অর্থনীতি ভালো আছে, গণতন্ত্রের খবর কী

৪ জানুয়ারি বন্ধু-সাংবাদিক শওকত হোসেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন, অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই আমরা পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছি। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে দুই বছর আগে, আর মাথাপিছু জিডিপিতে ছাড়িয়েছে তিন বছর আগে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ তথ্য বলছে, বাংলাদেশের পাকিস্তানের ছাড়িয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ অর্জনটি ঘটবে ২০২১ সালে। এর আগে আইএমএফের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে পেছনে ফেলছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে আমাদের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১ হাজার ৮৮৮ ডলার, আর ভারতের ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। জিডিপির এই ব্যবধান যত কম হোক না কেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ।

স্বাধীনতার পর সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে অভিহিত করেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে শঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। এখন বাংলাদেশ আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি করেছে বলে বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করছেন।

শওকত হোসেনের নিবন্ধ থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে, এই খবর সেখানকার ‘দাদা অর্থনীতিবিদেরা’ সহজভাবে নিতে পারেননি। তবে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ গত ১৭ অক্টোবরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রশংসা করে বলা হয়েছে, জিডিপির দিক থেকে দেশটি এখন অনেক বেশি শিল্প ও সেবা খাতনির্ভর। এই খাতই এখন কর্মসংস্থান তৈরি করছে। অন্যদিকে ভারতের মানুষ এখনো অনেক বেশি কৃষিনির্ভর। এর বাইরে আরও কিছু সামাজিক সূচকও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। যেমন স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ। নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রশংসা করেছেন।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে উন্নয়নের এই চিত্র অবশ্যই আশা জাগায়। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মধ্যে ১৭ কোটি মানুষের বাস, তারপরও আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলেছি। আমাদের গড় আয় ও আয়ু দুটোই বেড়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে। নব্বই দশকেও যেখানে মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত, সেখানে ৯৫ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনা বিরাট অগ্রগতি বলতে হবে। বিদ্যুতের উন্নয়ন হলে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন হয়; শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা বাড়ে; মানুষের জীবনধারা অনেক সহজ হয়। আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ খাতে সাফল্য দেখিয়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি এই খাতে যে অনেক দুর্নীতি ও অপচয় হয়েছে, তা–ও অস্বীকার করা যাবে না। সরকার এসব বন্ধ করতে পারলে উন্নয়নের গতি আরও বাড়ত।

যেকোনো স্বাধীন দেশের জন্য অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা জরুরি। আমরা মোটামুটি তা অর্জন করেছি। কিন্তু আধুনিক যুগে মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে চিন্তা, মতপ্রকাশ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় তার অংশগ্রহণের বিষয়টিও এসে পড়ে। ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের সংবিধানের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা—যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ সপ্তম অনুচ্ছেদে আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে এই প্রশ্ন বড় হয়ে এসেছে, জনগণ কি দেশের ‘সকল ক্ষমতার মালিক’ হতে পেরেছে? এর সোজা উত্তর ‘না’। জনগণকে দেশের মালিক হতে হলে তাকে জনপ্রতিনিধি বাছাই করার অধিকার পেতে হবে। গত পাঁচ দশকেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলেন না। ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের সুবিধামতো সবকিছু করেন। তাঁরা একবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেন, আরেকবার বাতিল করেন। জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার জন্য যে নির্বাচন কমিশন, তারা ভোটাধিকার রক্ষা না করে হরণ করে। তারা জনগণের চেয়ে ক্ষমতাসীনদের আস্থা লাভই তাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক শাসনের সব সূচকে আমরা পিছিয়ে আছি।

গত সপ্তাহের লেখায় গণতন্ত্রের ভঙ্গুর অবস্থা নিয়ে লিখেছি। এবার নাগরিক স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সামান্য আলোকপাত করতে চাই। সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা করা হইল।’ ৩৯(২) ধারায় আছে, ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্‌ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’

সংবিধান নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের যে স্বাধীনতা দিয়েছিল, প্রতিটি সরকার তা খর্ব করতে নানা ধরনের কালাকানুন জারি করে। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রণীত বিশেষ ক্ষমতা আইন নিয়ে মাঠ গরম করতেন বিএনপির ও জাতীয় পার্টির নেতারা। ক্ষমতায় এসে সেই আইন বাতিল করলেন না, অটুট রেখে দিলেন। বিএনপি আমলের আইসিটি আইনের বিরোধিতা করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেটি বাতিল করেনি। বরং আরও কঠোর নবতর সংস্করণ ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ চালু করল, এটা আরও ভয়ংকর কালাকানুন। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস–এর ২০২০ সালের প্রতিবেদনে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১। গত বছরের চেয়েও এক ধাপ নিচে নেমে এসেছে। ভারতের অবস্থান ১৪২, পাকিস্তান ১৪৫, নেপাল ১১২, আফগানিস্তান ১২২ ও শ্রীলঙ্কা ১২৭। অর্থাৎ সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার দিক থেকে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় সবার পেছনে আছি। অথচ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভালো করছি। অর্থাৎ অর্থনীতির উন্নয়ন হলেও গণতন্ত্রের উন্নয়ন হয়নি।

আওয়ামী লীগ একনাগাড়ে ক্ষমতারোহণের এক যুগ পার করেছে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আইনের শাসন সমুন্নত রেখে মানুষের নাগরিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে যা যা করা প্রয়োজন, তা করব।’

প্রকৃতপক্ষে মানুষের নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করলেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]