অনুমতিহীন হাসপাতাল কবে বন্ধ হবে

আমরা লক্ষ করেছি, খুব বড় বড় সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে টাস্কফোর্স গঠিত হয়। ওই সব টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য করা হয় উচ্চ পদাধিকারী কর্মকর্তাদের। কিন্তু টাস্কফোর্সের টাস্ক বা কাজ কী কী এবং তাদের ফোর্স বা জোর কতটা, তা বোঝার উপায় নেই। একটা টাস্কফোর্স কোনো একটা ব্যবস্থার যদি উন্নতি ঘটাতে বা পরিবর্তন আনতে না পারে, তাহলে তা গঠন করা আর না করা একই কথা। যদি শুধু কিছু উপদেশ দেওয়ার মধ্যেই টাস্কফোর্সের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে জবরদস্ত একটি কমিটি করাও অর্থহীন। সাধারণ বুদ্ধিতে বোঝা যায়, একটি টাস্কফোর্সের কমিটি আর পাড়ার কোনো ক্লাবের কমিটি এক জিনিস নয়।

স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-অব্যবস্থা দূর করতে সরকার গঠন করেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের টাস্কফোর্স কমিটি। সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে যেসব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার লাইসেন্স ছাড়া চলছে এবং এখনো আবেদন করেনি, তাদের কার্যক্রম ও লাইসেন্স না দেওয়ার সুপারিশ করেছিল টাস্কফোর্স কমিটি। ‘একই সঙ্গে টাস্কফোর্স লাইসেন্স ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শনে ও অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছে।’ [প্রথম আলো, ২১ নভেম্বর ২০২০]

দেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১১ হাজার ৯৪০টি। এগুলোর মধ্যে ৯ হাজার ২৪টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স রয়েছে অথবা লাইসেন্সের জন্য আবেদন বা নবায়ন করা হয়েছে। লাইসেন্স ফি বাবদ এ বছর সরকার আয় করেছে আড়াই শ কোটি টাকা। এখনো লাইসেন্স ছাড়া চলছে ২ হাজার ৯১৬টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক।

যেকোনো সাধারণ নাগরিকও প্রশ্ন করতে পারেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র ছাড়া কেউ হাসপাতাল বা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করতে পারেন কি না। সেই হাসপাতাল বা ক্লিনিক যদি সর্বোত্তম চিকিৎসা দেয়, তাহলেও তা তাঁরা পারেন কি না। আরেকটি প্রশ্ন, টাস্কফোর্স বলল বলে লাইসেন্সের জন্য তাদের তাগাদা দিতে হবে, তা না হলে যেভাবে ফ্রি স্টাইলে চলছিল সেভাবেই চলবে, এটা কোনো রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে কি না।

টাস্কফোর্সের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। টাস্কফোর্স যদি তিন-চার মাসে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অনিয়ম-অব্যবস্থা, বেআইনি কাজকর্ম ইত্যাদি দূর করার জন্য কিছু ব্যবস্থা না করতে পারে, তাহলে বলতে হবে টাস্কফোর্স ব্যর্থ। অন্যদিকে টাস্কফোর্সের সুপারিশমতো স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থা যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দূর না করতে পারে, তাহলে সে ব্যর্থতার দায় তো সরকারের।

সারা দেশে যে ব্যক্তিমালিকানায় হাজার হাজার হাসপাতাল ও ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা নজরদারি করার দায়িত্ব কার? জেলা-উপজেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি কে? ব্রিটিশ আমল থেকেই প্রতি জেলায় সিভিল সার্জনের পদটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে ছিল ১৯ জেলায় ১৯ জন সিভিল সার্জন। এখন জেলার সংখ্যা বাড়ায় সিভিল সার্জনের সংখ্যাও বেড়েছে। তাঁর অফিসের স্টাফের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু তাঁদের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের কতটুকু দৃষ্টিগ্রাহ্য? ডিসি, এসপি ও জেলা জজকে চিনলেও সিভিল সার্জন সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ অবহিত নয়।

সবকিছুর প্রভু এখন রাজনীতি। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মালিকদের প্রায় সবাই রাজনীতির প্রভু। সিভিল সার্জন একজন সরকারি কর্মকর্তা। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁকে ঘরসংসার করতে হয়। তিনি প্রভুদের বিরাগভাজন হয়ে নিরুপদ্রবে অফিস করবেন—এই বঙ্গভূমিতে তা দুরাশা। লাইসেন্স ছাড়া হাসপাতাল খুলে ভুল চিকিৎসায় মানুষ মারার অভিযোগে তিনি বেশি তেড়িবেড়ি করলে সোজা বান্দরবান বা ওএসডি।

