অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে দরকার নদীর মতো নেটওয়ার্ক

বাংলাদেশের আনাচেকানাচে নদী বহমান। অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় সংযুক্ত জনপদ। এ সংযোগকে কেন্দ্র করেই হাজার বছর ধরে চলেছে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। নদীর পাড়ে পাড়ে গড়ে উঠেছে শহর, নগর, বন্দর। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে দরকার নদীর মতো উৎপাদনের নেটওয়ার্ক।

করোনাকালে তারল্য প্রবাহ নিশ্চিত রাখতে ঋণভিত্তিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। ঋণ দিয়ে সাময়িক সংকোচন মোকাবিলা সম্ভব। বিশ্বব্যাপী ঐকমত্য—টেকসই পুনরুদ্ধার এবং রূপান্তর নিশ্চিত করতে দরকার নতুন নতুন বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি। তাহলেই পুরনো কর্মসংস্থান ধরে রেখেও সৃষ্টি করা যাবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। গত কয়েক বছর ধরেই দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা ছিল, বাড়ছিল বেকারত্ব ও বৈষম্য, কমছিল দারিদ্র্য কমার হার। করোনাকালে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, বৈষম্য আরও বেড়েছে। নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গুণগত সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা না গেলে নতুন দারিদ্র্য মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে।

স্থবিরতায় বিনিয়োগ ও বর্ধমান বেকারত্ব
ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ এক দশক ধরেই ২৩ শতাংশের কাছাকাছিতে আটকে আছে। প্রবৃদ্ধির অন্যতম অংশ এসেছে সরকারি ব্যয় থেকে। তবে সরকারি ব্যয়ও নিম্নগামী। বিনিয়োগ স্থবিরতায় করোনার আগেও কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি চলছিল।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দেশের ভেতরেই প্রতিবছর অন্তত ২২ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি লক্ষ্য ছিল। প্রথম চার বছরে প্রতিবছর প্রকৃত কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে মাত্র ১২ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, করোনার আগে সার্বিক বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। ১৪ থেকে ২৪ বছরের বয়সী যুব বেকারত্বের হার ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, যুবকদের ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশই কোনো ধরনের কর্মসংস্থান, শিক্ষা অথবা প্রশিক্ষণে নিয়োজিত নেই। বিবিএস বলছে, করোনার প্রথম চার মাসেই বেকারত্ব বেড়েছে ১০ গুণ। আইএলও এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের যৌথ প্রজেকশন অনুযায়ী, করোনার কারণে যুব বেকারত্বের হার ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে।

গ্রামীণ বিকাশ কেন্দ্র
অভিবাসনই গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের মূল। ছদ্মবেকার ও উননিয়োজিত মানুষ গ্রাম থেকে শহরে ও বিদেশে শ্রমিক হিসেবে গিয়েছে। তাদের আয় বাড়ায় ভোগ ব্যয় বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে।

শহরে অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিতরাই করোনার অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি চাকরি ব্যতীত আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতের মানুষেরই আয় কমেছে। আয় কমে যাওয়া বা ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ছে নতুন দারিদ্র্য। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণা অনুযায়ী, করোনায় নতুন ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছে।

বিদেশ থেকে আসা অভিবাসী আয় অব্যাহত থাকায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধাক্কা কিছুটা হলেও কম লেগেছে। অভিবাসী দেশগুলোর অর্থনীতিতে নতুন কাঠামোগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। এসব দেশে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সময় লাগতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে অভিবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে। প্রায় দুই বছর ধরে মালয়েশিয়ায় কর্মী রপ্তানি প্রায় বন্ধ আছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতেও বন্ধ।

নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য গ্রামীণ অর্থনীতির সঞ্জীবন দরকার। প্রতিটি গ্রামকে একটি ‘বিকাশ কেন্দ্র’ হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। সৃজনশীল পন্থায় প্রতিটি শহর ও গ্রামকেন্দ্রিক বিনিয়োগ ও উৎপাদন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে হবে। প্রতিটি এলাকার জনগণ নিজ এলাকাকে কেন্দ্র করেই স্বাবলম্বী হবে, পাশাপাশি অন্য অঞ্চলের সঙ্গেও তাদের যোগ থাকবে। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সবার কর্মসংস্থান সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারি সেবা-পরিষেবা স্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা জরুরি।

পরিবেশ উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ রূপরেখা
নতুন বিনিয়োগ ও শিল্প উদ্যোগ প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। প্রণোদনার অর্থ বিতরণের পরও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। ভালো ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগের ঝুঁকি নিচ্ছেন না, ব্যাংকগুলোও অসাধু ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে ভরসা পাচ্ছে না। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে অলস তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।

