অবকাঠামো উন্নয়ন ও মানসিকতা বদলানো দরকার

কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সের বাধা তুলে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, এখন থেকে কারিগরি শিক্ষার ডিপ্লোমা কোর্সে যেকোনো বয়সের ব্যক্তি ভর্তি হতে পারবেন। এটা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রবাসী কর্মীদের একটি অংশ ভবিষ্যতে হয়তো দেশে ফিরবেন। 

বিবিএসের ২০১৯ সালের হ্যান্ডবুক অনুসারে, আমাদের প্রবাসী কর্মীদের অর্ধেকের বেশি অদক্ষ বা আধা দক্ষ। বিশ্বব্যাপী তঁাদের কাজের ক্ষেত্র ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। ফলে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। অদক্ষ কর্মীরা ভবিষ্যতে কাজ পাবেন না। তাই অদক্ষদের দক্ষ করে তুলতে এবং আধা দক্ষদের দক্ষতা বাড়াতে তাঁদের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। তবে বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ক্ষেত্রে যেন সমন্বয় থাকে, সেদিকেও নজর দিতে হবে।

প্রায় এক দশক ধরে দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং কর্মক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ২০১১ সালে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। ২০১৮ সালে গঠিত হয়েছে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে জাতীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক কোয়ালিটি ফ্রেমওয়ার্ক। এতে ছয়টি স্তরে সনদপ্রাপ্তির মান উন্নয়নের বিষয় রয়েছে। এসবের ফলে ২০১০ সালের হরেদরে ১ শতাংশ শিক্ষার্থীর বিপরীতে বর্তমানে ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থীকে কারিগরি শিক্ষায় আনা সম্ভব হয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

আমাদের দেশে সবাই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করতে আগ্রহী। কিন্তু সবার এ প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার নয়। বিবিএসের জরিপে দেখা যাচ্ছে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে কর্মহীনতার সংযোগ স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে যাঁদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তঁাদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা ৪ দশমিক ৬। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করেছেন, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের মধ্যে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণদের মধ্যে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ বেকার। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের ৪৭ শতাংশ তাঁদের বিবেচনায় শোভনীয় কাজ পান না। 

কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ অত্যন্ত অপ্রতুল। ১৯৬৬ সালে অল্প কয়টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত দেশের একমাত্র টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তির আসনসংখ্যা থেকে এখন পর্যন্ত ৩০ জনই আছে। ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অস্তিত্ব এখন আর নেই বলে মনে হয়। অথচ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা নিয়ে জোরেশোরে মাঠে নামলেই আমাদের কমপক্ষে চার লাখ শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলার জন্য শিক্ষকেরাই যদি তৈরি হতে না পারেন, তাহলে তাঁরা কীভাবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবেন। 

সম্প্রতি কারিগরি শিক্ষার গ্র্যাজুয়েটদের নতুন একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সেটি হলো ডিপ্লোমা করার পর স্নাতক কোর্সে ভর্তি হওয়া। চার বছরের ডিপ্লোমার পর আবার চার বছরের স্নাতক কোর্স শেষ করতে গিয়ে দুটি বছর চলে যায়, কিন্তু কর্মবাজারে তাঁদের খুব একটা মূল্য সংযোজন হয় না। বরং তখন তাঁদের স্নাতক ডিগ্রিধারীদের সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়।

সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে কর্মরত একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, তিনি ২০১৬ সালে ডিপ্লোমা শেষ করার পর যদি স্নাতক কোর্সে ভর্তি হতেন, তাহলে এখনো তাঁর ছাত্রত্ব শেষ হতো না। অথচ এখন তিনি বিদেশে একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। দেশে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাতে পারছেন। তাঁর সঙ্গে আলাপকালে এ বিষয়ও উঠে এসেছে যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার ও কর্মজীবনের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে অনেকেই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেন না। 

সর্বশেষ বিবিএস জরিপের তথ্যানুযায়ী আমাদের তরুণদের প্রতি চারজনের একজন না প্রশিক্ষণ, না শিক্ষা, না কর্মসংস্থানে যুক্ত। কোভিড–১৯ মহামারিতে যাঁরা কাজ হারিয়েছেন এবং হারাবেন, তাঁরাও যুক্ত হবেন তাঁদের সঙ্গে। উপরন্তু বিদেশে চাকরি হারিয়ে ফিরবেন অনেক অভিবাসী কর্মী। ফলে মহামারির পর তাঁদের কাজের জন্য আরও তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে।

প্রবাসী কর্মীদের অনেকেই উন্নত দক্ষতা নিয়ে ফিরছেন। তাঁদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রণোদনা ও সহযোগিতা দেওয়া দরকার। প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান ব্যাংকে দুই হাজার কোটি টাকা বর্তমান প্রণোদনা খাতে রাখা হয়েছে। দক্ষ কর্মীরা যেন স্ব–কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যদের জন্যও কর্মসৃজন করতে পারেন, সেদিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। 

এশিয়ার প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অনেক উন্নত দেশ জায়ান্ট চীন ও সিঙ্গাপুর নিজেদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার চমৎকার অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। পাশাপাশি এ ধরনের কাজের সামাজিক স্বীকৃতিরও ব্যবস্থা করতে পেরেছে। সে জন্য অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি সমাজে কারিগরি কাজের কর্মীদের মূল্যায়নের বিষয়টির ওপরও জোর দিতে হবে। 

ভবিষ্যতে জাতির কর্মদক্ষতা ও আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে হলে গুণগত মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতেই হবে। এটা যত তাড়াতাড়ি সবাই উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল।

মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান প্রধান