অন্য দেশের নির্বাচন দেখাই আমাদের নিয়তি

অতি সম্প্রতি ভারতের পাঁচটি রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা। রাজ্যটি আমাদের নিকট প্রতিবেশী। অবিভক্ত বাংলার অংশ হিসেবে আমাদের একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও রয়েছে। সে রাজ্যে নির্বাচন প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল প্রায় ছয় মাস আগে। আর মাস তিন আগে শুরু হয়েছিল আনুষ্ঠানিক প্রচার–প্রচারণা। ভারত সরকারের অতি উঁচু পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ প্রায় সার্বক্ষণিক উপস্থিত ছিলেন এ প্রচার–প্রচারণায়। এতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। সাম্প্রদায়িকতার দিকে টেনে নিতে সচেষ্ট হয়েছেন কেউ কেউ।

বিপুল উৎসাহ–উদ্দীপনায় সে রাজ্যবাসী অংশ নেয় নির্বাচনটিতে। পাশাপাশি প্রতিদিনকার খবরের কাগজ কিংবা অনলাইনে ভারতীয় পত্রপত্রিকা এবং উভয় দেশের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের সচেতন জনগোষ্ঠী প্রক্রিয়াটিকে আগাগোড়াই পর্যবেক্ষণে রেখেছিল। করোনাভাইরাসের কারণে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা না হলে স্বপ্রণোদিত হয়ে আমাদের অনেকে সম্ভবত পর্যবেক্ষণেও যেতেন।

অসাম্প্রদায়িকতা ও উৎকট জাতীয়তাবাদকে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ অগ্রাহ্য করায় বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তি বোধ করছে। বাঙালির চরিত্রগত এদিকটি আবারও জোর বিকাশ ঘটায় অনুপ্রাণিত হচ্ছে এ দেশের প্রগতিশীল মানুষ। তারা দেখেছে, আঞ্চলিক নেতৃত্বে সীমিত গণ্ডিতে ভারতের পরাক্রমশালী কেন্দ্রীয় শক্তি ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে জোর চেষ্টাও পরিণতিতে বানচাল হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের বহুতর দ্বিপক্ষীয় সমস্যাদি রয়েছে ভারতের সঙ্গে। এর অনেকটাই পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক। এগুলোর আশু কোনো ইতিবাচক সুফল ঘটবে এমন আশাও কেউ করছে না। কিন্তু বন্ধুত্বের বাতাবরণ একটু জোরদার হলো বলে মনে করছেন অনেকে। তবে মূল বক্তব্যে উল্লেখ করতে হয়, আমরা সে নির্বাচনী ব্যবস্থাটির সঙ্গে মানসিকভাবে ছাড়া অন্য কোনোভাবে সম্পৃক্ত নই। নিছকই দর্শক। খেলার মাঠে দর্শকের যতটুকু ভূমিকা বা আনন্দ, ততটুকুই আমাদের।

যেমনটা দেখেছিলাম কয়েক মাস আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। সেটাও আমরা মনোনয়ন পর্ব থেকে শেষাবধি দেখে এসেছি নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ পর্যন্ত। সেখানেও উৎকট জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সচেতন মার্কিন ভোটাররা সে পথে না গিয়ে উদারনৈতিক একটি সমাজ গড়ার দিকেই মতামত দেন। রাস্তাটি মসৃণ ছিল না। বিপুল বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে। নির্বাচনপ্রক্রিয়াটি গোটা বাংলাদেশের সচেতন মানুষ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে চলছিল। এখানকার গণমাধ্যমও সেসব ব্যবস্থাদি বারবার নিয়ে এসেছে আমাদের সামনে। নির্বাচনী ব্যবস্থাটি বিভিন্ন কারণে প্রাসঙ্গিক ছিল আমাদের কাছে। সে প্রাসঙ্গিকতা উপেক্ষিতও হয়নি কোনোভাবে। রাত জেগে আমরা দেখেছি সে দেশের নির্বাচনী প্রচারণা, বিতর্ক ও ভোট গণনার প্রক্রিয়া। সে প্রক্রিয়ায় সামনে হুমকি এলে হতোদ্যম হয়েছি। কিন্তু সতর্ক মার্কিন জনগণ এবং তাদের সজীব প্রতিষ্ঠানগুলো শেষাবধি সফল করেছে নির্বাচনপ্রক্রিয়াটি। একেবারে চূড়ান্ত পর্বে মার্কিন কংগ্রেস ভবনে হামলার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছিল। সব বাধা অতিক্রম করে জয়ী হয়েছে মার্কিন জনগণ। তাদের বিজয় উল্লাসে সহযোগী হয়েছি আমরাও।

কথা থাকবে অন্য দেশের জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে এত যাঁদের উৎসাহ–উদ্দীপনা বা আগ্রহ, তাঁরা নিজ দেশের নির্বাচনে কী ভূমিকা রাখছেন। এখানে জাতীয় নির্বাচনের কথাই বলব। এ নির্বাচনে আমাদের রাষ্ট্র পরবর্তী পাঁচ বছর কাদের নেতৃত্বে কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নির্ধারিত হয়। এখানে তো আমাদের অনেক বেশি উৎসাহ হওয়া উচিত। তা কি হয়? একসময় হয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চারটি নির্বাচনকালে। কিন্তু তার আগে বা পরে? কখনো সামান্য নড়াচড়া দেখলেও প্রকৃত সক্রিয় ভূমিকায় ছিল না জনগণ।