স্থবিরতা কাটাতে সার্বিক বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন এবং নতুন বিনিয়োগ রূপরেখা দরকার। ঝুঁকি কমিয়ে আনা গেলে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ বাড়বে। আবার খেলাপি ঋণ ও আর্থিক খাতের অনিয়ম বন্ধ করলে ব্যাংকগুলোও ঋণ দিতে উৎসাহী হবে। অ্যাডহক নয়, জরুরি সার্বিক কৌশল ও বাস্তবায়ন পথনকশা। এসব সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।

উৎপাদন ও রপ্তানিতে বৈচিত্র্য
রপ্তানিপণ্য এবং বাজারের বৈচিত্র্য না থাকায় এবং এক শিল্পনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে করোনার অভিঘাত বেশি পড়েছে। রপ্তানি পণ্যের ৮৮ শতাংশই পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্য। এখানেও বৈচিত্র্যের ঘাটতি রয়েছে। ৬৮ শতাংশই মাত্র ১০ রকম পোশাকে সীমাবদ্ধ। রপ্তানি বাজার পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় সীমাবদ্ধ। সীমিত বাজার হওয়ায় রপ্তানিকারক দেশগুলোর অর্থনীতিতে যেকোনো আঘাত এলেই ক্রয়াদেশ কমে যায়। করোনার প্রথম ধাক্কায় ১১৫০টি কারাখানায় ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়। দ্বিতীয় ধাক্কায় ৫০টি বড় কারখানার ক্রয়াদেশ কমেছে ৩০ শতাংশ।

শুধু পশ্চিমা দেশ নয়, রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি আদায়ে জোর দিতে হবে। একইভাবে দেশি ও বিদেশি বাজারের জন্য নতুন উৎপাদন কাঠামো গড়ে তোলা দরকার।

শ্রমঘন শিল্পের নতুন রাস্তা
শ্রমঘন শিল্পের ওপর জোর দিতে হবে। প্রতিনিয়ত শ্রমবাজারে যোগ দেওয়া বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটাই মুখ্য। যেমন হালকা প্রকৌশলশিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো যেতে পারে। স্বল্প সুদে ঋণ, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনে প্রশিক্ষণ, শিল্পপার্ক স্থাপনে কার্যকর উদ্যোগ নিলে সম্প্রসারণ হবে। ক্রমান্বয়ে ভারী প্রকৌশলশিল্পের দিকে যাওয়ার পথ সুগম হবে।

শ্রমিকের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। সমাজে সব পেশাকে সম্মানের চোখে দেখার মূল্যবোধ তৈরি করা যায়নি বিধায় কারিগরি শিক্ষায় আগ্রহ কম। সব কর্মই সম্মানের—এই মূল্যবোধের প্রচার প্রসার জরুরি।

উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমে সংযোগ
মূলত পশ্চিমে ও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি এবং পার্শ্ববর্তী দেশ দুটো থেকে আমদানি—এই নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নতুন আঞ্চলিকতা, নতুন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জালে নিজেদের যুক্ত করতে হবে। বিমান, রেল, সড়ক, নৌ—সব ধরনের নেটওয়ার্কে জড়াতে হবে। ভারসাম্য ও বৈচিত্র্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সম্পর্ক স্থাপনে নজর দিতে হবে।

সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবশ্যই ভোক্তার চাহিদাভিত্তিক বাণিজ্যের ওপর জোর দিতে হবে। যেসব দেশে ভোক্তাদের চাহিদা বেশি সেসব দেশের উৎপাদন, প্রযুক্তি ও আর্থিক নেটওয়ার্কে নিজেদের সংযুক্ত করতে হবে।

সুবর্ণজয়ন্তীতে নতুন ভাবনা
শুধু পুনরুদ্ধার নয়; অর্থনীতির টেকসই কাঠামোগত রূপান্তর নিশ্চিত করাটা দরকার। প্রতিটি গ্রাম ও শহরকে স্বাবলম্বী করতে হলে গোষ্ঠীস্বার্থ বাদ দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের স্বার্থে নীতি-কৌশল গ্রহণ জরুরি। একই সঙ্গে টেকসই ও সবুজ বিকাশের জন্য উৎপাদনব্যবস্থা অবশ্যই সবুজ এবং পরিবেশবান্ধব করতে হবে। নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক ও গুণক প্রভাবক সৃষ্টিকারী বিনিয়োগ হলে নতুন কর্মসংস্থান হবে। এভাবে বৈষম্যহীন ও টেকসই উত্তরণ সম্ভব।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন।
[email protected]