অমিক্রন অস্বস্তির, তবে ভীতিকর কিছু নয়

কোভিড–১৯ ভাইরাসের নতুন ধরণ অমিক্রন নিয়ে নানা প্রশ্ন ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে
ছবি : রয়টার্স

চলতি মাসেই করোনা মহামারির দুই বছরে পূর্ণ হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রম আর উদ্যোগের কারণে আমাদের এই পৃথিবীর ইতিহাসে দ্রুততম সময়ে ঘাতক সার্স-কভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা তৈরি করা হয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এসব টিকা তাদের নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দিয়ে যখন করোনার সংক্রমণ প্রায় ঠেকিয়ে ফেলেছে, ঠিক তখনই গত ২৬ নভেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খবর দিল সার্স-কভ-২ ভাইরাসের নতুন একটি ধরনের।

সার্স-কভ-২ ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স হওয়া দুই ডজনের অধিক মিউটেশন, আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে বটে, কিন্তু তা কোনোভাবেই উৎকণ্ঠার নয়। ডব্লিউএইচও-ঘোষিত ‘অমিক্রন’ নামক ধরনটি শনাক্তের পর বিশ্বের নানা দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকেই আংশিকভাবে নির্দিষ্ট জাতির নাগরিকদের প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে। এমনকি দ্রুততম সময়ে বিশ্বনেতারা দফায় দফায় বৈঠক বসে অমিক্রন ঠেকানোর মন্ত্র খুঁজছেন। গণমাধ্যমও বিষয়টি নিয়ে এমনভাবে খবর প্রকাশ করছে, যেন এ ধরনটি ‘দানব’ হয়ে উঠেছে। বিষয়টি কি আসলেই তাই? সত্যিই কি অমিক্রন দানবীয় শক্তি নিয়ে মানবজাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে?

সত্যি কথা বলতে কি, আমরা যাঁরা করোনা নিয়ে গবেষণাগারে কাজ করছি, তাঁদের কাছে অমিক্রন কিছুটা অস্বস্তিকর, তবে ভীতিকর কিছু নয়। যতটা ভয়ের কারণ পূর্ববর্তী ধরনগুলো দেখিয়েছে, তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী সংক্রামকরূপী অমিক্রন আমাদের সামনে আসবে কি না, তা নিয়ে কিছু বলতে আমাদের আরও সময় লাগবে। বিজ্ঞান কখনোই প্রমাণ ছাড়া কথা বলতে চায় না, এমনকি আমরাও সাধারণ মানুষের মনে ভয়ের সঞ্চার করে এমন কিছু বলতে বা লিখতে রাজি নই। গণমাধ্যমের ভূমিকাও তা-ই, সেটাই হওয়া উচিত। তবে গণমাধ্যমের চেয়ে বিশ্বনেতাদের কর্মকাণ্ড অমিক্রন গবেষণার ফলাফল আসার আগেই কিছুটা দানবীয় রূপ দিয়ে ফেলেছে।

অমিক্রন শনাক্তের অনেক আগে সার্স-কভ-২ ডজনখানেক ভেরিয়েন্ট বা ধরন আমরা পেয়েছি। সব ধরন কিন্তু শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। কোনো কোনো ধরন মিউটেশন ঘটালেও তার কার্যকারিতা উহানে পাওয়া মূল ধরনটির মতোই ছিল কিংবা কম ছিল। তবে কেবল আলফা, বেটা, ডেলটার দাপট আমরা কিছুটা দেখেছিলাম। এসব ধরনে যেসব মিউটেশন (জিনোম সিকোয়েন্স নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিবর্তন) ঘটিয়েছিল, তার চেয়ে কিছুটা বেশি মিউটেশন হয়তো অমিক্রনে রয়েছে। তবে এসব মিউটেশন কতটা সংক্রামক হতে পারে, তার জন্য ওয়েট ল্যাব টেস্ট জরুরি, যা ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হচ্ছে।

করোনার সব মিউটেশনই খারাপ ফল বয়ে আনে না। কিছু কিছু মিউটেশন ভাইরাসটির শক্তি কমিয়ে ফেলতে সক্ষম। আমরা কম্পিউটারে প্রোটিন বিশ্লেষণের বিভিন্ন সফটওয়্যারে দেখতে পাচ্ছি, আরবিডিতে এস৩৭১এল, এস৩৭৩পি, কিউ৪৯৩আর, কিউ৪৯৮আর, টি৪৭৮কে এবং এন৫০১ওয়াই মিউটেশনগুলো এসিই-২ প্রোটিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব শক্তিশালী করছে, যার দ্বারা বেশিসংখ্যক সংক্রমণশীল হওয়ার প্রমাণ পাওয়া সম্ভব।আরবিডিতে যদি কেবল এই কয়েকটি পরিবর্তন ঘটত, তাহলে অমিক্রন আমাদের জন্য ত্রাস হিসেবে আসত।

আমরা এমন এক সময় করোনার আগের ধরনগুলো পেয়েছি, যখন নানা দেশে টিকা দেওয়া মাত্র শুরু হচ্ছিল। তবে ডেল্টার আগ্রাসন কিছুটা দানবীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এখন অমিক্রনের আবির্ভাব এমন এক সময় এসেছে, ঠিক তখন অনেক দেশেই ২৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৯০ শতাংশই টিকা প্রদান হয়ে গেছে। বাংলাদেশও অনেক দূর এগিয়েছে। ফলে টিকাগ্রহীতাদের মনে কিছুটা হলেও সাহস সঞ্চার হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অমিক্রন কি টিকাগ্রহীতাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে? আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হবে? আর যদিও সেটা হয়েও, অমিক্রন কি শক্তিশালী হন্তারক হতে পারে? কথা হচ্ছে, করোনার সব মিউটেশনই খারাপ ফল বয়ে আনে না। কিছু কিছু মিউটেশন ভাইরাসটির শক্তি কমিয়ে ফেলতে সক্ষম। আমরা কম্পিউটারে প্রোটিন বিশ্লেষণের বিভিন্ন সফটওয়্যারে দেখতে পাচ্ছি, আরবিডিতে এস৩৭১এল, এস৩৭৩পি, কিউ৪৯৩আর, কিউ৪৯৮আর, টি৪৭৮কে এবং এন৫০১ওয়াই মিউটেশনগুলো এসিই-২ প্রোটিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব শক্তিশালী করছে, যার দ্বারা বেশিসংখ্যক সংক্রমণশীল হওয়ার প্রমাণ পাওয়া সম্ভব।আরবিডিতে যদি কেবল এই কয়েকটি পরিবর্তন ঘটত, তাহলে অমিক্রন আমাদের জন্য ত্রাস হিসেবে আসত।

আশার কথা হলো, ছয়টি মিউটেশনকে মূল ধরলেও বাকি মিউটেশনগুলো এইসিই-২ সঙ্গে বন্ধুত্ব কমিয়ে ফেলছে। ফলে অমিক্রনের এসব মিউটেশনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আমরা অনেকটাই আশাবাদী, হয়তো অমিক্রন নিয়ে আমরা যতটা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কথা ভাবছি, সেটি বাস্তবে না-ও হতে পারে। তবে আরবিডি সাইটের বাইরে মিউটেশন হওয়া এইচ৬৫৫ওয়াই, এন৬৭৯কে এবং পি৬৮১এইচ মিউটেশনগুলো কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বটে। এসব মিউটেশন স্পাইক প্রোটিনে স্বয়ংক্রিয় প্রোটিয়েজ দ্বারা খসে পড়তে পারে।

আমি জানি, ওপরের আলোচনা হয়তো অনেকের কাছে বোধগম্য হবে না, তবে নন-একাডেমিক পাঠকদের শুধু এটুকু আশ্বস্ত করতে চাই, যে গতিতে ডেলটা ধরন ছড়িয়েছে, সেই গতি আমরা এখন পর্যন্ত অমিক্রনে দেখতে পাইনি। নভেম্বরের ১১ তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকায় এ ধরনটির জিনোমে মিউটেশন শনাক্তের পর সেই দেশে সংক্রমণ কিছুটা বাড়লেও নভেম্বরের আগে সংক্রমণ ঠিক এমনই ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুই বা তিনজন করে অমিক্রনে শনাক্ত হওয়ার খবর এরই মধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে। তবে সেই সংখ্যা খুবই কম। সংক্রমণের হারও আমরা তেমন লক্ষ করতে পারিনি। এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে: এক. সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরি কমিটি দ্রুততার সঙ্গে অমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ট্রেসিং করে আইসোলেশন করতে সক্ষম হয়েছে, অন্যটি টিকাগ্রহীতার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হয়তো অমিক্রন তেমন কার্যকর হয়ে ওঠেনি।

