই উদ্বেগ প্রকাশ করছে। তবে মিয়ানমারের বড় কূটনৈতিক সফলতা হলো চীন, ভারত, জাপানসহ এশিয়ার সব প্রভাবশালী রাষ্ট্রকে তারা আরাকানে মানবাধিকার দলনের বিষয়ে নীরব রাখতে পারছে। বাংলাদেশের সামনে তাই আরাকান একই সঙ্গে এক সামরিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

টাটমা-ড সম্প্রতি উসকানিমূলক তৎপরতা হিসেবে সীমান্তে সৈন্য সংখ্যাও বাড়াচ্ছে। বিজিপি নামে পরিচিত রাখাইন প্রদেশের সীমান্ত পুলিশের তিনটি নতুন ব্যাটালিয়নও গড়ছে তারা। যেসব সামরিক অফিসারকে সেনাবাহিনী থেকে সীমান্ত পুলিশে পাঠানো হচ্ছে, তারা মাঠপর্যায়ের অভিযানে বিশেষ দক্ষ হিসেবে বিবেচিত। এসবই বাংলাদেশের জন্য বাজে ইঙ্গিত। এভাবে টাটমা-ড ও সু চির দল এনএলডির দ্বিমুখী রাজনৈতিক ও সামরিক যৌথ অভিযানে বাংলাদেশের পাশে নতুন যে অগ্নিগর্ভ আরাকান তৈরি হচ্ছে, তা বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলজুড়ে বাড়তি অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিতবহ।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক