অথ কিঞ্চিৎ গো বৃত্তান্ত

সবকিছুরই যেমন নিজস্ব একটা ভাষা থাকে, খবরেরও তেমন আছে। সেই ভাষায় বলতে হলে, এই সময় ভারতে সবচেয়ে বেশি যেটা ‘খাচ্ছে’, তা গরু। মানে গরু নিয়ে আলোচনাই গণমাধ্যমে প্রাধান্য পাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কাগজের পাতায় পাতায় গরু-সংক্রান্ত নানা ধরনের খবর। বিস্তর আলোচনা। অজস্র কৌতুক ও অমলিন হাসি হাহা-হিহি করতে করতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ইন্টারনেট খুললেই গরু নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন নতুন সব কৌতুক। যেন বালুবোঝাই লরির ঢাকনা খুলল!

গরুর রচনার কাহিনি তো সেই কবে থেকে মোস্ট ফেমাস। ওই রচনা নিয়েও আবার কত কৌতুক। যেমন রচনা লেখার ক্লাসে একটা ছেলে একবার চার লাইন লিখে মাস্টারমশাইয়ের কাছে গিয়ে জানতে চাইল, এভাবে শুরু করলে ঠিক হবে তো? মাস্টারমশাই দেখলেন, প্রথম লাইনটায় লেখা, ‘গল্পের গরু গাছে ওঠে, আমার গরু রচনার খাতায়।’ মাস্টারমশাই ছাত্রের কান মলে বললেন, ‘হতভাগা, গরুর খুরে খাতার পাতার যে দফারফা হবে, সে খেয়াল আছে?’ ফিচকে ছেলেটা মুচকি হেসে বলে, ‘কী যে বলেন স্যার, গল্পের গরুর ভারে কখনো কোনো গাছের ডাল ভেঙেছে শুনেছেন কি?’

ভারতে ইদানীং গরু নিয়ে উল্টোপাল্টা কাজকম্মের খবরেরও বিরাম নেই। ধরপাকড়, মারধর, মৃত্যু, হুমকি—এসব খবর এত বড় দেশের কোথাও না কোথাও নিত্য লেগেই আছে। রাজস্থান হাইকোর্টের সদ্য অবসর নেওয়া বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মার দৌলতে গরুর ডিমান্ড গগনে। জীবনের শেষ রায়দানের সময় তাঁর সুপারিশ, গরুকেই জাতীয় পশু ঘোষণা করা হোক। কারণ, গরু শুধু গরুই নন, তিনি গোমাতা।

মহেশচন্দ্র শর্মা যাকে বলে একেবারে কাঁপিয়ে দিয়েছেন। গরু নিয়ে সুপারিশ তো তাঁর একটা সুপারিশ, কিন্তু ময়ূর-ময়ূরী নিয়ে তাঁর যা ‘রায়’, এককথায় তা মাখোমাখো। বলেছেন, ময়ূরী নাকি সংগম দ্বারা গর্ভবতী হয় না। ময়ূরী গর্ভবতী হয় ময়ূরের চোখের জল শুষে! মহেশচন্দ্রের ব্যাখ্যায়, ময়ূর হলো চিরকুমার! সে কারণেই নাকি ময়ূরের পালক শ্রীকৃষ্ণের মুকুটে শোভা পায়!

মহেশচন্দ্র মিডিয়ায় কীভাবে জাঁকিয়ে বসেছেন, বুঝতে পারছেন তো? কাশ্মীর টু কন্যাকুমারী তাঁর পরিচিতি। চ্যানেলে চ্যানেলে তাঁকে নিয়ে টানাটানি। তাঁর দৌলতেই ময়ূর নিয়ে কৌতুক। একটা ময়ূর অনেক দিন বাড়িছাড়া। বাড়ি ফেরার দিন কয়েক পর বুঝতে পারল ময়ূরী অন্তঃসত্ত্বা। প্রশ্ন করাতে ময়ূরী বলল, ‘বাহ্, সেদিন যে আমার বিরহে অত কাঁদলে?’ ক্ষিপ্ত ময়ূরের জবাব, ‘সে তো কুম্ভীরাশ্রু ছিল!’

এত শত কৌতুকের কপিরাইট যে কাদের কে জানে! কার মাথা থেকে যে এসব বেরোয়, সে-ও এক বিস্ময়! এই যেমন সনাতনপন্থীদের ভারতীয়ত্বে শিক্ষিত ও দীক্ষিত করার একটা ক্লাস চলছে। গরু কেন মাতা, সেই ব্যাখ্যা চলছে। মা দুধ খাইয়ে সন্তান প্রতিপালন করেন। গরুর দুধ খেয়েও আমরা বড় হই। গরু তাই গোমাতা।

একটা ছেলে জানতে চাইল, ‘মান্যবর, আমরা তো ছাগলের দুধও খাই, তাহলে ছাগলও কি মা?’ শিক্ষা ও দীক্ষাগুরুর চটজলদি জবাব, ‘ছাগলগুলো সাধারণত কুচকুচে কালো হয়। ছোটখাটো। কিন্তু বেশির ভাগ গরুই সাদা। শরীরেও অনেক বড়সর। তাই গরুই মাতা।’

উত্তর শুনে ছেলেটা একটু ভেবে জানতে চায়, এই ব্যাখ্যা বর্ণবিদ্বেষের দায়ে পড়বে কি না। দীক্ষাগুরু ভেবে বললেন, ‘ঠিক আছে। ছাগল মা হলেও হতে পারে। তবে সৎমা।’

এক স্বদেশি ও এক বিদেশির মধ্যে তুমুল তর্ক হচ্ছে। বিদেশিকে স্বদেশি বলল, ‘তোমার মা সম্বন্ধেও আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না। কারণ, আমরা গোমাতার পুজো করি।’

ইন্টারনেটে এই গল্পটাও ঘুরছে। একটা গরুকে প্রতিদিন একটু একটু করে বিষ খাওয়ানো হয়। পরের দিন তার দুধ, চোনা, রক্ত ও গোবর পরীক্ষা করে দেখা হলো কোথাও বিষের ক্রিয়া আছে কি না। টানা নব্বই দিন ধরে সেই পরীক্ষা চলল দিল্লির এইমসে। নব্বই দিন ধরে বিষক্রিয়ার কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন? না, উত্তর হলো, শিব ঠাকুরের মতো গোমাতাও নীলকণ্ঠ। জাবর কাটার সময় সব বিষ ফেনা হয়ে বেরিয়ে যায়।

মহেশচন্দ্র আমাদের জানিয়েছেন, পৃথিবীতে গরুই একমাত্র প্রাণী, যার নিশ্বাস ও প্রশ্বাস দুটি ক্ষেত্রেই অক্সিজেন ছাড়া অন্য কিছু নেই! অক্সিজেন টানে, অক্সিজেন ছাড়েও!

এটা জানার পর লেটেস্ট পোস্ট, ইন্ডিয়ান অক্সিজেন ও ব্রিটিশ অক্সিজেন শয়ে শয়ে গোশালা অধিগ্রহণের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে!

গরু নিয়ে এই ধরনের ভাবনাচিন্তা নতুন কিছু নয়। আদি অনন্তকাল ধরে এই জাতীয় গো-চিন্তা দিয়ে ভারতীয় মন ও মনন ছেয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। কিন্তু পরম পূজনীয় গোমাতার সন্তানেরা আগে কখনো রাজনৈতিক ও সামাজিক আকাশে মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো এভাবে গনগন করে ওঠেননি। ফলে দীক্ষাগুরুরাও এতটা প্রাধান্য পাননি। সমাজে মহেশচন্দ্রদের লম্ফঝম্প তাই মাত্রাছাড়া।

গরু মাতা হওয়ার ফলে আগামী দিনে ভারতে সাংস্কৃতিক সংস্কারের ছবিটা কেমন হতে চলেছে, তার কিছু সম্ভাব্য ছবিও কৌতুকের আকারে উঠে এসেছে। যেমন প্রশ্নের উত্তর দিতে না-পারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রকে মাস্টারমশাই বলতে পারবেন না, ‘গরু কোথাকার।’ সাহিত্যিক বা গল্পকার কাউকে দেখে লিখতে পারবেন না, ‘পুলিশের সামনে সে গরু চোরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল।’ কাউকে ‘গোবেচারা’ বিশেষণ দেওয়া যাবে কি না, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। কিংবা, ‘ব্যাটারা গোহারা হেরে গেল!’ মায়ের সম্মান-অসম্মানের বিষয়টা নিশ্চিত করা জাতীয় কর্তব্য! ‘বাঘ-গরুকে এক ঘাটে জল খাওয়ানোর’ উপমাও অতঃপর দেওয়া যাবে কি না, ভাবতে হবে। কেননা, বাঘ নন-ভেজিটেরিয়ান, গরু পিউর ভেজিটেরিয়ান। এক ঘাটে জল খেলে ছোঁয়াছুঁয়ির জন্য গোমাতার জাত যাবে! ঘাসে মুখ দিয়ে চলার উপমাও দেওয়া যাবে কি না, সন্দেহ।

মহেশ-উবাচর পর এক ছাত্র সরাসরি মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘স্যার, গরু মা হলে বাছুর ও বলদকে কী বলে ডাকব?’ উত্তর জানাটা জরুরি নয়। কেননা, উত্তরটা আসেনি। তার চেয়ে বরং বাজারে ঘোরা এই স্কুপ নিউজটা শুনুন। ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রকে আসা নতুন প্রস্তাব নিয়ে ক্যাবিনেটে শিগগিরই আলোচনা হবে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অশোক স্তম্ভে তিন সিংহের মুণ্ডু বদলে তিন শিং-বিশিষ্ট গো-মুখ রাখা হোক! অন্য একটা প্রস্তাব গেছে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক ও রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে। কারেন্সি নোটের একদিকে জাতির জনকের ছবি যেমন রয়েছে তেমনই থাকুক, অন্য দিকে জাতির জননীর ছবি ছাপা হোক।

কৌতুকের পর এবার এক সত্য ঘটনা শোনাই। একটাই অনুরোধ, মন্ত্রী মশাইয়ের পরিচয় জানতে চেয়ে চাপাচাপি করবেন না।

দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে কমনওয়েলথ দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের সম্মেলন। ভারত থেকে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি। সঙ্গে মন্ত্রী-আমলাদের এক বড়সড় প্রতিনিধিদল। ডারবান ছবির মতো শহর। কিন্তু বড়ই অপরাধপ্রবণ। আমাদের তাই পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছিল একা একা যেন ঘোরাঘুরি না করি।

চার দিনের সফরে এক সন্ধ্যায় এক মন্ত্রীর সঙ্গে (মোদি মন্ত্রিসভায় তাঁর ক্ষমতা এখন বেশ) আমরা তিন সাংবাদিক এক বিশাল রেস্তোরাঁয় নৈশভোজে গিয়েছি। মন্ত্রী সেখানে গিয়ে আমাদের বললেন, এদের বিফ স্টেক হচ্ছে বেস্ট। ওটা না খেলে ডারবানে আসাই বৃথা।

শুনে কিঞ্চিৎ বিস্মিত আমি তাঁকে বলি, বিজেপি নেতা এবং বিফ স্টেক?

মন্ত্রী মশাইয়ের জবাব, এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? শি ইজ নট মাদার কাউ!

এবার যে কাহিনিটা বলব, সেটাও গরু-সংক্রান্ত। নির্ভেজাল মাদার কাউয়ের।

কাহিনিটা ২০০২ সালের মাঝামাঝির, লোকসভার সদস্য রাধিকারঞ্জন প্রামাণিক ও তাঁর দল সিপিএমের মধ্যে দূরত্বটা ক্রমেই
বেড়ে চলেছে। রাধিকারঞ্জন দল ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত মোটামুটি নিয়ে ফেলেছেন।

সেই সময় একবার রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি থেকে কলকাতা আসার সময় রাধিকারঞ্জন বাবুর সঙ্গে গল্প করতে করতে রাত কাবার হয়েছিল। আলোচনার মূল বিষয় ছিল দলের সঙ্গে রাধিকারঞ্জন বাবুর বনিবনা না হওয়া।

গভীর রাতে তিনি আমায় গরু-সংক্রান্ত এই প্রশ্নটি করেছিলেন।

‘পৃথিবীর কোনো প্রাণীর বিষ্ঠা কোনো কাজে আসে না। সব বিষ্ঠাই দুর্গন্ধময়। মানুষের তো বটেই। শুধু গোবর আলাদা। তার গন্ধ আছে কিন্তু তা দুর্গন্ধ নয়। গোবর দিয়ে ঘুঁটে হয়। গরিবের জ্বালানি। তা ছাড়া গোবর অ্যান্টিসেপটিকের কাজ করে। গ্রামে-গঞ্জে মাটির দাওয়ায় গোবর লেপা হয়। কী করে এটা সম্ভব?’

উত্তরটাও রাধিকারঞ্জন বাবুই দিয়েছিলেন। ‘এটা আমারও বিস্ময়! আমার কাছে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। আছে এক পৌরাণিক ব্যাখ্যা। গরুর আনুগত্য পরীক্ষা করতে মা লক্ষ্মী তাঁর কাছে এসে শরীরের কোনো একটা অংশে বসবাসের আরজি জানান। গরু তা প্রত্যাখ্যান করে বলে, তার সবকিছুই শ্রীকৃষ্ণকে সঁপে দেওয়া। শিং, খুর, লেজ কোথাও তিলমাত্র স্থান খালি নেই। মা লক্ষ্মী তখন জানতে চান, গুহ্য? গুহ্যও কি শ্রীকৃষ্ণকে সঁপা? গরু মাথা নাড়ে। ওই অপবিত্র স্থান তো নিবেদিত নয়! মা লক্ষ্মী তখন বলেন, ওখানেই আমায় থাকতে দাও। তোমার শরীরের ওই অপবিত্র স্থানই হোক আমার অধিষ্ঠান।’

‘সে জন্যই গোবর দুর্গন্ধময় নয়! সে জন্যই গোবর জ্বালানি? সব মা লক্ষ্মীর কৃপা?’

রাধিকারঞ্জন প্রামাণিক ঠোঁট উল্টে বলেছিলেন, ‘কী জানি? আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। অথচ এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আজও আমার জানা নেই।’

কৌতুক অন্তহীন। এইটা দিয়ে শেষ করি। একটা ছবি। সাঁজোয়া গাড়ি চেপে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢুকছে। কনভয়ের একেবারে সামনে জিপের বনেটের ওপর একটা গরু বাঁধা। ঠিক যেভাবে কাশ্মীরে ফারুক আহমেদ দার নামে এক কাশ্মীরি যুবককে ঢাল হিসেবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে বিপদ ও বিপর্যয় এড়িয়েছিলেন ভারতীয় মেজর লিটুল গগৈ। হোয়াটসঅ্যাপে ঘোরা ছবিটায় ক্যাপশন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নতুন কৌশল।’

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি