অন্য এক বব ডিলান

বব ডিলান
বব ডিলান

বব ডিলানের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে একধরনের উচ্ছ্বাস ইতিমধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মূল কারণ অবশ্যই হচ্ছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অসহায় মানুষজনের সাহায্যে রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ সংগীতজগতের অন্য বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর অংশগ্রহণ। ওই কনসার্টের বিষয়ে অনেকের সাক্ষাৎকার ও লেখা থেকে জানা যায় যে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে একেবারে শেষ দিকে তিনি তাঁর সম্মতির কথা আয়োজকদের জানিয়েছিলেন।

এর বাইরে আবার ডিলানকে নিয়ে লেখা বেশ কিছু রচনায় যে উল্লেখ পাওয়া যায় তা হলো, নিজের সংগীত ও ব্যক্তিগত জীবনের স্পর্শকাতর কিছু দিক নিয়ে একধরনের সংকট তাঁর জীবনে সেই সময়ে দেখা দিয়েছিল এবং এর ফলে বেশ কিছুদিন আগে থেকে কনসার্ট কিংবা সংগীতের আসরে গান গাওয়া তিনি বন্ধ রেখেছিলেন। জর্জ হ্যারিসনের অনুরোধে সাড়া দিতে দেরি হওয়ার কারণ সম্ভবত ছিল তাঁর সেই সময়ের মানসিক অবস্থা। তবে আমরা জানি, কনসার্ট ফর বাংলাদেশ তাঁর জন্য হয়ে উঠেছিল ক্ষণিকের বিরতির শেষে সংগীতের জগতে আবারও ফিরে আসা। এরপর থেকে তিনি আর কখনোই সংগীত থেকে অবসর নেননি এবং উত্তরোত্তর খ্যাতি ও প্রাপ্তির শীর্ষে আরোহণ অব্যাহত রেখেছেন। ফলে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের সহায়তায় সাহায্যের হাত বাড়াতে এগিয়ে আসা অন্যদিক থেকে ডিলানের জন্যও সহায়ক হয়েছিল।

তবে ডিলানকে নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের মাতামাতির যে দিকটি কিছুটা দৃষ্টিকটু ঠেকেছে, তা হলো অনেকটা একপেশেভাবে ডিলানকে দেখা, যে ডিলান হচ্ছেন ১৯৬০-এর দশকের ডিলান। কনসার্ট ফর বাংলাদেশে যে কটি গান তিনি গেয়েছিলেন, সেই সব কটি গানও ছিল ষাটের দশকের রচনা। ফলে বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষের মনে সেই ১৯৬০-এর দশকের ডিলান বিরাজমান এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর জীবন ও সংগীতে কী ঘটেছে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না।

সংগীতের দিক থেকে বলা যায়, সত্তরের দশকের শুরু থেকে ডিলান ক্রমেই তাঁর সেই আবেগময় আর মাধুর্যে ভরা ফোক এবং ব্লুস ধারা থেকে সরে গিয়ে রকের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন। সেই পথে যত তিনি এগিয়ে গেছেন, ততই যেন আমাদের কাছে অপরিচিত একজন সংগীতশিল্পী হয়ে উঠেছেন। রকসংগীত-প্রেমিকদের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেও ডিলানের সেই ব্লুস আর ফোক যুগের আবেগময় গানের ভক্তদের সঙ্গে দূরত্ব তখন থেকে তাঁর শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে সেটাই আরও বিস্তৃত হয়ে আগের ভক্তদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক গায়ক ও সংগীতকারে তাঁকে পরিণত করে। নিজের রচিত গানের কথায়ও আসে বড় রকমের পরিবর্তন, অনেক ক্ষেত্রেই যা হয়ে ওঠে অন্যান্য রকসংগীতের মতোই অর্থহীন।

কিছুটা শঙ্কা আর কিছুটা আতঙ্ক নিয়ে এ রকমও লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের কিছু কিছু ডিলানভক্ত তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে তাঁদের লেখায় এই গায়ক-সংগীতকারকে লালনের সঙ্গে তুলনা করে দেখারও চেষ্টা করেছেন। অবাক হয়ে তাই ভাবতে হয়, ডিলানের কোন সময়ের গান কিংবা জীবনের সঙ্গে লালনের মিল তাঁরা খুঁজে পেলেন? ব্যক্তিগত জীবনে ডিলান নিজের চাওয়া-পাওয়ার ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া একজন মানুষ, যা কিনা লালনের সঙ্গে যোজন যোজন দূরত্ব সহজেই তুলে ধরে। গানের বেলায়ও তা–ই। ডিলান হচ্ছেন জটিলতায় ভরা একজন গায়ক ও গীতিকার, লালনের সারল্যে ভরা জীবনের উপাখ্যানের কোনো রকম উপস্থিতি যেখানে কোথাও নেই।