দেশের স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কে মানুষ যা জানত না, করোনা মহামারিতে সে বিষয়ে কিছু কিছু জানার সুযোগ হয়েছে। একটি দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল গিজগিজ করছে, কিন্তু হাই ফ্লো অক্সিজেনের ব্যবস্থায় বিরাট ঘাটতি টের পাওয়া গেল। বিপুল টাকা ব্যয়ে সরকারি ক্যানসার হাসপাতালের তিনটি মেশিন কেনার পর তা আর খোলাই হলো না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার খোঁজও রাখল না। সংবাদমাধ্যম রিপোর্ট করল এবং উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রায় দিলেন। ইতিমধ্যে উপযুক্ত ও উন্নত চিকিৎসা ছাড়াই অনেক রোগী পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। কর্তব্যে অবহেলার জন্য দায়ী পাঁচজন ডাক্তারের তিনজন অবসরে গেলেন। তাঁদের জরিমানা করেছেন হাইকোর্ট। দুজনের ভাগ্য নির্ভর করছে তাঁরা কোন দলের রাজনীতির সৈনিক, তার ওপর।

আপনি আচরি ধর্ম অন্যকে শেখালে ভালো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি সরকারি হাসপাতালকে অব্যবস্থা ও দুর্নীতিমুক্ত রাখে, তাহলে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক যা খুশি তাই করার সাহস পাবে না।

বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে শুধু সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রোগীর চাপ সামলাতে পারবে না। এখানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে একটি চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল একটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। তারা ভারত, থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য রাখে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে যদি তারা আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা পায়, তাহলে কেন তারা বিদেশে যাবে? তার ফলে দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে যাবে।

সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে দালালের দৌরাত্ম্যে নিম্ন আয়ের মানুষ চিকিৎসাসেবা পেতে বিড়ম্বনায় পড়ে। ভুঁইফোড় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে টাকার শ্রাদ্ধ তো আছেই, চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসায় অল্পস্বল্প অসুস্থ মানুষেরও ঘটে অপমৃত্যু। অপচিকিৎসা জেলা-উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতেও হয়। গত সেপ্টেম্বরে আমার এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি অসুস্থতা বোধ করায় এক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। স্বাস্থ্যকর্মী তাঁর ব্লাড সুগার মেপে বলেন ৩২ এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে কিছু একটা চিকিৎসা দেন এবং ওই সময় ডাক্তার এসে মেপে দেখেন, তাঁর ব্লাড সুগার ছিল ৩ দশমিক ২, কিছুক্ষণের মধ্যে রোগী মারা যান। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অনভিজ্ঞ আয়া ডেলিভারি করাতে গিয়ে প্রসূতি বা সন্তানকে মেরে ফেলছেন। ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে ওয়ার্ডবয় অপারেশন করেন। গ্রামগঞ্জের হাসপাতালেও গর্ভপাত, সিজারিয়ান, জরায়ু অপসারণ হচ্ছে। অধিকাংশ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট প্রভৃতি নেই। যে কেউ চাইলে একটা বটগাছের নিচে ছাপরায় ওষুধের দোকান খুলতে পারে। দুই বছর আগের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ থাকবে তার দোকানে। অ্যান্টিবায়োটিক তো অবশ্যই থাকবে। এসব দেখার জন্য কি কোনো টাস্কফোর্সের সুপারিশের অপেক্ষা করতে হবে?

স্বাস্থ্য খাত ও চিকিৎসাসেবায় যে অব্যবস্থার জট বেঁধেছে, তা খুলতে বাস্তবসম্মত ও কার্যসিদ্ধিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জগতে সব ক্ষেত্রে আপস ও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি সমর্থনযোগ্য নয়। যেখানে জীবন–মৃত্যুর প্রশ্ন, সেখানে নমনীয়তা নয়, কঠোর হতেই হবে। মানহীন প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক কোনো তদবিরেই চলতে দেওয়া যাবে না। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে কয়েকটি ক্যাটাগরি বা শ্রেণিতে ভাগ করে প্রতিটির জন্য আলাদা যৌক্তিক ফি নির্ধারণ করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং বেসরকারি হাসপাতাল শিল্পের পরিচালকদের সমন্বয়ে একটি সুষম জাতীয় স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক