অমর্ত্য সেনকে মনে করালো ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা

ছবি সংগৃহীত, ফ্রাঙ্কফুর্টের বিখ্যাত পাউল গির্জায় অমর্ত্য সেনকে শান্তি পদক প্রদান অনুষ্ঠান
সংগৃহীত

করোনা মহামারির করাল থাবায় আরও অনেক কিছুর মতো ফ্রাঙ্কফুর্টের ঐতিহ্যবাহী বইমেলা এবার জমল না। ৭১ বছর ধরে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের প্রায় কেন্দ্রে প্রতি অক্টোবরে যা হতো, এবার তা হলো না। এ বছর সারা বিশ্বের বইপ্রেমী লেখক, পাঠক, প্রকাশকদের পদচারণের দেখা মিলল না। তবে মেলা কর্তৃপক্ষ করোনাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে আয়োজন করেছিল নতুন ধরনের ডিজিটাল বইমেলার। আর এবার ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার বিখ্যাত শান্তি পুরস্কারটি পেয়েছেন উপমহাদেশের স্বনামধন্য বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদের এই শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তিতে অমর্ত্য সেনকে নিয়ে জার্মানিতে নতুন আলোচনার দরজা খুলেছে সংবাদমাধ্যমগুলো।

গ্যেটে, শিলার, লেসিং, হের্ডার, হাইনে, হাইনরিখ বোল, টমাস ম্যান বা ইদানীংকালের গুন্টার গ্রাসের দেশ জার্মানির এই বইমেলার রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্য। ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা ঘিরে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের জন্য অপেক্ষায় থাকেন সারা বিশ্বের বইপ্রেমী, প্রকাশক, বই ব্যবসায়ীরা। বইপুস্তক ঘিরে এই মেলার বিশ্ব বিখ্যাত হওয়ার পেছনে রয়েছে ৫০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস। মুদ্রিত বইয়ের আবির্ভাবের আগে, দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হস্তাক্ষরযুক্ত বই বিক্রির জায়গা ছিল ফ্রাঙ্কফুর্টের সাধারণ বাণিজ্য মেলা। ফ্রাঙ্কফুর্টের নিকটবর্তী মাইনজ শহরে মুদ্রণশিল্পের জনক ইয়োহনেস গুটেনবার্গ ছাপাশিল্প আবিষ্কার করার কয়েক দশক পর থেকেই ফ্রাঙ্কফুর্ট মুদ্রক এবং প্রকাশকদের বইগুলোর বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। জার্মানির দুই বিখ্যাত মুদ্রক ইয়েমেন ফুস্ট ও পেটার সোফার, গুটেনবার্গ ছাপাশিল্পের আইনি স্বত্ব নিয়ে ১৪৬২ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টে মুদ্রণশিল্প নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।

১৬ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বইপুস্তক ঘিরে ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবী অভিজাতদের মিলনের স্থল ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট। ইউরোপের অধ্যাপক, পণ্ডিত, আর্কাইভার এবং ধর্মযাজকেরা তাঁদের হস্তলিখিত লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশ করা বা প্রকাশক খুঁজতে কিংবা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে ফ্রাঙ্কফুর্টে একত্র হতেন। তবে সেই সময় সাধারণ মানুষের জন্য বইপত্র নাগালের বাইরে ছিল। বইকে ঘিরে ফ্রাঙ্কফুর্টের ঘরানা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ছড়াতে শুরু করল, তখন সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ান ‘তাত্ত্বিক লেখার’ বিস্তার রোধে সেন্সরশিপ আরোপ করেছিলেন। বিশেষভাবে গঠিত একটি কমিশন বইয়ের দোকানগুলো পরিদর্শন করার জন্য নিখরচায় অনুলিপি সংগ্রহ করার এবং অননুমোদিত লেখাগুলো বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত ফরাসি-হাবসবার্গ রাজন্যদের মধ্য ইউরোপের আধিপত্য নিয়ে ৩০ বছরের ধর্মযুদ্ধ ক্রমেই ফ্রাঙ্কফুর্টের বইভিত্তিক চর্চাকেন্দ্র লাইপজিগে কেন্দ্রীভূত হয়। লাইপজিগে তখন বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যচর্চা ও বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ইয়োহান সেবাস্তিয়ান বাখ প্রমুখের কারণে সাহিত্য-সংগীতের আরেক চারণভূমি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর আবারও ৩০০ বছর আগের ফ্রাঙ্কফুর্টের বইকেন্দ্রিক সংস্কৃতি ফিরে আসতে শুরু করে। ১৯৪৯ সালের ১৮-২৩ সেপ্টেম্বর ফ্রাঙ্কফুর্টের পাউল গির্জায় ২০৫ প্রকাশনার ৮৪৪টি বই প্রদর্শনের মাধ্যমে বইমেলার যাত্রা শুরু হয়।

৭১ বছর আগে শুরু ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা এখন বিশ্বের বৃহত্তম বই ও মিডিয়া মেলা। এটি কেবল আন্তর্জাতিক বই এবং মিডিয়াশিল্পের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র নয়; এখন তা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংলাপ ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও বিনিময়ের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এই বইমেলায় এখন হাজির হন প্রায় তিন লাখ মানুষ।

এ বছর করোনা মহামারি সব আয়োজন লন্ডভন্ড করে দিলেও ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ডিজিটাল বইমেলা আয়োজনের উদ্যোগ নেয়। বইমেলায় পাঠক, প্রকাশক, পুস্তক ব্যবসায়ীরা হাজির না থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভার্চ্যুয়ালি সবার সঙ্গে যোগাযোগ, ক্রয়-বিক্রয় ও মতের আদান-প্রদানের অবস্থা করে। বইমেলার পরিচালক ইয়ুর্গেন বস জানান, পৃথিবীর এই আপত্কালে আমাদের এই ভার্চ্যুয়াল বইমেলা একটি নতুন ধরনের পরীক্ষা। আর অদূর ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষণীয়। ডিজিটাল বা ভার্চ্যুয়াল বইমেলার কাঠামো প্রস্তুতিতে জার্মান সরকার ২০ লাখ ইউরো অনুদান দেয়।

এবারের এই ভার্চ্যুয়াল বইমেলা শুরু থেকেই ডিজিটাল যোগাযোগ ও সম্মেলন আকারে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই নতুন ধরনের ব্যবস্থায় ১৮৩ দেশের প্রায় ১ লাখ ৪৮ হাজার বইপ্রেমী বা বই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা অংশ নেন। বিগত বছরগুলোতে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার উদ্বোধন ও সমাপনী অনুষ্ঠানটি হতো বিখ্যাত পাউল গির্জায়। এবারও বইমেলার সমাপনী দিনে বইমেলার ঐতিহ্যবাহী শান্তি পুরস্কার পেলেন বাঙালি অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন।

শান্তি পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে বিচারকেরা বলেছেন, কয়েক দশক ধরে তিনি বিশ্বে ন্যায়বিচারের প্রশ্নে একজন পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ছেন, যা আজকের বিশ্বে আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। অমর্ত্য সেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হলো, সামাজিক সমৃদ্ধি কেবল অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রেই নয়, উন্নয়নের সুযোগগুলোর ক্ষেত্রেও, বিশেষত দুর্বলদের ক্ষেত্রেও পরিমাপ করা উচিত। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে গণতান্ত্রিক কাঠামো কীভাবে সম্পর্কিত। মানবিক বিকাশের সূচক সক্ষমতার ধারণাগুলো তিনি উপস্থাপন করেছেন।

জার্মানির পত্রপত্রিকাগুলো অমর্ত্য সেনের জীবন, তাঁর মানবধর্মী গবেষণা নিয়ে বিস্তৃত খবরও প্রকাশ করে। বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে ফ্রাঙ্কফুর্টের বিখ্যাত পাউল গির্জায় স্বল্পসংখ্যক অতিথির উপস্থিতিতে এই পুরস্কার প্রদানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রান্স ভালটার স্টাইনমায়ারের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও কোয়ারেন্টিনে থাকার কারণে তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। তবে অনুষ্ঠানে এক বিবৃতিতে অমর্ত্য সেনকে নিয়ে বলেন, ‘আমরা স্পষ্টত তাঁর বক্তব্যের পরিণাম দেখতে পাচ্ছি, সমাজে সম্পদের বিভাজন কীভাবে বিশ্বের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিচ্ছে। তাঁর কর্মগুলো একাডেমিক হলেও তিনি বিশ্বকে অর্থনীতির বাস্তব বিষয়টি বলছেন এবং পরিবর্তনের তাগাদা দিচ্ছেন।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে বসবাসরত অমর্ত্য সেন করোনাভাইরাসের কারণে ফ্রাঙ্কফুর্টের শান্তি পুরস্কার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে না পারলেও পুরো সময়জুড়ে ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি

[email protected]