তবে ডিলানকে নিয়ে মাতামাতির যে দিকটি সবচেয়ে দৃষ্টিকটু ঠেকছে, তা হলো ডিলানের রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তায় উত্থান-পতন এবং এর মধ্য দিয়ে তাঁর ক্রমেই একজন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠার দিকটি হয় ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা অজ্ঞানতাবশত এড়িয়ে যাওয়া। ষাটের দশকে ডিলানের প্রায় সব গানেই রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার উপস্থিতি ছিল খুবই বলিষ্ঠ। সেই সময়ের ডিলান নিজেও ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাধারার সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষ। তবে সত্তরের দশকের সূচনালগ্ন থেকেই বড় এক পরিবর্তন তাঁর মধ্যে লক্ষ করা যায়, যা কিনা শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে গেছে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কানাগলিতে, যেখান থেকে তিনি এখনো বের হয়ে আসতে পারেননি, কিংবা বের হয়ে আসতে চাননি।

বব ডিলানের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ এক ইহুদি পরিবারে। পরিচয়ের ইহুদি ছাপ সংগীতের জগতে প্রতিষ্ঠালাভের পথে বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে, সে রকম আশঙ্কা থেকে জীবনের শুরুতে নিজের রবার্ট জিমারম্যান নামটি তিনি ছেঁটে ফেলেন এবং রবার্টের সংক্ষিপ্ত মার্কিন সংস্করণ বব রেখে দিয়ে সেই সঙ্গে ডিলান নামটি যুক্ত করে নেন। তবে সত্তরের দশক থেকে ধর্মের বিষয়টি আবারও তাঁকে ভাবাতে শুরু করে এবং সেই সময় থেকেই ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতিমালার কট্টর সমর্থক মার্কিন ইহুদি ধর্মগুরু মেইর কাহানের সংস্পর্শে তিনি আসেন। ইহুদি ধর্মের সরাসরি ছত্রচ্ছায়ায় তাঁর ফিরে আসা অবশ্য আরও কিছুটা পরে। তবে একবার নিজের ইহুদি পরিচয়ে আত্মতৃপ্তি ভোগ করতে শুরু করার পর থেকে ক্রমেই তিনি হয়ে ওঠেন এমন কট্টর এক ইহুদি, ইসরায়েলের যাবতীয় অপকর্মের সাফাই গাইতেও যিনি পিছপা হননি।

১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান চালানোর সময় ইসরায়েলের সমর্থনে তিনি একটি গান লিখেছিলেন, যেটাকে দেখা যেতে পারে তাঁর স্খলনের সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হিসেবে। আমরা জানি, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী
সেই সময়ে লেবাননে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে বোমা বর্ষণ করে। এতে শিশু, নারীসহ অনেক শরণার্থী মারা যায়। জাতিসংঘে ইসরায়েলের সেই আচরণের নিন্দা করা হয় কঠোর ভাষায়। অথচ বব ডিলান তখন ইসরায়েলের সমর্থনে এ রকম একটি গান রচনা করেছিলেন, যেটা কিনা ইসরায়েলি বর্বরতাকে যুক্তিসংগত করে তুলেছে। ‘নেইবারহুড বুলি’ শিরোনামের সেই গানে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক সমালোচনাকেও একহাত নেওয়ার চেষ্টা ডিলান করেছেন।

বব ডিলান কিন্তু সেই অবস্থান থেকে এখনো সরে আসেননি। ফলে নোবেল পুরস্কার কমিটি কেন তাঁকে এবারের পুরস্কারের জন্য বেছে নিয়েছে, তা বোধগম্য নয়। আমরা বাংলাদেশিরা যে বব ডিলানকে এতটা সম্মান করছি, সেই বব ডিলান তো হচ্ছেন ১৯৬০-এর দশকের বব ডিলান। পরবর্তী জীবনের বব ডিলান সংগীত কিংবা সাহিত্যে তেমন কোনো অবদান রেখেছেন, তা বলা যাবে না, যদিও রকসংগীত তাঁকে এনে দিয়েছে বিত্ত আর বৈভব।

এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক যে ডিলানের এবারের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার তবে কি আবারও একটি রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনার ফল? সে রকম হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। হয়তো–বা অন্য কোনো আলোচিত সাহিত্যিককে পুরস্কৃত করে প্রভাবশালী মহলে সমালোচিত হওয়া এড়াতেই এ রকম একজনকে নোবেল কমিটির বেছে নেওয়া, যেটা তাঁর পরবর্তী জীবনের স্খলনকে সহজেই ঢেকে রাখতে সক্ষম হবে।

মনজুরুল হক: শিক্ষক  সাংবাদিক