অবৈধ নিয়োগে ৪৩টি পদ পেয়েও খুশি নয় ছাত্রলীগ

উপাচার্য এম আবদুস সোবহান তাঁর মেয়াদের শেষ দিনে ১৪১ জনকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দিয়েছেন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহান তাঁর শেষ কর্মদিবসে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়ে গেছেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে শিক্ষকদের আত্মীয়স্বজন থাকলেও বড় একটি অংশ আছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সাবেক-বর্তমান নেতা-কর্মী। তাঁরাই জানিয়েছেন এই সংখ্যা ৪৩। অনিয়মের এই নিয়োগে এতটি পদ পেয়েও খুশি নন তাঁরা। তাঁদের দাবি, বিদায়ী উপাচার্য তাঁদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাইয়েছেন অন্যদের। যোগ্যতা অনুসারে নিয়োগ পাননি, পেয়েছেন ছোট ছোট পদে।

উপাচার্যের এমন কাণ্ডের পর বৃহস্পতিবারই শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে অবৈধভাবে যেসব জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটিকে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই। অবৈধ নিয়োগ ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও জানায় মন্ত্রণালয়।

এম আবদুস সোবহান উপাচার্য হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিন বৃহস্পতিবার যে ১৪১ জনকে ‘অ্যাডহক’ (অস্থায়ী) নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৯ জন শিক্ষক, ২৩ জন কর্মকর্তা, ৮৫ জন নিম্নমান সহকারী ও ২৪ জন সহায়ক কর্মচারী রয়েছেন। তাঁদের নিয়োগ আদেশের তালিকায় ও নিয়োগপত্রে তারিখ রয়েছে ৫ মে। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার শিক্ষক-কর্মকর্তা-ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। অধ্যাপক আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে আগে থেকেই অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শেষ দিনের বিতর্ক। এর আগে আবদুস সোবহান নিয়োগের নীতিমালা শিথিল করে নিজের মেয়ে ও জামাতাকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর সরকারের নির্দেশে তদন্ত করে সত্যতাও পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

ছাত্রলীগ বলছে কাঁঠাল ভাঙা হয়েছে তাদের মাথায়

নিয়োগের তালিকা দেখে ও ছাত্রলীগের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৪১ জনের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান, সাবেকসহ আশপাশের বিভিন্ন শাখা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ৪৩ জনের নাম পাওয়া গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের অনেককেই নিয়োগ দিয়ে গেছেন আবদুস সোবহান। এরপরও শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁরা সন্তোষজনক পদে নিয়োগ পাননি বলে ক্যাম্পাসে আলোচনা চলছে। অনেক ছাত্রলীগ নেতা মনে করেন, উপাচার্য ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে অন্যদের নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ‘বিএনপি-জামায়াতের’ অনেকেই আছেন বলে তাঁদের দাবি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের বর্তমান সহসভাপতি ফারুক হোসেনকে উচ্চমান সহকারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁর দাবি, তিনি শিক্ষক হওয়ার মতো যোগ্যতা রাখেন। তিনি বলেন, উপাচার্য তাঁদের একটা নিয়োগ দিয়েছেন, এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। কিন্তু তিনি ছাত্রলীগকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেননি।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সাদিকুল ইসলাম ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করার পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তাঁকে নিম্নমান সহকারীর একটি তৃতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সাদিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপাচার্য আমাকে এই পদে চাকরি দিয়ে অপমান করেছেন। তিনি শুধু আমাকে নয়, ছাত্রলীগের একজন বাদে কাউকেই কর্মকর্তা পদে চাকরি দেননি। যাঁদের বড় পদে চাকরি দিয়েছেন, তাঁদের কাউকেই ছাত্রলীগ সেভাবে চেনে না। তাঁরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাও করেননি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়স্বজনকেই নিয়োগ দিয়েছেন।’ তিনি মনে করেন, এই নিয়োগে বড় ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়েছে। যদি তা হয়ে না থাকত, তবে উপাচার্য তাঁদের (ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী) ভালো পদে চাকরি দিতেন।

শিক্ষকদের বেশির ভাগই স্বজন

আবদুস সোবহানের শেষ কর্মদিবসে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে একজন সহযোগী অধ্যাপক, আটজন প্রভাষক, শরীরচর্চার শিক্ষক পদে দুজন এবং আবাসিক শিক্ষিকা পদে পাঁচজন রয়েছেন। তবে শিক্ষক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভাগীয় কোনো প্ল্যানিং কমিটির সভা বা কোনো ধরনের চাহিদা ছিল না বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সভাপতিরা জানিয়েছেন।

প্ল্যানিং কমিটির বিষয়ে সংগীত বিভাগের সভাপতি দীনবন্ধু পাল বলেন, তাঁরা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে কোনো ধরনের প্ল্যানিং কমিটি করেননি। তিনি শুধু শুনেছেন, তাঁর বিভাগে একজন শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন।

একই কথা বললেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. এমদাদুল হক। তিনি বলেন, তাঁরা শিক্ষক নিয়োগের জন্য কোনো প্ল্যানিং কমিটির সভা করেননি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে তাঁদের এ বিষয়ে কোনো আলাপও হয়নি। তিনি বলেন, ‘শুনেছি, একজন শিক্ষককে বিদায়ী উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে গেছেন।’

নিয়োগপত্রের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষকদের স্ত্রী, সন্তান অথবা আত্মীয়স্বজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের খন্দকার ফরহাদ হোসেনের ছেলে ঋত্বিক মাহমুদ সংগীত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। খন্দকার ফরহাদ হোসেন লেখালেখি করেন অনিক মাহমুদ নামে।

ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন মিশ্রর ছেলে ইন্দ্রনীল মিশ্র। ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক খাইরুল ইসলামের স্ত্রী সাবিহা ইয়াসমিনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেন্টার অব এক্সিলেন্স ইন টিচিং অ্যান্ড লার্নিংয়ের সহযোগী অধ্যাপক (আইটি) হিসেবে। ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মো. কামরুজ্জামানকে। তিনি ওই বিভাগের অধ্যাপক শেরেজ্জামানের আত্মীয় ও পিএইচডি ফেলো ছিলেন বলে জানা গেছে।

শিক্ষক তালিকায় এক নম্বরে থাকা তাসকিন পারভেজ ফিশারিজ বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইব্রাহিম হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মন্নুজান হলে সহকারী আবাসিক শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি দেলোয়ার হোসেনকে শরীরচর্চা শিক্ষা বিভাগে শরীরচর্চার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনিই একমাত্র ছাত্রলীগ নেতা, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এত বড় পদে নিয়োগ পেয়েছেন।

আরবি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন এম মুস্তাফিজুর রহমান নামে প্রাক্তন এক শিক্ষার্থী। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হজে গিয়েছিলেন। সেই কাফেলা দলের দলনেতা ছিলেন তিনি। সেই সূত্রে উপাচার্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগের প্রভাষক পদে মো. শাহরিয়ার মাহবুব নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি জামালপুরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদের জামাতা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি মো. নূরে আলম সিদ্দিকীর স্ত্রী। কলেজ পরিদর্শক ও অধ্যাপক আবদুল গণির স্ত্রী ফারহানা একরাম নিয়োগ পেয়েছেন তাপসী রাবেয়া হলের আবাসিক শিক্ষিকা হিসেবে। সহকারী আবাসিক শিক্ষিকা হিসেবে রহমতুন্নেছা হলে নিয়োগ পেয়েছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ হোসেন রিয়াজির স্ত্রী বুরুজ ই জোবাইরা।

বড় পদে চার সাংবাদিক

নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকায় রাজশাহীর দুজন সাংবাদিক নেতাসহ চারজন রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পেয়েছেন দৈনিক ইত্তেফাক-এর রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আনিসুজ্জামান। তিনি রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাহী সদস্যও। মোহনা টেলিভিশনের রাজশাহী ব্যুরোপ্রধান মেহেদী হাসান ঐতিহ্যবাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ পেয়েছেন। মেহেদী রাজশাহী টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। স্থানীয় উত্তরা প্রতিদিন-এর বার্তা সম্পাদক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি এনায়েত করিম এবং দৈনিক আমাদের সময়-এর রাজশাহী প্রতিনিধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একই সংগঠনের সহসভাপতি আমজাদ হোসেন সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ পেয়েছেন। এ ছাড়া সমকাল ও ডিবিসি নিউজের ব্যুরো চিফ সৌরভ হাবিবের বোনও চাকরি পেয়েছেন।

চুল কেটে, রান্না করে তাঁরাও পেলেন চাকরি

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন কাজলা এলাকার শামসুল আলম দীর্ঘ ধরে উপাচার্য আবদুস সোবহান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের চুল কাটতেন। এই শামসুল আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুয়ার্ট শাখায় নিরাপত্তাপ্রহরীর চাকরি পেয়েছেন। কাজলার ধরমপুর এলাকার আবদুস সামাদ ওরফে রাজন কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি উপাচার্যের ব্যক্তিগত ফার্নিচার বানিয়ে দিতেন। তিনি প্রকৌশল দপ্তর শাখায় কাঠমিস্ত্রি পদে চাকরি পেয়েছেন। কাজলা এলাকার ফজলুর হক নামের এক ব্যক্তি নিয়মিত উপাচার্যকে মাংস সরবরাহ করতেন। তাঁর মেয়ের চাকরি হয়েছে। তবে তাঁর মেয়ের নাম ও কোন পদে চাকরি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ ছাড়া উপাচার্যের বাড়িতে মালির কাজ করেন সাইফুল ইসলাম। তাঁর স্ত্রী মোসা. মিনু খাতুন ওই বাসভবনে রান্নাবান্না করতেন। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে আয়া পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।