অমিক্রন কি আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠবে

আফ্রিকায় শুরু হলেও বর্তমানে তা দুই শতাধিক দেশে কোভিড বিস্তারে মুখ্য ভূমিকায় অমিক্রন রয়েছে।

এই লেখার শিরোনামটি দেখে অনেকই হয়তো অবাক হবেন। অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন, সারা বিশ্বে মহামারি রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের অমিক্রন ধরনটি কীভাবে আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে? গেল দুই বছর যেভাবে এই ভাইরাস প্রাণসংহার ঘটিয়েছে, তাতে বলার অপেক্ষা রাখে না কোভিড এখন ভীতি সঞ্চারকারী। তবে অমিক্রনের সংক্রমণের উল্লম্ফনের মধ্যে গবেষকদের কাছে ‘রহস্যময়’ ভেরিয়েন্টে পরিণত হয়েছে, যা ভবিষ্যতে হয়তো মহামারির সদর দরজা বন্ধের হাতছানি দিচ্ছে। ঠিক কীভাবে অমিক্রন আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে, সেই বিষয়টি নিয়ে এখানে আলোকপাত করা হচ্ছে।

গত বছরের ডিসেম্বরের শুরু থেকে সারা বিশ্বে অমিক্রন ও ডেলটার বড় ধরনের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। আফ্রিকায় শুরু হলেও বর্তমানে তা দুই শতাধিক দেশে কোভিড বিস্তারে মুখ্য ভূমিকায় অমিক্রন রয়েছে। ডেলটাকে টপকে অমিক্রনের সংক্রমণ হার বেশি হওয়ায় অনেকেই শঙ্কিত। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে কে কোভিড টিকা গ্রহণ করেছে আর কে করেনি, অমিক্রন কাউকে তোয়াক্কা করছে না। টিকা নেওয়ার পর ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দিয়ে অমিক্রন যে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ হলেও যাঁরা এ বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁরা কিছুটা হলেও স্বস্তিবোধ করছেন। ডেলটা নিয়ে যতটা না হতাশ ছিলাম, বলা যেতে পারে অমিক্রন এখন পর্যন্ত সেই পর্যায়ে যায়নি। গত দুই মাসে অমিক্রন নিজের যে বৈশিষ্ট্য দেখাচ্ছে, তা যদি সামনের দিনগুলোতেও চলতে থাকে, তাহলে কোভিড ভীতিতে লাগাম পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিষয়টি এমনও হতে পারে যে ভবিষ্যতে হয়তো প্রতিটি মানুষ অমিক্রনের আলিঙ্গন লাভ করবে। যেমনটা আমরা সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হই, ঠিক তেমনই একটি আভাস আপাতত অমিক্রন আমাদের দেখাচ্ছে। তবে ১১ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ প্রধান হান্স হ্যানরি যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেখানে বলা হচ্ছে চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে ২৬টি দেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে, আগামী দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে ইউরোপের ৫০ শতাংশ মানুষ অমিক্রনে আক্রান্ত হতে পারেন। এই লক্ষণও অবশ্য আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখতে পাচ্ছি।

পর্তুগাল তাদের মোট জনসংখ্যার ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশকে কোভিডের দুটি ডোজ এবং ৩৩ শতাংশ বুস্টার ডোজ দিয়েছে। গত সপ্তাহে দেশটি গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৪০ হাজার কোভিড রোগী শনাক্ত করেছে। আক্রান্তের পরিসংখ্যানটি হতাশ করলেও মৃত্যুহারের তেমন বৃদ্ধি পায়নি। গেল সপ্তাহে মারা গেছেন মাত্র ১৩ জন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি ১০ লাখের হিসাবে ৪ জন মারা গেছেন। যদিও সেটি ডেলটায় কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এ টিকার পরিসংখ্যানের প্রায় এক বছর আগে দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা বর্তমানের অর্ধেক হওয়া শর্তেও সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছিল ২৭৫ জন। আমরা যদি এ পরিসংখ্যান সামনে নিয়ে আসি তাহলে দেখতে পাচ্ছি, অমিক্রনের প্রভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তবে মৃতের সংখ্যা নগণ্য বা অমিক্রন আসার পূর্বের মতো স্থিতিশীল রয়েছে।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দেখছেন যে অমিক্রন সম্ভবত আমাদের ওপরের শ্বাসনালিতে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। ফলে নিম্ন শ্বাসনালি (ফুসফুসে) যেতে পারছে না, ফলে ফুসফুসে অমিক্রনের বিস্তার বা প্রতিলিপি তৈরি হচ্ছে না। অমিক্রনে হওয়া মিউটেশনের কারণে টিএমপিআরএসএস২ কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে (মেং ইটি এল, ২০২১)। যে কারণে অমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শ্বাসকষ্ট জটিলতায় ভুগছেন কম। কোভিডের লক্ষণও সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণের মতো থাকছে।

কোনো কোনো দেশে অমিক্রন সংক্রমণ ঘটালেও কোভিডের লক্ষণ প্রকাশ তেমন পাচ্ছে না। জাপানের ওকিনাওয়া প্রদেশে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত সংক্রমণের ৯০ শতাংশই ছিল কোভিডের লক্ষণহীন। মৃত্যুহার নেই বললেই চলে।

বিষয়টি শুধু পর্তুগাল কিংবা জাপানের ক্ষেত্রে সত্যি নয়, অনেক দেশেই ঠিক একই ধারাবাহিকতা চলছে। তাই অমিক্রন নিয়ে আমাদের গবেষকেরা প্রাথমিক দিকে যতটা না উদ্বিগ্ন ছিলেন, ধীরে ধীরে তা শীতল হতে শুরু করেছে। তবে প্রশ্ন হলো, অমিক্রন যদি এভাবে সংক্রমণ ছড়ায়, তবে মহামারির ভবিষ্যৎ কী? টিকা নেওয়ার পরও যদি আক্রান্তই হয়, তাহলে টিকা দিয়ে লাভ কী? অমিক্রন কীভাবে এ মহামারি নিয়ন্ত্রণে আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে?

বিষয়গুলো আলোচনার আগে আমরা একটু জেনে নিই যে করোনার এ সময়ে আমাদের গবেষকেরা কীভাবে এসব ভেরিয়েন্ট পর্যবেক্ষণ করছেন। উন্মুক্ত সার্ভার জিআইএসএআইডিতে জমা হওয়া সাত মিলিয়নের অধিক সার্স-কভ-২ এ জিনোম সিকোয়েন্সে এখন পর্যন্ত কয়েক শ সার্স-কভ-২ রূপভেদ পাওয়া গেছে। এ ভাইরাসের রূপভেদ ট্রি (গাছের) দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে সার্স-কভ-২ অনবরত তাদের লাইনেজ বা রূপান্তর হচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ শক্তি প্রদর্শন করছে, আবার কেউ মৃদু হয়ে পড়ছে।

কোভিডের শুরুর দিকে লক্ষ করা যায়, ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আলফা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ ছড়ালেও দেশে দেশে প্রথম সংক্রমণ তরঙ্গটি গত বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিটা ধরনের দখলে ছিল। ভারতে পাওয়া ডেলটা ভেরিয়েন্টটি শক্তিশালী হওয়ায় তা কোভিড টিকা কর্মসূচির মধ্যেই দ্রুততার সঙ্গে ছড়াতে শুরু করে। দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় তরঙ্গটি ডেলটার নিয়ন্ত্রণে ছিল, যা ২০২১ সালের এপ্রিল-মে থেকে শুরু করে অদ্যাবধি পর্যন্ত চলছে। এর মাঝে যোগ হওয়া অমিক্রনের তরঙ্গ চলছে দেশে দেশে। সদ্য জন্ম নেওয়া অমিক্রন যেভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, সেই পরিসংখ্যান ব্যাখ্যা করে গবেষকেরা মনে করছেন, অমিক্রনই ভবিষ্যতে মহামারি সচল রাখবে। সংক্রমণের পারদ চড়লেও মৃত্যুঝুঁকি কম হওয়ায় জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করছেন, অমিক্রন যদি সর্বত্রও ছড়িয়ে পড়ে এবং মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে ফেলে, তাহলে সেটি এই মহামারির জন্য হয়তো ভালো ফল বয়ে আনবে।

সংক্রমণ বেশি ছড়ানোর পর কেন মৃত্যু কম, সেই ব্যাখ্যা দেওয়া জরুরি। যখন সার্স-কভ-২ আমাদের শরীরে সংস্পর্শে আসে, তখন দুই প্রক্রিয়ায় শরীরের কোষে প্রবেশ করে। একটি হলো এসিই২ নামের গ্রাহক প্রোটিন, অন্যটি হলো টিএমপিআরএসএস২ নামক সেরিন প্রোটিয়েজ এনজাইম। আমাদের কোষের ঝিল্লিতে এ প্রোটিয়েজের আধিক্য বেশি। ডেলটা ভেরিয়েন্টটির স্পাইক প্রোটিনকে দ্রুত এ প্রোটিয়েজ সক্রিয় হয়ে ফুসফুসে সংক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যে কারণে ডেলটায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফুসফুসের ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি, ফলে অক্সিজেনস্বল্পতার দরুন নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের প্রয়োজন পড়ে।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দেখছেন যে অমিক্রন সম্ভবত আমাদের ওপরের শ্বাসনালিতে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। ফলে নিম্ন শ্বাসনালি (ফুসফুসে) যেতে পারছে না, ফলে ফুসফুসে অমিক্রনের বিস্তার বা প্রতিলিপি তৈরি হচ্ছে না। অমিক্রনে হওয়া মিউটেশনের কারণে টিএমপিআরএসএস২ কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে (মেং ইটি এল, ২০২১)। যে কারণে অমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শ্বাসকষ্ট জটিলতায় ভুগছেন কম। কোভিডের লক্ষণও সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণের মতো থাকছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণায় (কিসলার ইটি এল, ২০২১) দেখা যাচ্ছে, সার্স-কভ-২ ভাইরাসটি সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সংক্রমণশীল। তবে অমিক্রনের লক্ষণের সঙ্গে মৌসুমি করোনাভাইরাস ২২৯ই–র মিল পাচ্ছেন অনেক গবেষক। তাঁরা মনে করছেন, সার্স-কভ-২ রূপভেদ তৈরি করে যদি অমিক্রনের মতো থাকে, তাহলে সেটি হবে চলতি মহামারি মোকাবিলায় দারুণ কিছু। মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে, জ্বর-কাশির পর্যায়ে থাকা এ ধরন সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে থাকে, তাহলে হয়তো সামনের দিনগুলোতে ইনফ্লুয়েঞ্জার স্টেইন এইচ৩এন২ মতো প্রতিবছর টিকা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। অথবা এমনও হতে পারে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা এ পরিস্থিতিতে কাজে দিচ্ছে। আর সেটি হতে পারলে অমিক্রন ভেরিয়েন্টটি মহামারির জন্য গেমচেঞ্জার হবে।

কোভিড টিকা আমাদের বিজ্ঞানের বড় অর্জন। যার ফলে মৃত্যু যেমন কমেছে, তেমনি টিকা গ্রহণকারী আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভোগান্তিও কমেছে। ৭০-৮০ শতাংশ আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। তবে কিছু তথ্য বলছে যুক্তরাষ্ট্রে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

এটি প্রমাণিত যে বুস্টার ডোজ যেকোনো ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে শরীরে একধরনের প্রতিরক্ষাবলয় তৈরি করছে। টিকা গ্রহণের পরও অমিক্রন দ্বারা অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন মূলত অমিক্রনের শক্তিশালী কিছু মিউটেশনের কারণে। তাই বলে ভ্যাকসিন নেওয়া বন্ধ করা যাবে না। বরং সুযোগ থাকলে আগের চেয়ে আমাদের দ্রুততার সঙ্গে টিকা কর্মসূচি সচল রাখতে হবে। সবার জন্য বুস্টার ডোজের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

অমিক্রন যদি ভ্যাকসিনকে ফাঁকি দিয়েও থাকে, আর লক্ষণ হিসেবে মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো জ্বর, সর্দি, কাশি এবং শরীরব্যথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলেও সেটি আমাদের জন্য সুখবর। সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পরও বিশ্বে অমিক্রনের প্রভাব হাসপাতালে তেমন পড়েনি। অনেক হিসাব–নিকাশ কষে, জাপান, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ ১৩ জানুয়ারি থেকে অমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনের সময় কমিয়ে দিচ্ছে। জাপান ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন ১০ দিনে নামিয়েছে। এটি একটি ভালো লক্ষণ।

তবে এখনো শঙ্কার কথা হলো, অমিক্রনের সঙ্গে ডেল্টা আমাদের পিছু ছাড়েনি। ফলে দেশে সংক্রমণের ঢেউয়ের সঙ্গে মৃত্যুও বাড়ছে। তবে দেখার বিষয় হলো, এ মৃত্যুর মিছিলে অমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা কত। তাই বলা যেতে পারে, ডেলটার তরঙ্গ এখনো শেষ হয়নি। ফলে স্বাস্থ্যবিধি আমাদের এখনো মানতে হবে। সামাজিক দূরত্ব যেমন মানতে হবে, তেমনি মাস্ক পরাও লাগবে। আমরা মনে করছি, এ পরিস্থিতিতে দেশে বিধিনিষেধের তেমন প্রয়োজন নেই। ভীতি না ছড়িয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক নিয়মে চলুক। ভুলক্রমেও যেন তা বন্ধ করা না হয়। মহামারিতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার মোক্ষম সময় আমাদের সামনে হয়তো আসছে। পরিবহনে যাত্রী অর্ধেক নিয়ে করোনা মোকাবিলা যতটা না কার্যকর, তার চেয়ে বেশি হতো যদি সবাই আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে—অন্তত মাস্ক পরে ঘর থেকে বের হতাম। মনে রাখতে হবে, অমিক্রন ‘নখদন্তহীন বাঘ’ নয়।

ড. নাদিম মাহমুদ জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। [email protected]