বিষয়টি যেটাই হোক, অমিক্রন মাত্র ধরা পড়েছে। তবে গত দুই সপ্তাহে সারা বিশ্বে সংক্রমণের হারে তেমন পরিবর্তন লক্ষ আমরা করতে পারিনি। এর মধ্যে একটা সুখকর বার্তা হয়তো আমাদের মধ্যে এসেছে। আমরা জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে, তবে এ ধরনটি যদি আমাদের শরীরের অ্যান্টিবডিকে উপেক্ষা করে সেটি আমাদের কিছুটা হলেও খারাপ বার্তা এনে দিতে পারে। প্রাথমিকভাবে কিছু গবেষণা আসছে, যেখানে বলা হচ্ছে অমিক্রনে আক্রান্ত হওয়ার আগে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকলে তারও পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি যদিও বিতর্কিত, তবে আমরা দেখছি, টিকা গ্রহণের পরও অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। কারণ, এখন পর্যন্ত বাজারে আসা টিকাগুলো করোনার ধরনগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা হিসেবে কাজ করলেও নির্দিষ্ট ধরনের জন্য তৈরি করা হয়নি।

ফলে আমাদের অনেকের শরীরের দুর্বল প্রতিরোধব্যবস্থা ভেদ করে আক্রান্ত হয়েছে। তবে অমিক্রনের ক্ষেত্রে কী হবে, তা বলতে কিছুটা হলেও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে একজন গবেষক হিসেবে আমি এটুকু বলতে পারি, অমিক্রনের জন্য হয়তো আমাদের নতুন করে আর কোনো টিকার প্রয়োজন পড়বে না। কারণ, অমিক্রনের সংক্রামকের ব্যাপকতা যদি বাড়েও সেই ক্ষেত্রে টিকা ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। তাই কেউ যদি পুনঃ আক্রান্ত কিংবা নতুন করে আক্রান্তও হয়, সেই ক্ষেত্রে টিকা সুরক্ষা দেবে। যদিও এরই মধ্যে টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো অমিক্রনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী টিকা তৈরি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করছে। অমিক্রনের প্রভাব দেখতে আমাদের আরও কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।

অমিক্রন আসবে, তার ভাই-ভাইপোরা আসবে, মোদ্দা কথা হচ্ছে, যত দিন না বিশ্বের প্রতিটি নাগরিক টিকা না পায়, তত দিন আমরা কেউ সুরক্ষিত নই। বিশ্বনেতারা তাঁদের সীমান্ত বন্ধ করুক বা খুলে দিক, তাঁরা যতক্ষণ না গরিব রাষ্ট্রগুলোর কাছে নিজেদের মজুত করা টিকা সরবরাহ করবেন, তত দিন অমিক্রনের মতো ধরনগুলো আমাদের সামনে আসতেই থাকবে। তাই তাঁদের উচিত হবে, টিকার সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা।
আমাদের দেশ অমিক্রনের চোখরাঙানিতে পাত্তা দিচ্ছে না। টিকানির্ভর হলেও আমাদের উচিত হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানার সংস্কৃতি তৈরি করা। মনে রাখতে হবে, টিকা আপনাকে শতভাগ সুরক্ষা দেবে না, তাই সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই, সামাজিক দূরত্ব রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। অমিক্রন শক্তিশালী হোক কিংবা নিষ্ক্রিয় হোক, সবার জন্য টিকা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মানার কঠোরতা আমাদের ধরে রাখতে হবে।

ড. নাদিম মাহমুদ জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক