অনন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আদর্শ শিক্ষক

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। ছবি: আবদুস সালাম
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। ছবি: আবদুস সালাম

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকতার পাশাপাশি গবষেণায় সংশ্লিষ্ট থাকেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অবশ্যই একজন গবেষকও হবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ শুধু একজন আদর্শ শিক্ষক ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষকই নন; তিনি বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন ও গবেষণায় আগ্রহী পরের প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত থেকেও তাঁর আন্তরিক ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন, পাঠদান ও গঠনে যে কয়েকজন প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের অবদান স্মরণীয়; তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এককথায় বললে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাঁর মূল অবদান হলো সুনির্দিষ্ট গবেষণাপদ্ধতি ও তত্ত্ব অনুসরণ করে বিভিন্ন ইস্যুতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় বিস্তৃত পরিসরে গবেষণা করা ও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছা। রাজনীতি, বিজ্ঞান অধ্যয়নের বিস্তৃত পরিধির বিভিন্ন ক্ষেত্রে, একাডেমিক ডিসকোর্সে স্বীকৃত লেখনীর মাধ্যমে তিনি অনন্য অনুরণন সৃষ্টি করতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘১৪০০ সাল’ কবিতার পঙ্‌ক্তি ধার করে বলা যায়, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সৃষ্ট এই অনুরণন ‘অনুরাগে সিক্ত’ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তরুণ অধ্যয়নকারীদের উজ্জীবিত করতে পেরেছে; যা ‘শতবর্ষ’ পেরিয়েও বেঁচে থাকবে।

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের নিকট স্মরণীয় হয়ে আছেন। শ্রেণিকক্ষে যাঁরা সরাসরি উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের নিকট থেকে শুনেছি যে স্যার অসাধারণভাবে গুছিয়ে কথা বলতেন। তাঁর বক্তব্য সাবলীল ছিল। আলোচনায় ছিলেন উদার ও নিরপেক্ষ। একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক হিসেবে তিনি শ্রেণিকক্ষে সঠিক সময়ে প্রবেশ করতেন এবং বিষয়ভিক্তিক বক্তব্য দিতেন। আমাদের এই প্রজন্ম সরাসরি শ্রেণিকক্ষে তাঁর ছাত্র হতে না পারলেও বিভিন্ন সময় আলাপচারিতায় দেখেছি, তিনি বিষয়ের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখে শ্রোতাকে সম্পৃক্ত করে কথা বলতেন। তাঁর শব্দচয়ন ও বাচনভঙ্গি উল্লেখ করার মতো। কঠিন বিষয়কে তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়ে গল্পাকারে ব্যাখ্যা করতেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার একবার সৌভাগ্য হয়েছিল গণতন্ত্রের ওপর স্যারের তত্ত্বাবধানে কাজ করার। তিনি আমার লেখা পড়ে আমাকে সুমিষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন, তত্ত্বকে কীভাবে বাস্তব ইস্যুতে ব্যাখ্যা করা যায়। যেখানে তত্ত্ব থাকবে বাস্তবতার আড়ালে।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দেওয়ার কর্তৃত্বও তাঁর ছিল। এর একটি প্রধান কারণ হলো পদ্ধতিগতভাবে গবেষণার বেলায় তাঁর দক্ষতা। বিশ্ববিখ্যাত কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইডি ডিগ্রি অর্জন করতে গিয়ে পশ্চিমা ধাঁচের একাডেমিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি হয়তো পদ্ধতিগত গবেষণার ক্ষেত্রে এ দক্ষতা অর্জন করেছেন। তাঁর গ্রন্থ বা প্রবন্ধ অধ্যয়ন করলে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে গবেষণায় সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন রয়েছে এবং পদ্ধতিগতভাবেই গবেষণা করে তিনি সেই প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর দিচ্ছেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রয়োগের একটি সংকট ছিল, যা তিনি পূরণ করার চেষ্টা করেছেন।

