অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, আফগানিস্তানের বাঁচার পথ কী

ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এমন আশঙ্কায় গ্রাহকেরা সঞ্চিত অর্থ তুলে নিচ্ছেন
ছবি: রয়টার্স

একজন আফগান আমেরিকান হিসেবে আমি আমার দেশের জনগণকে অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে এবং আমার দেশের সবার জন্য আরও সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তুলতে ২০ বছর ধরে কাজ করেছি। এই মুহূর্তে আমার সেই আশাগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আফগানিস্তান আমার ক্যারিয়ারে দেখা সবচেয়ে তীব্র সংকটের মুখোমুখি হয়েছে এবং এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার ‘প্রতিষেধক’টি নিউইয়র্কে আটকে আছে।

গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে জমাকৃত আফগানিস্তানের জাতীয় রিজার্ভের ৯১০ কোটি ডলারের ব্যাংক হিসাবটি স্থগিত করে। এর ফলে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটেছে। আফগান জনগণ ক্রমবর্ধমানভাবে নিত্যপণ্য কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছে। দেশটির মুদ্রা উচ্চ অবমূল্যায়নের সম্মুখীন হচ্ছে এবং ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া অর্থনীতি পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।

একটি বিপর্যয় যে আসন্ন তাতে কোনো ভুল নেই। মার্কিন ডলার ও আফগানির বিনিময় হার এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য স্থিতিশীল বিনিময় হার এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য মুদ্রাস্ফীতি নিশ্চিত করতে ঐতিহাসিকভাবে এই প্রক্রিয়া কার্যকর। কিন্তু আফগানিস্তানের ডলারপ্রধান রিজার্ভে তার নিজের অ্যাকসেস বা অধিগম্যতা না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সংকটপূর্ণ বাজারকে স্থিতিশীল করার বিষয়ে ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। আমদানির ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে আফগান অর্থনীতি স্বাভাবিক সময়েও মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরশীল থাকে। বৈদেশিক মুদ্রার ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং ডলারের বিপরীতে আফগানির ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়নের ফলে আমদানি করা পণ্যের মূল্য গত কয়েক মাসে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ইতিমধ্যেই যুদ্ধ এবং কোভিড-১৯ মহামারিতে আফগানিস্তান বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। দেশটির বাজারে ডলারের তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। আমদানিকারকদের পক্ষে তাঁদের চালানের বিপরীতে অর্থ সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

মার্কিন সরকারের সামনে এখন দুটি পছন্দের বিষয় আছে। একটি হলো সেই পথে চলতে থাকা, যা লাখ লাখ মানুষকে সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। আরেকটি হলো আফগান জনগণকে সাহায্য করতে যা করার দরকার, দ্রুত তাই করা।

খাদ্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে এবং মুদিদোকানগুলো তাদের গুদামে আগের মতো মাল তুলতে পারছে না। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং খাত ধসে পড়ার আশঙ্কা এখন তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এতে লোকেরা তাদের সঞ্চয় তুলে নিচ্ছে এবং পণ্যের দাম আরও বাড়বে—এমন আশঙ্কায় যত দূর সম্ভব নিত্যপণ্য কিনে ঘরে জমা করছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটা বড় অংশ বন্ধ হয়ে গেছে।

যদিও এই অবস্থা প্রতিটি আফগানকে বিপর্যস্ত করে ফেলবে, কিন্তু কাবুলের সরকার সে পরিস্থিতির কথা এড়িয়ে যেতে থাকবে। তারা দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে থাকবে এবং যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের স্থগিত করা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সচল করবে, ততক্ষণ আফগান সরকারের কথা সে দেশের মানুষ বিশ্বাস করবে। মার্কিন সরকারের সামনে এখন দুটি পছন্দের বিষয় আছে। একটি হলো সেই পথে চলতে থাকা, যা লাখ লাখ মানুষকে সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। আরেকটি হলো আফগান জনগণকে সাহায্য করতে যা করার দরকার, দ্রুত তাই করা। এ ক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব, যুক্তরাষ্ট্র সেন্ট্রাল ব্যাংক অব আফগানিস্তানকে আফগানিস্তানের বৈদেশিক রিজার্ভ থেকে প্রতি মাসে নিরীক্ষণ এবং শর্তসাপেক্ষে ১৫ কোটি ডলার ছাড় দিতে পারে।

আফগানিস্তানে এখনো কার্যক্রম চালাচ্ছে, এমন একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা সংস্থার মাধ্যমে এই অর্থ কীভাবে ব্যবহার করা হবে তা যুক্তরাষ্ট্র যাচাই করতে পারবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে হওয়া লেনদেনগুলো একটি ইলেকট্রনিক এক্সচেঞ্জে সঞ্চালিত হবে, যেখানে প্রতিটি লেনদেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড করা হবে। যদি যুক্তরাষ্ট্র ওই অর্থের কোনো অপব্যবহার খুঁজে পায়, তবে তারা যেকোনো মুহূর্তে তহবিল কেটে দিতে পারবে। যেহেতু আফগানিস্তান সরকারের সবচেয়ে বড় অঙ্কের অর্থ নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভে জমা হয়, সেহেতু এটি উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আফগান সরকার থেকে স্বাধীন একটি সত্তা। কয়েক দশক ধরে এটি মূল্য স্থিতিশীলতা অর্জন ও বজায় রাখতে এবং অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। এটি আফগানিস্তানের জন্য আশা ও সমৃদ্ধির আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু যদি এই ব্যাংককে তার রিজার্ভে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়া হয়, তবে এটি সব হারিয়ে ফেলতে পারে।

আফগানরা তাদের ভূমিতে নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ হওয়ার যোগ্য। কিন্তু এই মুহূর্তে মার্কিন নীতি তাদের আটকে রেখেছে। আমরা আশা করব, অচিরেই যুক্তরাষ্ট্র সেই আটকে রাখা ব্যাংক হিসাব খুলে দেবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ড. শাহ মেহরাবি সেন্ট্রাল ব্যাংক অব আফগানিস্তানের সুপ্রিম কাউন্সিলের একজন সদস্য ও আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্টের প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা