অবনী মোহন দত্ত

শহীদ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, দেবীদ্বার, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম

অবনী মোহন দত্ত

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ।

তাঁর শিক্ষাদানের মধ্যে ছিল অনাবিল আনন্দ ও নিরঙ্কুশ আন্তরিকতা। শিক্ষার্থীরা ছিলেন তাঁর সন্তানতুল্য।

প্রতিদিন তিনি সর্বধর্মের, সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য প্রার্থনা ও মঙ্গল কামনা করতেন। অধ্যাপনায় ছিলেন সফল।

ইংরেজি জানতেন। বলতেন ও লিখতেন নির্ভুল ও অসাধারণ!


এ জন্য ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষকেরাও তাঁর কাছে পাঠদানে সাহায্যের জন্য আসতেন।

তিনি হাসিমুখে ও আনন্দচিত্তে তাঁদের সাহায্য করতেন।

মৃত্যু সম্পর্কে তিনি একটা কথা বলতেন: হিন্দুধর্মাবলম্বী হিসেবে মৃত্যুর পর তাঁর দেহ দাহ করারই কথা, কিন্তু তা না করে কোনো ফলদায়ী বৃক্ষের গোড়ায় সমাহিত হলে সেই বৃক্ষ আরও কিছু দিন বাঁচার উপাদান পাবে, তাতে তাঁর জীবনের সামান্য হলেও কিছু মূল্য থাকবে।


অজাতশত্রু এই শিক্ষককে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একদল সেনা একাত্তরের ৮ মে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়।

এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাঁকে কবে, কোথায়, কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি।

দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রভূত সুযোগ ছিল তাঁর। কিন্তু দেশ রয়েছে মহাবিপদের মধ্যে। এ অবস্থায় নিজের জীবন বাঁচানো অবনী মোহন দত্ত জরুরি মনে করেননি।


অবনী মোহন দত্ত সম্পর্কে আরও জানা যায় খ্যাতনামা নাট্যকার ও অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদের ‘আমার শিক্ষক’ রচনা থেকে।

তিনি লিখেছেন, ‘অধ্যাপক অবনী মোহন দত্ত আমার স্যার। আমি তাঁর সহকর্মী হওয়ার সুযোগও পেয়েছি।

কুড়ি বছর ধরে তাঁকে জানতাম। বড় ভালো মানুষ ছিলেন। বেশি রকম ভালো।
‘আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষ সৈনিক ছিলেন না।

বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে তিনি সরাসরি কোনো কথা বলেননি। তাঁর মতো নির্বিবাদী মানুষের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনো কথা বলা সহজ ছিল না।

তখন তিনি একজন প্রবীণ মানুষ। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময় হয়ে গেছে। এই নিরীহ, নির্মল মানুষটিকে সরকারি বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। তিনি আর ফিরলেন না।

‘তাঁকে শুভাকাঙ্ক্ষীরা বারবার বলেছিল ভারতে চলে যাওয়ার জন্য। তিনি যাননি। তাঁর মতো নির্লিপ্ত মানুষকে শত্রুরা উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তিনি ভাবতেও পারেননি।


‘আমার কাছে আজও বিস্ময় হয়ে আছে—আমার প্রিয় শিক্ষক দর্শনের অধ্যাপক অবনী মোহন দত্তকে অস্বাভাবিক জীবন দিতে হলো কেন?

তিনি কখনো কারও অমঙ্গল সাধন করেননি, কারও অকল্যাণ কামনাও করেননি।

তেমন মানুষ ছিলেন না তিনি। আমার বিশ্বাস, তিনি স্বপ্নেও কারও অহিত ভাবেননি।

তাহলে এমন সরল ও নিরীহ মানুষটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানওয়ালারা হত্যা করল কেন? যদি হত্যাকারীদের ধরা হতো, তাহলে জেরার মুখে নিশ্চয় সে সত্যটি জানা যেত।


‘শিশুদের বড় ভালোবাসতেন তিনি। আমার বড় ছেলের বয়স যখন আড়াই বা তিন, তখন আমার স্যার আমাদের কলেজের বাড়িতে আসতেন।...তিনি আসতেন এক শিশুর আকর্ষণে।

আমার ছেলের সঙ্গে তাঁর অনর্গল আলাপ হতো। আমার ছেলে অবিরাম কথা বলত আর তিনি অবিশ্রান্ত ঝরনার মতো খিলখিল করে হাসতেন। প্রাণখোলা হাসিতে মাতিয়ে তুলতেন পরিবেশ।

‘তাঁর ইচ্ছার মধ্যে ছিল মহৎ জীবনদর্শন। আর তাঁর পরিণতির জন্য ছিল কিছু মানবিকতাবিরোধী অশুভ শক্তির নিষ্ঠুর আচরণ।

সেসব নিষ্ঠুর হত্যাকারী আমার শিক্ষককে কেমনভাবে হত্যা করেছে এবং আমার শিক্ষকের মরদেহ কোন বৃক্ষের নিচে আশ্রয় লাভ করেছে, তার কোনো সংবাদই উদ্ধার করতে পারিনি আমরা।

চেষ্টাও করিনি। একজন মহৎ জীবনবাদী মানুষের অন্তিমকাল কত মর্মন্তুদ ছিল, সে খবর আমাদের ইতিহাসে আর লিপিবদ্ধ হবে না।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, তৃতীয় খণ্ড, প্রকাশ ১৯৯০, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।


অবনী মোহন দত্ত ছিলেন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা শরৎচন্দ্র দত্ত ও মা স্বর্ণাকুমারী দত্ত।

তাঁরা ছিলেন কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার বাসিন্দা।

ছাত্র হিসেবে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষে রাজশাহী সরকারি কলেজে যোগ দেন।

পরে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে বদলি হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি কিছুদিন খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করেন।

শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন সুশৃঙ্খল, নিয়ন্ত্রিত ও শীর্ষ মানের। বিপুল তাঁর ছাত্রসংখ্যা। সবাই তাঁর গুণগ্রাহী। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের সব শিক্ষক তাঁকে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন।

অন্যদিকে, সব শিক্ষকের সঙ্গে তাঁরও ছিল সহজ সম্পর্ক।
অবনী মোহন দত্ত নিঃসন্তান ছিলেন।


প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (অষ্টম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৯) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।