অযোধ্যায় 'ভিতপূজা': ন্যায়নীতি রক্ষায় কেউই কি নেই

ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় গিয়ে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থান করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি
ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় গিয়ে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থান করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর তথাকথিত রামমন্দিরের শিলান্যাস হয়ে গেল গতকাল ৫ আগস্ট। ভিন্ন ধর্মের আরাধনাস্থল ভেঙে, রাষ্ট্রক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, দেশের সংবিধানের মূল পরিকাঠামোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর এই মন্দিরের শিলান্যাস আধুনিক বিশ্বের কাছে ভারতকে একটি সংহারকারী দেশ হিসেবেই চিহ্নিত করবে। আধুনিক বিশ্বে যে দেশে সংখ্যালঘুর উপাসনালয় সংখ্যাগুরুরা ধ্বংস করতে পারে এবং সেই ধ্বংসস্তূপের ওপরেই অপর ধর্মের বিতর্কিত মন্দির তৈরির উপাদান সর্বোচ্চ আদালত জোগান দিতে পারেন, তাতে স্বভাবতই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে এমন একটি সার্বিক সংখ্যাগুরু মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তির শাসনকালে কেমন আছে ভারতের সংখ্যালঘুরা।

১৯৯২ সালের আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংসে আরএসএস, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, আর তাদের হাজারো সহযোগী সংগঠনের হিসহিসে ষড়যন্ত্র ঘিরে সব অবিজেপি রাজনৈতিক দল তৎপর ছিল। জ্যোতি বসুর মতো ব্যক্তির সক্রিয়তা ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কাজ যখন চলছে, সেই অভিশপ্ত দিনে, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, জ্যোতি বসু ছাড়া আর কোনো অবিজেপি নেতা সেভাবে তৎপর হয়ে ঐতিহাসিক মসজিদটি রক্ষার জন্য শেষ চেষ্টা করেননি।

জ্যোতি বসু সেদিন একাধিকবার ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাওকে ফোন করে পবিত্র মসজিদটি রক্ষায় কাতর অনুরোধ করতে চেষ্টা করেছিলেন। নরসিংহ রাও সেদিন তাঁর সংখ্যালঘু সরকার বাঁচানোর প্রশ্নেই এতখানি তৎপর ছিলেন যে জ্যোতিবাবুর ফোন পর্যন্ত ধরেননি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জ্যোতিবাবুকে জানানো হয়েছিল, নরসিংহ রাও ভজন-পূজনে ব্যস্ত রয়েছেন। কার্যত নিস্পৃহ থেকে, নিজের সংখ্যালঘু সরকার বাঁচানোর তাগিদকেই অগ্রাধিকার দিয়ে আধুনিক বিশ্বের বুকে অপর ধর্মের একটি উপাসনালয় ধ্বংসের মতো নারকীয় অপরাধ সংঘটিত হতে দিয়েছিলেন নরসিংহ রাও। সেদিন সুযোগ বুঝে নিজেকে বাঁচাতে সুদূর দক্ষিণ ভারতে সফর করার নাম করে ভালোমানুষির ইমেজ বজায় রেখেছিলেন সরকারের মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাও মন্ত্রিসভার সদস্যা হয়ে নীরবে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মৌতাত উপলব্ধি করেছিলেন।

নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর ভারতের আদালত সংবিধান-নির্দেশিত পথে চলছেন কি না—এই প্রশ্ন আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে তীব্র হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমিসংক্রান্ত রায়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের পর। জমিসংক্রান্ত বিতর্কে যেভাবে একটি পবিত্র মসজিদকে স্থানান্তরিত করবার উদ্ভট রায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছেন, তাতে এই আশঙ্কাই তীব্র হয় যে সংবিধান, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি কি আর ভারতে বিদ্যমান আছে? জমি-বিবাদের মামলায় নিছক একটি ধর্মীয় সংগঠনের বিশ্বাসের ভিত্তিতে, কোনো রকম পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ ছাড়া ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমিটিকে তথাকথিত ‘রামলালা’র জমি হিসেবে ন্যস্ত করেছেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। তাতে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, কেবল ভারতেই নয়, ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান-নেপাল-শ্রীলঙ্কা-মিয়ানমার, সর্বত্রই ধর্মান্ধ মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তি যাতে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে, সেই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক স্তরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তার অংশ হিসেবেই এই রায়দান হয়েছে।

ভারতের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিরোধী এই রায়ের সর্বাত্মক বিরোধিতা করে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক পরিবেশ-পরিকাঠামো ভারতে বজায় রাখার কেউ কি নেই? গোটা উপমহাদেশেই শান্তি, প্রগতি, ধর্মনিরপেক্ষতা, সম্প্রীতি, গণতন্ত্র অক্ষুণ্ন রাখার যে ধারাবাহিক লড়াই, তাকে বজায় রাখতে ভারতের অবিজেপি রাজনৈতিক দলগুলো আদৌ তেমন কোনো ভূমিকাই পালন করেনি। ভারতের সব অবিজেপি দল—দুর্ভাগ্যের কথা, এই তালিকায় বাম দলগুলোকেও কিছুটা ফেলতেই হয়। তারাও কি হিন্দু ভোট হারানোর ভয়ে খুব ভীত? তাই কি তারা সুপ্রিম কোর্টের ভারতের সংবিধানবিরোধী এই রায়দান ঘিরে কার্যত কাগুজে প্রতিবাদেই নিজেদের আবদ্ধ রাখে? ব্যাপক গণ-আন্দোলন এই রায়ের বিরুদ্ধে গড়ে তুললে হিন্দু ভোট ফসকে যেতে পারে বলেই কি অবিজেপি দলগুলো নামকাওয়াস্তে প্রতিবাদ করেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করল?

কোভিড-১৯-জনিত এই ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতরেও তথাকথিত রামমন্দিরের শিলান্যাসের এই নাটকীয় পর্যায় ঘিরে বামপন্থীরা কার্যত নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদেই এখন পর্যন্ত নিজেদের আবদ্ধ রেখেছেন। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে বা পরে বামপন্থীদের ভেতরে ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় যে ঝাোঁক ছিল, আজ তা কার্যত জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতাদের ‘আবেদন-নিবেদন’ নীতির সমার্থক হয়ে উঠছে।

বাবরি মসজিদের জমি এবং এনআরসি ঘিরে ভারত রাষ্ট্র কর্তৃক সংখ্যালঘু মুসলমানদের নাগরিকত্ব হরণের ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের ভেতরেই দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে। সেই ভোটে এনআরসি ঘিরে বামেদের মৃদু কথাবার্তা ছাড়া কংগ্রেস কিংবা অন্য অবিজেপি রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নীরবই থাকেনি, কার্যত নরম হিন্দুত্বের পথ ধরে ভোটব্যাংক সামলানোর চেষ্টা করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিজেপির চুপারুস্তম দোস্তরা ধর্ম আর জিরাফের অদ্ভুত সহাবস্থান করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার বনিয়াদটিকে ভেঙে চুরমার করতে সংঘ-বিজেপিরই একান্ত সহযোগী।

শীর্ষস্তরের অবিজেপি নেতারা বাবরি মসজিদের জমিতে তথাকথিত রামমন্দিরের ভিতপূজা ঘিরে নীরব থাকলেও একাংশের বামপন্থী সমর্থকেরা সামাজিক গণমাধ্যমে ভিতপূজার সঙ্গে যুক্ত সংঘ পরিবারের সাধুদের কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়া বা নিম্নবর্গীয় সাধুদের উচ্চবর্গীয় সাধুরা এই ভিতপূজায় আমন্ত্রণ জানায়নি, এই ধরনের অরাজনৈতিক প্রচারের ভেতর দিয়ে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কার্যত অন্য খাতে বইয়ে দিচ্ছে—বুঝে হোক বা না বুঝে।

এসবের নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের মনে ভারতবিদ্বেষ ও সেই দেশের হিন্দুদের প্রতি অবিশ্বাস বাড়তে পারে। সেটা যদি হয়, তার সুযোগে ভারতে আরএসএস-বিজেপি ভারতে মুসলমান নির্যাতন নতুন কৌশলে শুরু করল বলে। এসব দেখে, বুঝে, জেনে, বামপন্থীরা কী করে নিয়মতান্ত্রিক একটা প্রতিবাদে নিজেদের অবদ্ধ রাখতে পারছেন—এটা চরম বিস্ময়ের কথা। তাহলে কি কংগ্রেসের মতোই এই মুহূর্তে বামপন্থীরাও কেবল ভোটে জেতাকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিতে শুরু করেছে? হিন্দু ভোট হারানোর ভয়েই কি বাবরি মসজিদের জমিতে তথাকথিত রামমন্দিরের ভিতপূজা ঘিরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও একটি প্রতিবাদও তাঁদের নেই?

একাংশের প্রগতিশীল শিবির থেকে এই যুক্তি তৈরি করা হচ্ছে যে ভিত পূজার বিরুদ্ধতা করলে নাকি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধতা করা হবে। সুপ্রিম কোর্ট যদি ভবিষ্যতে অগ্রহণযোগ্য কোনো রায় দেয় তবে বামপন্থীরাসহ, সমস্ত অবিজেপি দল কি কোর্টের রায় মেনে ভারতের সংবিধানের মূল ভিত্তি ও পরিকাঠামো ধ্বংস করে ভারতকে আরএসএসীয় হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার আয়োজনে শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করে যাবে? জীবনপণ করে প্রতিবাদ করবে না? প্রতিরোধ করবে না? হিন্দু ভোট হারানোর ভয়ে কোটি কোটি সহনাগরিক সংখ্যালঘুকে তুলে দেবে হাড়িকাঠে?

গৌতম রায়: পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ও ইতিহাসবিদ।