২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে একক প্রার্থী থাকায় তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষিত হন। অধিকাংশ আসন যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিলেন না, সেখানে জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক বটে। যেগুলোতে প্রার্থী ছিলেন, তা–ও অনেক ক্ষেত্রে নামকাওয়াস্তে। সেখানেও নির্বাচনের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিল না জনগণ, এটাও জোর দিয়ে বলা চলে। এরপর ২০১৯ সালের নির্বাচনটি নির্ধারিত দিনের আগের রাতে প্রায় সব আসনে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে বহুসংখ্যক ব্যালট পেপারে সিল দিয়ে রাখার অভিযোগটিও লুকিয়ে করা হয় না। টিআইবিসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার গবেষণায় এসব অভিযোগ সামনে এসেছে। ভোটকেন্দ্রে লোক গেছেন কেউ কেউ। তাঁরা হয়তোবা দিয়েছেন ভোটও। কিন্তু ফলাফল নির্ধারণে সে ভোটের কোনো ভূমিকা ছিল না, এটা নির্দ্বিধায় বলা চলে।

শুধু এ দুটো জাতীয় নির্বাচন নয়। সততার খাতিরে বলতে হবে, এমনটা ছিল ১৯৯৬–এর ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচন। অনেকটা তাই ছিল সামরিক আইনের বাতাবরণের ক্ষমতায় আসা শাসকদের সময়কার নির্বাচনগুলো। দুটো গণভোট এবং ১৯৮৮ সালের নির্বাচনটি তো ছিল কার্যত ভোটারবিহীন। যাঁরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন, তাঁদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এসব নির্বাচনের ফলাফলে জনমতের প্রতিফলন না ঘটলে জনগণ প্রতিবাদ বিক্ষোভ করত। যুক্তিটি অমূলক নয়। তবে এক দশকের ওপর এ দেশের বিরোধী দলগুলো সরকারের অবিবেচনাপ্রসূত দমনপীড়ন আর নিজদের ভুল নীতির জন্য এখন অনেকটাই প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সুযোগ নিচ্ছে সরকারি দল। নির্বাচনের কেন্দ্রীয় চরিত্রে থেকে অপসারিত জনগণ। তারা আজ মধ্য মাঠের খেলোয়াড় থেকে গ্যালারির দর্শক। ভিন দেশের রাজনীতির প্রতি সচেতন মহলের কৌতূহল থাকবে। কিন্তু এরূপ থাকার পর দেখা গেল, নিজ দেশের জাতীয় নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি প্রায় সবাই নিরাসক্ত। এতৎসংক্রান্ত টেলিভিশন খবরেও নজর দেয় না কেউ। খবরের কাগজে শিরোনামটুকু দেখাই যথেষ্ট মনে করেন অনেকেই।

এ বিষয়গুলোর সঙ্গে ভিন্ন একটি বিষয়ে সামনে নিয়ে আসা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক নয়। বিশ্বকাপ ফুটবলে আমরা যোগ্যতা নির্ধারণী ম্যাচ থেকেই বিদায় নিই। তবে মূল খেলা শুরু হলে ফাইনাল পর্যন্ত গোটা এক মাস এ দেশে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর লাখ লাখ পতাকা উড়তে থাকে। সে পতাকার আকৃতিও অনেক সময় প্রতিযোগিতা করে বিশাল করা হয়। রাত জেগে বাজি পুড়িয়ে সেসব দেশের খেলা দেখা, জয়ী হলে মিছিল করা, মিষ্টি বিতরণসহ অনেক কিছুই চলে। ভৌগোলিক কারণে আমাদের দেশের রাতের বেলায় হওয়া খেলাগুলো দেখে দিনে অফিস কাচারি ক্ষেত্রবিশেষে ফাঁকা হয়ে যায়। কোনো ক্ষেত্রে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থকেরা সংঘর্ষও ঘটান। অথচ অনেকেই হয়তো জানেন না, দেশগুলো কোথায় আর কীই–বা তাদের সংস্কৃতি। সেসব মাঠে নেই আমাদের ফুটবল দল। অথচ উৎসাহী দর্শক হিসেবে আমরা পাড়া মাতিয়ে রাখি গোটা বিশ্বকাপ পর্বে। সেখানেও ফলাফল পূর্বনির্ধারিত মনে করলে এই উৎসাহ থাকত না।

ঠিক এমনিতর আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা। এটা ভেঙে পড়েছে বললে নির্বাচন কমিশনসহ সরকারের অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করেন। আর কমিশনকে শক্তিশালী করার অভিপ্রায়ে প্রায়শই বাড়িয়ে চলছেন জনবল। ভারতের নির্বাচন কমিশনের জনবল ৩০০ ছাড়ায়নি। এ দিয়েই সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে লাগিয়ে ভারতে বহুবিধ নির্বাচনী ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। আর আমাদের কমিশনের জনবল এর মাঝেই তাদের ১৫ গুণের কাছাকাছি গেছে। কিন্তু বিপর্যস্ত অবস্থায় দিনে দিনে অধিকতর পরিস্ফুট হচ্ছে। আমরা নিজ দেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলার মানসিকতা হারিয়ে ফেলছি। এর কোনো কিছু দেখা, শোনা বা পড়ার আছে বলে মনে করি না অনেকেই।

অথচ বিষয়টি আমাদের কাছে সর্বাধিক উৎসাহের হওয়ার কথা ছিল। অন্য দেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যাদের এত উৎসাহ, তাদের অকারণে নিজ দেশের ব্যবস্থাটি উপেক্ষা করে চলার কথা নয়। তবে মধ্য মাঠের খেলোয়াড় থেকে বাদ পড়ে দর্শক হয়ে পড়া এবং খেলার ফলাফল আগেই নিশ্চিত হওয়ায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলা অসংগত নয়। আমরা কি এ ব্যবস্থাতেই দর্শক হিসেবেই থাকতে থাকব? এখান থেকে মধ্য মাঠের খেলোয়াড় হওয়ার কোনো প্রচেষ্টা তো লক্ষণীয় হচ্ছে না।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

[email protected]