অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিপাকে

জর্জ সান্তায়ানার একটি বহুল উচ্চারিত উক্তি—যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, তাদেরকে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মাশুল গুনতে হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর বহু দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। এর মূল কারণ, স্টিভ এরিকসনের মতে, ইতিহাসের অন্যতম শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে মানুষ সাধারণত শিক্ষা নেয় না, এর পরিণতি যত অনাকাঙ্ক্ষিত এবং মূল্য যত উচ্চই হোক। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসেও এর ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। এর একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হলো সুষ্ঠু নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার-সম্পর্কিত মতবিরোধকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রধান দুটি দল-আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অব্যাহত ডিগবাজির অবস্থান।

এটা অনেকেরই মনে থাকার কথা যে নব্বইয়ের দশকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি প্রবল গণ-আন্দোলন পরিচালিত হয়, যে আন্দোলনে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীও যুক্ত ছিল। রাজপথের সেই আন্দোলনের সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়ার অনমনীয় অবস্থান ছিল: পরবর্তী নির্বাচন বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোতেই হবে, যে কাঠামোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান নেই। মূলত নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আমাদের প্রধান দুটি দলের মধ্যে সৃষ্ট এ বিরোধ কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতিনিধি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেনও মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিরসন করতে পারেননি।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ আবার ভয়াবহ রূপ ধারণ করে ২০০৪ সালের পর, যখন বিএনপি-জামায়াত সরকার সংসদে তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে তাদের পছন্দের বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার উদ্যোগ নেয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংবিধানের এমন পরিবর্তন আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটের শরিকেরা মেনে নেয়নি; বরং রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে তারা তা প্রতিহত করার চেষ্টা করে। সেই আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অবস্থান ছিল আবারও সাংবিধানিক বিধানের প্রতি অনমনীয়তা। এরপর বিচারপতি হাসান, যিনি একজন অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি, নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেন এবং ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সংবিধানে নির্ধারিত পদক্ষেপগুলো উপেক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট পরিচালিত রাজপথের আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। তখনো খালেদা জিয়ার অনড় অবস্থান ছিল-সংবিধান অনুযায়ী পূর্বঘোষিত সংসদ নির্বাচন ২২ জানুয়ারি ২০০৭ তারিখেই অনুষ্ঠিত হবে।

পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট একইভাবে সংসদে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও উচ্চ আদালতের একটি সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত আদেশকে কাজে লাগিয়ে, ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে, যে সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই বাতিল করা হয়। প্রসঙ্গত, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কোনোভাবেই ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’ (অনুচ্ছেদ ৭) ছিল না। এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান ছিল-সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং তা থেকে তিনি একচুলও নড়বেন না।

এটি সুস্পষ্ট যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আমাদের প্রধান দুটি দলের মধ্যে একটি প্রবল মতবিরোধ দীর্ঘদিন থেকে বিরাজমান, যা নির্বাচনের সময় বারবারই একটি চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতির একটি উদ্ভট দিক হলো যে দল দুটির অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে, তারা ক্ষমতায় আছে কি নেই, তার ওপর। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা সংবিধানের বাইরে কিছুই ভাবতে সম্পূর্ণ নারাজ ছিল, কিন্তু বিরোধী দলে থাকার সময় তাদের অবস্থানের আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবল সমর্থক হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের আচরণও ছিল বস্তুত একই রকমের। এ ছাড়া ‘মেজরেটারিয়ানিজম’-যাকে জেমস মেডিসন ‘টিরানি অব দ্য মেজরিটি’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন-ব্যবহার করে উভয় দলই নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধার জন্য অন্যায্যভাবে সংবিধান সংশোধন করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। অর্থাৎ উভয় দলই ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তির অনুঘটক।

অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রবল স্বার্থসংশ্লিষ্ট মতবিরোধ এবং তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার পরিণতি মোটেই মঙ্গলকর ছিল না। বিএনপির সংবিধান নিয়ে অনমনীয়তার কারণে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একটি একতরফা, বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শুধু তা-ই নয়, তাদেরকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান সংবিধানে যুক্ত করে ১১ দিনের মধ্যে ষষ্ঠ সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হয়। এরপর নবম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০০৬-০৭ সালেও অনেক অপ্রত্যাশিত ও বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল এক-এগারোর মাধ্যমে ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে ঘটিত পক্ষপাতদুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতাচ্যুতি, ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ, দুই নেত্রীসহ অনেককে জেলে প্রেরণ, সর্বোপরি ২২ জানুয়ারি ২০০৭-এ অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচন স্থগিত।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিরোধের কারণে আমাদের সর্বশেষ অভিজ্ঞতাও ইতিবাচক নয়, যা প্রতিভাত হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আবারও একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং ১৫৩ জন দশম সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হন এবং নির্বাচনের আগে ও পরে ব্যাপক সহিংসতার সৃষ্টি হয়। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে।

এটি সুস্পষ্ট যে নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে অব্যাহত ও নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত মতবিরোধের কারণে নির্বাচনের সময়ে যে অস্থিতিশীলতা এবং অনেক ক্ষেত্রে যে সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছিল, তার পরিণতি ছিল অস্বাভাবিকতা। বস্তুত আমরা দেখছি যে বারবার একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, কারণ আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করিনি।

আমাদের সামনে আরেকটি নির্বাচন আসন্ন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার জোটের শরিকদের পক্ষ থেকে বিদ্যমান সাংবিধানিক বিধানের আলোকেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনড় অবস্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। সংবিধানকেই এ ক্ষেত্রে একমাত্র যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। আমরা লক্ষ করছি, সংবিধানের প্রতি অনেকের অন্ধত্ব অযৌক্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অন্যদিকে বিএনপি ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের দাবি না তুললেও অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনকালীন বা এ ধরনের সহায়ক সরকারের দাবিতে এখনো অনড় রয়েছে। শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াতে পারে তা এখনো পরিষ্কার নয়। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনীতিতে একধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

বর্তমান পরিস্থিতি এবং অতীতের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে আগামী নির্বাচন নিয়ে খুব আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। বরং বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা আমলে নিলে সামনে একটি অনিশ্চিত ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির আশঙ্কাই জোরালো হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের দণ্ডপ্রাপ্তির ফলে তিনি আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কি পারবেন না, সেই প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। বস্তুত আগামী নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে বিরাজমান অনিশ্চয়তার মধ্যে খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়ার ঘটনা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে, তা বিবেচনায় নিলে আগামী নির্বাচনটিকে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করার কোনো বিকল্প নেই।

সামনে আরেকটি একতরফা ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমাদের গণতন্ত্রের জন্য বিপর্যয়কর হবে। এ ধরনের বিপর্যয় এড়ানোর পথ হচ্ছে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছা। গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতায় থাকা বা রদবদলের পথ রুদ্ধ হলে যে অশান্তির পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)