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন গবেষক। গুগল স্কলার পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ৩৭৩ বার তাঁকে বিভিন্ন গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণায় তাঁর আগ্রহের বিষয়গুলো ছিল আমলাতান্ত্রিক এলিট, বাংলাদেশে ইসলাম, সামরিক শাসন ও গণতন্ত্র, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা ও ভারতের ভূমিকা, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রশাসন ও কৌশল এবং বাংলাদেশে সমাজ ও রাজনীতি। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক রচিত অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে। এশিয়ান সার্ভে, ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সায়েন্স রিভিউ, ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য গবেষকদের থেকে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এ কারণে ব্যতিক্রম যে তিনি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষায়ও অনেক গ্রন্থ ও নিবন্ধ লিখেছেন। বাংলায় লিখিত তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো সমকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আমার দেশ, গণতন্ত্রের শত্রু মিত্র, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা, আধুনিক রাষ্ট্র, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রবন্ধ।

অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ রচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো ‘ব্যুরোক্রেটিক এলিটস ইন সেগমেন্টেড ইকোনমিক গ্রোথ: পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ’ (Bureaucratic elites in Segmented Economic Growth: Pakistan and Bangladesh)। এ গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, পাকিস্তানে আমলাতান্ত্রিক এলিট কর্তৃক গৃহীত উন্নয়নের কৌশল কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক সুবিধাভোগী শ্রেণির কাজে এসেছে। গণতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীর স্বার্থের বিষয়ে গবেষণায়ও তাঁর ব্যাপক আগ্রহ ছিল। তিনি তাঁর মিলিটারি রুল অ্যান্ড দ্য মিথ অব ডেমোক্রেসি (Military Rule and the Myth of Democracy) গ্রন্থে বলেছেন, ‘যে সকল দেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল ও অস্থিতিশীল এবং দৈনন্দিন প্রশাসন পরিচালনায় রাজনৈতিক এলিটদের সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয়; সে সকল দেশে সামরিক বাহিনীর করপোরেট স্বার্থ নষ্ট করে রাজনৈতিক এলিটগণ সাধারণত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে পারে না।’

সার্ককে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার সংহতির বিষয়েও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। সার্ক: সিডস অব হারমনি (SAARC: Seeds of Harmony) হলো এ প্রসঙ্গে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন যে একটি কার্যকর সার্ক দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থেই প্রয়োজন, যা এই অঞ্চলের ছোট-বড় সব রাষ্ট্রের জন্য অর্থবহ সভার একটি ফোরাম হিসেবে কাজ করবে। উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ছয় দফা কর্মসূচি ও এর শ্রেণি ভিত্তি এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর এসব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি অধ্যয়নের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে এবং রাজনীতিচর্চা সমৃদ্ধ হয়েছে। ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা’ এবং ‘তুলনামূলক রাজনীতি: রাজনৈতিক বিশ্লেষণ’ নামে বাংলায় লিখিত তাঁর গ্রন্থ দুটি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রথমিক ধারণা সুস্পষ্টকরণে বিশেষ অবদান রাখছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাঁর গবেষণার সব ইস্যুই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গবেষণার কাজে বিশেষ অবদান রাখবে। বিশেষ করে বাংলা ভাষায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের যে পরিধি তিনি বিস্তৃত করেছেন, তা তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে।

গণবুদ্ধিজীবী হিসেবেও তাঁর অবদান শীর্ষস্থানীয়। সমসাময়িক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক ও মাসিক সাময়িকীগুলোতে লিখতেন। অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রদান করতেন। লেখালেখি ও সাক্ষাৎকারে তিনি সমকালীন বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিতেন। সত্যিই বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিবার তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক হারাল।

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ যখনই কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব পেয়েছেন, তা দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন এবং সফল হয়েছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের উপ-উপাচার্য ও পরবর্তী সময়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। গবেষণা ও কর্মক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত হয়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।

ব্যক্তিজীবনে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সদালাপী ও মিষ্টভাষী। তিনি অল্প সময়েই সবাইকে কাছে টেনে নিতে পারতেন। প্রথম পরিচয়েই তাঁর মধ্যে আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। সরাসরি রাজনৈতিক দলের কর্মী না হলেও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি রাজনৈতিক মতামত প্রদানে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। জন্মের সঙ্গে মৃত্যু অনিবার্য। অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ মৃত্যুবরণ করলেও সামাজিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষকদের মধ্যে তিনি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়