অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থার গলদে সীতাকুণ্ডে এত হতাহত

ডিপোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা থাকলে এত প্রাণহানি এড়ানো যেত

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডটি সাধারণ অগ্নিকাণ্ড নয়। ভয়াবহ রূপ নেওয়ার কারণ হচ্ছে সেখানে অনেক ধরনের রাসায়নিক ছিল। সাধারণত এ ধরনের ডিপোতে ঝুঁকিপূর্ণ কনটেইনার থাকে। আমাদের তৈরি পোশাক, খাদ্য কিংবা ওষুধশিল্পের জন্য নানা ধরনের রাসায়নিক আনা হয়। রপ্তানির জন্যও রাসায়নিক সেখানে রাখা হয়। এর মধ্যে বিষাক্ত, দাহ্য বা বিস্ফোরণ ঝুঁকিসম্পন্ন রাসায়নিক থাকে। সে জন্য নির্দিষ্ট কোন রাসায়নিক থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পর বিস্ফোরণের ফলে সেটা একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

সীতাকুণ্ডের যে ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছে, সেটা একটা দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি। স্বাভাবিকভাবেই তাদের অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা যথাযথ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পত্রিকা ও টেলিভিশনে যতটা দেখেছি তাতে বলা যায়, ডিপোর অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থায় অনেক গলদ ছিল। প্রাথমিক অবস্থায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এত বড় দুর্ঘটনা আমরা দেখতে পেলাম। অনেক মানুষ মারা গেছেন। অনেক মানুষ দগ্ধ হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। তাঁদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, সেখানে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কনটেইনার ছিল। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড সাধারণ অবস্থায় দাহ্য নয়। এটা অক্সিডাইজিং বা অগ্নিসহায়ক রাসায়নিক হিসেবে কাজ করে। কোথাও হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থাকলে সেই আগুনটা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। কেননা, অক্সিজেনের জোগানটা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থেকে আসে। এ কারণে আগুনের তীব্রতা এত বেশি ছিল। আবার হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের নির্দিষ্ট বয়লিং পয়েন্ট (উত্তপ্ত হওয়ার চূড়ান্ত মাত্রা) আছে। আগুনের সূত্রপাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণটা হয়নি। কেননা, বিস্ফোরণের অবস্থায় পৌঁছাতে বেশ কিছুটা সময় দরকার হয়। ডিপোতে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলে ওই সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো।

এটা নিশ্চিত যে ডিপোটাতে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থায় অনেক ধরনের দুর্বলতা ছিল। সে কারণেই আগুন নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় চলে গেছে। অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে জরুরি যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, সেগুলো একেবারেই করা হয়নি। সেখানকার শ্রমিক ও অন্যদের যেভাবে বের করে আনা দরকার ছিল, সেটা করা হয়নি। সেখানে উৎসুক জনতা ভিড় করেছে, ছবি তুলেছে, ভিডিও করেছে, ডিপোর কর্মচারীরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। এ কারণে এত হতাহত হয়েছে। ডিপোতে যদি পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা থাকত, তাহলে শুরুতেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যেত। সেটা করা গেলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না। যদি অগ্নিনির্বাপণ এবং লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার প্রটোকল মেনে চলা হতো, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা এড়ানো যেত।

খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের অন্তত আটজন কর্মী নিহত হয়েছেন। তাঁরা কোনো কিছু চিন্তা না করেই আগুন নেভাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কিন্তু এটা তো সাধারণ অগ্নিকাণ্ড ছিল না। রাসায়নিকের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা প্রস্তুতি দরকার। আগুনের ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পরও ডিপো কর্তৃপক্ষ জানায়নি ওখানে কী কী ধরনের রাসায়নিক ছিল।

এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকপূর্ণ কনটেইনার একটার পর একটা যেভাবে রাখা হয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। কনটেইনার রাখার একটা আন্তর্জাতিক গাইডলাইন আছে। আলাদা জায়গায় এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কনটেইনার রাখতে হবে। অন্যান্য পণ্যবাহী কনটেইনার থেকে আলাদা করে রাখতে হবে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে বিপজ্জনক পণ্য ও রাসায়নিক রাখার জন্য আলাদা শেড আছে। সীতাকুণ্ডের ডিপোটাতে এটা মেনে চললে ফায়ার সার্ভিস আগুনটাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে রাখতে পারত। সেটা ছড়িয়ে পড়ত না।

এত বড় দুর্ঘটনার পরও আমরা ভাগ্যবান, সেটা বলা যায়। লেবাননের বৈরুতের মতো রাসায়নিক থাকলে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। সে ক্ষেত্রে আরও বড় ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত। সীতাকুণ্ডের এ দুর্ঘটনা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গাইডলাইন আছে। বেসরকারি ডিপোগুলো সেটা মেনে চলছে কি না, তা তদারকির কর্তৃপক্ষ কে, সেটা এখন অনেক বড় প্রশ্ন। প্রতিটি ডিপোকে গাইডলাইনের আওতায় আনতে হবে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের মতো তদারকি কর্তৃপক্ষের যাঁরা আছেন, তাঁদের নজরদারি বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন

পুরান ঢাকার নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো বড় দুর্ঘটনা আমাদের দেশে হয়েছে। লোকালয়ের মধ্যে অবৈধভাবে রাসায়নিক মজুত করা হয়েছিল। কিন্তু ডিপোতে রাসায়নিক তো আইনি প্রক্রিয়া মেনেই সংরক্ষণ করা হয়। ডিপোগুলো লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান। সেখানে টন টন রাসায়নিক মজুত রাখা হয়। এগুলোর মধ্যে বিষাক্ত, দাহ্য কিংবা বিস্ফোরক গুণসম্পন্ন রাসায়নিকও রয়েছে। নিমতলী, চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। কারখানা ও বন্দরগুলোতে পরিদর্শন বাড়ানো হয়েছে। এ ধরনের দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানোর তাগাদা দেওয়া হয়েছে। সীতাকুণ্ডের এ অগ্নিকাণ্ড থেকে মনে হচ্ছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন কনটেইনার ডিপোগুলো এ ধরনের তদারকির বাইরে থেকে গেছে। সরকার, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ডিপো কর্তৃপক্ষ সবারই এ জন্য দায় রয়েছে। কেননা, এটা নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জরুরি প্রশ্ন।

খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের অন্তত আটজন কর্মী নিহত হয়েছেন। তাঁরা কোনো কিছু চিন্তা না করেই আগুন নেভাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কিন্তু এটা তো সাধারণ অগ্নিকাণ্ড ছিল না। রাসায়নিকের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা প্রস্তুতি দরকার। আগুনের ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পরও ডিপো কর্তৃপক্ষ জানায়নি ওখানে কী কী ধরনের রাসায়নিক ছিল। ডিপো কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসকে আগে থেকে তথ্য জানালে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঝুঁকি পরিমাপ করে সেখানে যেতে পারতেন। এটা আবেগের বিষয় নয়।

  • ইয়াসির আরাফাত খান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক