অন্তর্দলীয় ও আন্তদলীয় কলহের কদর্যতা

উপমহাদেশে একেবারে প্রথম থেকেই সব রাজনৈতিক দলের ভেতরে অন্তর্দলীয় কোন্দল ছিল, আন্তদলীয় বিবাদ তো ছিলই। অন্তর্দলীয় কোন্দল কংগ্রেসে ছিল, মুসলিম লীগে ছিল, কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিল এবং ব্রিটিশ-পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতেও ছিল। তবে সেই অন্তর্দলীয় কলহ এবং আন্তদলীয় বিবাদ এখনকার মতো এত প্রকট ও কদর্য ছিল না।

বাংলাদেশে রাজনীতি বলতে যা বোঝায়, তা অনেক আগেই শিকেয় উঠেছে। দলের সাইনবোর্ড আছে, কার্যালয় আছে, সব স্তরে প্রচুর নেতা আছেন আর তাঁদের সঙ্গী হিসেবে আছেন অগণিত মোটরসাইকেল আরোহী নওজোয়ান। যেকোনো শ্রমসাধ্য জীবিকার চেয়ে মোসাহেবিতে উপার্জন অনেক বেশি। এ অবস্থাটাকে আমরা বলতে পারি উত্তর-আধুনিক রাজনৈতিক ধারা। যে পোস্ট-মডার্ন পলিটিকসে জনগণের সঙ্গে নেতাদের দূরতম সম্পর্কও নেই। আর যদি আদৌ সম্পর্ক থেকেই থাকে তাহলে তা আধ্যাত্মিক—বাস্তবিক নয়।

একদিন রাজনীতি ছিল জাতীয় স্বার্থরক্ষা ও জনকল্যাণমূলক উপজীবিকা। এই দুটো কাজ দল যদি সরকারে থাকে, তাহলে ভালোমতো করা যায়। সরকারে না গিয়ে বিরোধী দলে থাকলেও করা যায়। ঔপনিবেশিক আমলে উপমহাদেশের নেতারা ও তাঁদের কর্মীরা তা করেছেন। সার্বিকভাবে দেশের কিছু সমস্যা থাকে। স্থানীয়ভাবে জনগণের কিছু দাবি ও সমস্যা থাকে। জাতীয় পর্যায়ের নেতারা দেশের এবং স্থানীয় নেতারা তাঁদের এলাকার জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করেন।

বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রতিটি দলের ভিন্ন ভিন্ন নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি রয়েছে। এক দলের নীতি ও কর্মসূচির সঙ্গে অন্য দলের নীতি ও কর্মসূচি সাংঘর্ষিকও হতে পারে। তার ফলে এক দলের সঙ্গে অন্য দলের আন্তদলীয় কোন্দল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অান্তদলীয় কোন্দল কাকে বলে এবং কত প্রকার তা বাংলাদেশের মানুষ দেখে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। আন্তদলীয় কোন্দলে কত প্রাণ গেছে, কতজনের মাথা ফেটেছে, হাত থেকে কবজি বিচ্ছিন্ন হয়েছে, পায়ের রগ কাটা গেছে, নাক-কান ফেটেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে তেমন হতভাগার সংখ্যা যে হাজার হাজার, তাতে সম্ভবত দ্বিমত নেই কারও।

ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অন্তর্দলীয় ঝগড়াঝাঁটি স্থানীয় প্রশাসনের জন্য খুবই বিব্রতকর। কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ থাকাও কঠিন। কোন নেতা উচ্চপর্যায়ের নেতাদের প্রিয়ভাজন, তা সব সময় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পক্ষে আঁচ করা সম্ভব হয় না।

অন্যদিকে অন্তর্দলীয় কোন্দল সব সময় বাইরে থেকে চোখে পড়ে না। দলীয় ফোরামে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে থাকে। দলীয় কোন্দল বা ঝগড়াঝাঁটি নিচের দিকে নেতাদের মধ্যে হলে কেন্দ্রীয় নেতারা তা মিটমাট করে দিতে পারেন। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল হলে অনেক সময় কেউ কেউ দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল করেন। তেমন দৃষ্টান্ত উপমহাদেশে অনেক রয়েছে।

চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগের অন্তর্দলীয় কোন্দল আর এখনকার অন্তর্দলীয় কোন্দলের মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য বিরাট। তখন কোন্দল হতো নীতি-আদর্শ অথবা নেতৃত্ব নিয়ে; এখন ঠিকাদারি, বালুর ব্যবসা ও নানা রকম বৈষয়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিবাদ। সে বিবাদ-বিসংবাদও ঘরের ভেতরে নিশ্চুপে নয়, ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশ্য জনসমাবেশে।

ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অন্তর্দলীয় ঝগড়াঝাঁটি স্থানীয় প্রশাসনের জন্য খুবই বিব্রতকর। কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ থাকাও কঠিন। কোন নেতা উচ্চপর্যায়ের নেতাদের প্রিয়ভাজন, তা সব সময় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পক্ষে আঁচ করা সম্ভব হয় না। ওপরে লাগিয়ে দিলে বদলি বা ওএসডি হওয়া মাত্র এক হপ্তার ব্যাপার। তা ছাড়া অসম্মানের আশঙ্কা ১৫ আনা।

অন্তর্দলীয় কোন্দলের ক্ষতিকর প্রভাব এলাকার সমাজজীবনে পড়ে। জনগণও বিভক্ত হয়ে যায়। নিরপেক্ষ থাকাও বিপদ, কারণ তাতে দুপক্ষেরই বিরাগভাজন হতে হয়। বাংলাদেশের বিরোধী দলবিহীন রাজনীতিতে কয়েক বছর ধরে মফস্বলে সরকারি দলের কোন্দলের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা ভীতিকর। মল্লযুদ্ধের মঞ্চ থেকে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচা সম্ভব, কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্রের বুলেটের রেঞ্জ যে কত দূর পর্যন্ত, তা বলা যায় না।

ফরিদপুর জেলার সদরপুর-ভাঙ্গার বর্তমান ও সাবেক সাংসদের যে বিরোধ, তা পানিপথের যুদ্ধের মতো দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে তালা ঝোলানো ও তালা ভাঙার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ নেই, ঢাকার দেয়ালগুলো ভরে গেছে পোস্টারে। স্থানীয় প্রশাসনের কিছু করার নেই, কারণ কেন্দ্রীয় নেতারা নিশ্চুপ।

ফরিদপুরের চলমান কোন্দলের মধ্যেই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে অন্তর্দলীয় বিবাদ সংবাদে শিরোনাম হয়। নেতাদের বক্তব্য রাজনৈতিক যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক। একজন সাংসদ যে এলাকা থেকেই নির্বাচিত হোন না কেন, তিনি একজন জাতীয় পর্যায়ের নেতাও। তাঁর কথাবার্তা সংযত হওয়াই প্রত্যাশিত।

দেশে রাজনীতি নেই কিন্তু কোন্দল আছে। যে প্রথাগত রাজনীতি চলে আসছে এক শ বছরের বেশি ধরে, তার ধারেকাছেও নেই আজ বাংলাদেশ।

নির্বাচনী প্রচারণা সভায় মেঠো বক্তব্যে নেতারা অনেক অবান্তর কথা বলেন। সেগুলোকে মানুষ বিশেষ গুরুত্ব দেয় না, কিন্তু নির্বাচনের পরে বাগ্‌যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া প্রত্যাশিত নয়। স্থানীয় নেতাদের বিরোধ মিটমাট করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের কোনো উদ্যোগও দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার ফলেই বিভিন্ন এলাকায় অন্তর্দলীয় কলহ প্রকট ও কদর্য রূপ নিয়েছে।

বিরোধী দলগুলোর মধ্যেও আন্তদলীয় কোন্দল কম নয়। দেশে রাজনীতি নেই কিন্তু কোন্দল আছে। যে প্রথাগত রাজনীতি চলে আসছে এক শ বছরের বেশি ধরে, তার ধারেকাছেও নেই আজ বাংলাদেশ। নতুন একটি উন্নততর ধারা যে তৈরি করবে, সে সক্ষমতাও নেই রাজনীতিকদের, কেউ তার প্রয়োজনও বোধ করছেন বলে মনে হয় না। দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক তৎপরতা থাকলে বাজে ধরনের অন্তর্দলীয় ঝগড়াঝাঁটি থাকত না।

দেশে গণতন্ত্রের মাত্রা কিছুটা কম থাকলেও সেটা সহনীয়, কিন্তু নেতা-কর্মীদের খিস্তিখেউড়, পেশি প্রদর্শন অসহনীয়। অন্তর্দলীয় ঝগড়া-বিবাদ-দলাদলি যদি দলের নেতাদের নিজস্ব ব্যাপার হতো, তাহলেও বলার কিছু ছিল না। কিন্তু তার কুপ্রভাব পড়ছে সমাজের সব প্রতিষ্ঠানেও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও খেলাধুলার ক্ষেত্রেও। যত যোগ্যতরই হোন, ভিন্নমত ও ভিন্ন দলের ব্যক্তিরা সব প্রতিষ্ঠানে হয় অবাঞ্ছিত নয়তো কোণঠাসা হয়ে পড়লে সমাজের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আন্তদলীয় কোন্দল থাকবেই, কিন্তু অন্তর্দলীয় হিংসা-প্রতিহিংসা ও কোন্দলের কদর্যতা একটি সভ্য সমাজে কাম্য নয়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক