অটো পাসেই চলছে বাংলাদেশের রাজনীতি

এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা না নিয়ে সবাইকে অটো পাস দেওয়া ঠিক হয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোয় ‘অটো পাস ভালো সমাধান নয়’ শিরোনামে একটি কলামে লিখেছেন, যদি আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সত্যিকার উন্নয়ন ও অগ্রগতি চাই, তাহলে পরীক্ষায় অটো পাসপ্রথা বাতিল করে কোনো না কোনো উপায় মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। এ প্রসঙ্গে তিনি ষাট ও সত্তর দশকে তাঁর ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনাসহ অটো পাসের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরেছেন। তাঁর সমসাময়িক এবং কনিষ্ঠদের অভিজ্ঞতাও কমবেশি একই রকম। স্বাধীনতার পর অনেক বছর পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা অটো পাসের কবলে পড়েছিলেন নকলের প্রাদুর্ভাবের কারণে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলেছেন, চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে সবাইকে পাস করিয়ে দেওয়া ছাড়া তাঁদের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। এই করোনা মহামারিতে পরীক্ষা নিতে গিয়ে তাঁরা তরুণ বয়সী ছেলেমেয়েদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারেন না। তাঁদের এ কথায় যুক্তি আছে।

অনিবার্য কারণে কোনো বছরের পড়াশোনা ব্যাহত হলে তা পরবর্তীকালে বাড়তি শ্রম ও অধ্যবসায় দিয়ে পুষিয়ে নেওয়া যায়। সেই বিবেচনায় এ বছর এইচএসসি কিংবা মাধ্যমিক পর্যায়ে বার্ষিক পরীক্ষা না নেওয়ার ক্ষতি অপূরণীয় নয়; যদি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আন্তরিক চেষ্টা চালান। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো শিক্ষা শিল্প-সাহিত্য, গবেষণা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সরকার, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই অটো পাস বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পরবর্তী ধাপে উত্তরণের আত্মঘাতী প্রবণতা চলে আসছে বহুদিন ধরেই।

অন্যান্য ক্ষেত্রে অটো পাসের ক্ষতি নিয়ে পরবর্তী কোনো সময়ে আলোচনা করা যাবে। আমরা এখানে রাজনীতিতে যে অটো পাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, তার ওপর আলোকপাত করতে চাই। কেননা রাজনীতিই একটি জাতির অগ্রগতি-উন্নতির মূল চালিকা শক্তি। রাজনীতি ঠিক থাকলে অর্থনীতি, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি সাংবাদিকতা ঠিক করা কঠিন নয়। আর রাজনীতি ঠিক না থাকলে শেষ বিচারে কোনো কিছুই ঠিক থাকে না।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একধরনের অটো পাস ব্যবস্থা চলে আসছিল। অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন ছাড়াই রাতারাতি অনেকে নেতা হয়ে গেলেন। শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তিরা শ্রমিকনেতা, কৃষকের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তিরা কৃষকনেতা হলেন। ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার কয়েক বছর পরও ছাত্রনেতা থেকে যান। রাজনীতিতে এই অটো পাসের ব্যবস্থাটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় সামরিক শাসনামলে। রাজনীতির সঙ্গে যাঁর কখনো কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না, তিনি এক সকালে দেশবাসীর সামনে হাজির হয়ে ঘোষণা দিলেন, এখন থেকে তাঁর কথায়ই দেশ চলবে। এরপর তিনি বিভিন্ন দল থেকে কিছু নেতা ও সাবেক মন্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে, সাবেক কিছু আমলাকে যুক্ত করে নতুন সরকার গঠন করলেন। জিয়াউর রহমান এ ক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিলেও এরশাদ এক ঘোষণায় প্রধান সামরিক শাসক বনে গেলেন। জিয়া প্রথমে নিজে প্রধান সামরিক প্রশাসক না হয়ে তিন ডেপুটির একজন হয়েছিলেন, যদিও সবাই জানতেন তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ১৯৮২ সালে এরশাদ যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন, তখন দেশে দেশে সামরিক শাসনবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে। বিশ্ব সম্প্রদায়ও কোনো সেনাশাসককে গ্রহণ করতে রাজি নয়। এ অবস্থায় এরশাদ দেশের ভেতরে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে আবির্ভূত হলেও বিদেশে নিজের পরিচয় দিতেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার চেয়ারম্যান হিসেবে।

জিয়া ও এরশাদ দুজনই তাঁদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই দাবি করে ‘অপহৃত গণতন্ত্র’ পুনরুদ্ধার করে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার ওয়াদা করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা সেই ওয়াদা রাখেননি। দুজনই নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে রাজনীতিতে অটো পাসের ব্যবস্থা চালু করেন। তাঁদের প্রথম অটো পাস ছিল ‘গণভোট’। জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের আগেই ১৯৭৭ সালে ১৯ দফার পক্ষে ‘হ্যাঁ ও ‘না’ ভোট নেন। আর এরশাদ ১৮ দফার পক্ষে গণভোট নেন ১৯৮৪ সালে। তাঁরা যখন দেখলেন রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত ও নিরঙ্কুশ করতে গণভোট যথেষ্ট নয়, তখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে আরেকটি অটো পাসের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে জিয়ার ছয় মাস বয়সী বিএনপি ২০৭টি এবং ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে চার মাস বয়সী জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন পায়। এরশাদের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়, বিএনপি বর্জন করে। এরপর এরশাদ আরও একটি অটো পাসের ব্যবস্থা করেন ১৯৮৮ সালে, চতুর্থ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে; আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল তা বর্জন
করে। এরশাদ আর অটো পাসের সুযোগ পাননি। তার আগেই নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মুখে তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।

এরপর দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অটো পাস ব্যবস্থা বন্ধ ছিল। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনটি রাজনৈতিক জোট যে রূপরেখা দিয়েছিল, তার অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। তবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অন্তত চারটি নির্বাচন হয়েছে এবং পালা করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সংসদীয় রাজনীতিতে তর্ক, বিতর্ক ও প্রতিযোগিতা অব্যাহত ছিল। এরপর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০০৭ সালে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কাঁধে ভর করে বিএনপি নতুন করে যে অটো পাসের আয়োজন করেছিল, বিরোধী দলের আন্দোলন ও এক–এগারোর পটপরিবর্তনের কারণে তা সফল হয়নি। এরপর সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে স্বেচ্ছায় দৃশ্যপট থেকে সরে পড়েন।

২০১৪ ও ২০১৮ সালে দেশবাসী যে দুটি জাতীয় নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছে, তাতে ফের অটো পাস ব্যবস্থাই বহাল থাকল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাবি, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি আসেনি বলেই অটো পাস হয়েছে (১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মহাজোট প্রার্থী জয়ী)। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ সত্ত্বেও কেন অটো পাস ব্যবস্থা বহাল থাকল, সেই প্রশ্নের সদুত্তর নেই। আর উপনির্বাচনে যে মাগুরা সিনড্রোম এখনো চলছে, সাম্প্রতিক ঢাকা-৫, পাবনা-৪ আসনই তার প্রমাণ। নির্বাচনের পূর্বশর্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুস্থ প্রতিযোগিতা, যাতে ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু কে এম নূরুল হুদা কমিশন ইতিমধ্যে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের আনার বদলে তাড়ানোর ব্যবস্থাটি পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। ঢাকা-৫ আসনে ভোট পড়েছে ১০ শতাংশ।
এর আগে ঢাকা-১০-এর উপনির্বাচনে পড়েছিল ৫ শতাংশ। এ ধারা বজায় থাকলে আনুষ্ঠানিক অটো পাস হতে আর সময় লাগবে না।

কেবল নির্বাচন নয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বেও অটো পাস প্রথা মহামারি রূপ নিয়েছে। আমাদের ছোট–বড় সব রাজনৈতিক দলেই দুটি প্রবণতা জেঁকে বসেছে। একবার কেউ শীর্ষ পদে আসীন হলে সেখান থেকে স্বেচ্ছায় সরে যান না। দ্বিতীয় প্রবণতা হলো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থাকুক বা না থাকুক, শীর্ষ নেতৃত্বকে খুশি করতে পারলে যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো পদ পেতে পারেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে যে নেতৃত্বের কোন্দল, তার মূল কারণও এ অটো পাস ব্যবস্থা। আর অন্যান্য দল ধীরে ধীরে এতটাই প্রান্তিক অবস্থায় চলে গেছে যে সেই কোন্দল করার মতো লোকটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]