অর্থনীতির কঠিন ও ভূরাজনীতির জটিল সময়

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ এসব চাপ কতটা ও কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেটা সত্যই একটি বড় প্রশ্ন।

বিশ্ব একটা অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়েছে। দেশে দেশে মন্দার আশঙ্কা করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান ডেভিড ম্যালপাস। এর সঙ্গে তিনি যা যুক্ত করেছেন, তা ভয়ের। বলেছেন, ‘মন্দা এড়ানোর পথ খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য কঠিন।’ এর আগে এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে এ বছরের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল ৩ দশমিক ২। মে মাসে সেই প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস পুরো ১ শতাংশ কমিয়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ করা হয়েছে। মন্দার ঝুঁকি বাড়ার কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা ও ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান মরগ্যান স্ট্যানলির অর্থনীতিবিদেরাও। তাঁরা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমরা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বিশৃঙ্খল এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন, এমন এক সময়ের মধ্যে রয়েছি। বিশ্বমন্দার সব উপাদানই বর্তমানে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে।’ এ মন্দা আগামী দুই বছর চলতে পারে, এমন পূর্বাভাস দিয়েছে ব্যাংক অব আমেরিকা, ডয়চে ব্যাংকসহ ওয়াল স্ট্রিট সংস্থাগুলো।

যে মন্দা বৈশ্বিক, তার প্রভাব থেকে শুধু বাংলাদেশ কেন, যেকোনো দেশেরই দূরে থাকা কঠিন। বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি কতটুকু বা এমন একটি পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ কতটা অনুকূল অবস্থায় রয়েছে, এসব নিয়ে আমাদের অর্থনীতিবিদেরা কথা বলতে শুরু করেছেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে মতভেদ আছে, কিন্তু ঝুঁকি যে একটা আছে এবং এর চাপ যে বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে, তা নিয়ে কারও ভিন্নমত আছে বলে মনে হয় না।

এই যে বৈশ্বিক মন্দা, এর পেছনের মূল ও সবচেয়ে আলোচিত কারণ হচ্ছে, ইউক্রেনে রুশ হামলা এবং এরপর ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধ। আধুনিক যুগে যুদ্ধ শুধু কোনো একটি অঞ্চলে বা শুধু সংঘাত-সংঘর্ষে আটকে থাকে না। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাসী তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এ যুদ্ধ বিশ্বকে আবার নতুন করে দুটি শিবিরে বিভক্ত করার পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় নানা পাল্টাপাল্টি অবরোধ অর্থনৈতিক যুদ্ধেরও সূচনা ঘটিয়েছে। বিভক্তি ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের এ সময়ে কোন দেশ কোন পক্ষে, তা বিশ্বরাজনীতির এক বড় হিসাব-নিকাশে পরিণত হয়েছে। এ রকম একটি বিশ্ব পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতো দেশকে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক চাপের মুখে ফেলছে, তেমনি ভূরাজনীতিতেও পক্ষ-বিপক্ষের জটিল হিসাব-নিকাশের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।

বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানি শুধু বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ দিয়ে চলে না। অর্থ থাকলেই কোনো দেশ থেকে পণ্য আনা যায় না বা রপ্তানিযোগ্য পণ্য থাকলেই তা কোনো দেশে রপ্তানি করা যায় না। এর সঙ্গে দেশগুলোর রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক, স্বার্থ, বিশ্বরাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষ, বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা নীতি, বিধিনিষেধ ও শর্ত কাজ করে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এ পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে ফেলেছে। বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মুখে দাঁড়িয়ে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হলে বাংলাদেশকে আমদানি ঠিক রাখতে হবে। আবার এই আমদানি ব্যয় মেটাতে রপ্তানিও ধরে রাখতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতির পক্ষগুলো বাংলাদেশকে দুটি ক্ষেত্রেই চাপে ফেলতে পারে নিজেদের পক্ষে টানার জন্য।

বিশ্বরাজনীতির কোনো একটি পক্ষ এককভাবে বাংলাদেশের সব স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া পূরণের পথ ধরা মানে চীনকে খেপিয়ে তোলা। আবার চীনের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিল রেখে কিছু করতে যাওয়া মানে শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমকে খেপানো নয়, আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতও তাতে অস্বস্তিতে পড়বে। বিশ্বমন্দার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ ভারসাম্য রক্ষার কাজটি কীভাবে করবে, সেটা সত্যই একটি বড় প্রশ্ন। নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতার সংকটে থাকা সরকারে পক্ষে কাজটি আরও কঠিন ও জটিল

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ এসব চাপ কতটা ও কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেটা সত্যই একটি বড় প্রশ্ন।

আমদানির বাজার বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের মোট আমদানি করা পণ্যের ৩৩ শতাংশ আসে চীন থেকে, ২৫ শতাংশের কাছাকাছি আসে ভারত থেকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৬৩ শতাংশ হয় পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী ও ঋণদাতাদের মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে জাইকা, এডিবি, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ; তেমনি রয়েছে চীন ও রাশিয়ার মতো দেশ। বাংলাদেশের জন্য এর মধ্য থেকে বাছাই করার মতো কোনো পক্ষ খুঁজে পাওয়া গেল কি?

এটা স্পষ্ট যে ট্রাম্প-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বরাজনীতিতে তার নেতৃত্ব ফিরে পেতে চাইছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রের সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। ন্যাটো বা ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর নতুন করে এবং জোরালোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওবামার আমলে তাঁর এশিয়া নীতির আওতায় যে কমপ্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (সিপিটিপিপি) চুক্তি হয়েছিল, ট্রাম্প সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে আসেন। বাইডেনের আমলে যুক্তরাষ্ট্র আবার সেখানে ফিরছে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটি (আইপিইএফ) চুক্তি নিয়ে। চীনের নেতৃত্বে গঠিত রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) চুক্তিকে টেক্কা দিতেই যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগ। খবর হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৩টি দেশ নিয়ে গঠিত এই অর্থনৈতিক জোটে বাংলাদেশকে পেতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

শুধু অর্থনৈতিক জোট নয়, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সামরিক সহযোগিতামূলক জোট ও নানা উদ্যোগেও যোগ দিক বাংলাদেশ। আমাদের মনে আছে, বছর দুয়েক আগে চীনের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কোয়াডে যোগ দিলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘যথেষ্ট খারাপ’ হবে।

বর্তমান রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের মুখে অত কঠোরভাবে না হলেও, নতুন করে সতর্কবার্তা শোনা গেছে। সম্প্রতি এক সেমিনারে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের এ অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু ঘটেছে। অকাস, কোয়াড ও আইপিইএফ ছাড়াই এক দশক ধরে আমরা ভালো করছি। হঠাৎ এ বিষয়গুলো এখন আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এসব ছাড়াই আমরা আরও ভালো করব। কাজেই আমাদের এসবে যোগ দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নিতে হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলো চীনের কাছে কতটা সংবেদনশীল, তা এসব মন্তব্যে টের পাওয়া যায়।

যুক্তরাষ্ট্র যদি মনে করে এসব চুক্তিতে বাংলাদেশকে যুক্ত করা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে তারা বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির পথ বেছে নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুবিধার দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করার নানা বাস্তবতা দেশটিতে তৈরি হয়ে আছে। পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, গণতান্ত্রিক পরিসরের ক্রমাগত সংকোচন, সংবাদমাধ্যমের ওপর দমনমূলক নানা খড়্গ, নাজুক মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন ও গুম-খুনের অভিযোগ—এগুলোকে তারা সহজেই চাপ সৃষ্টির কাজে লাগাতে পারবে।

মানবাধিকার ইস্যুতে র‍্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। এ নিষেধাজ্ঞা যে এমনি এমনি উঠবে না, তা আবার টের পাওয়া গেল বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কথায়, ‘র‌্যাবের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সুরাহায় সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা ও বাহিনীটিকে জবাবদিহির আওতায় আনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। জবাবদিহি ছাড়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই।’ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা ও উন্নয়নবিষয়ক তহবিল থেকে আর্থিক সুবিধা পেতে হলে যে শ্রম অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে, সেই কথাও তিনি জানিয়ে রেখেছেন একই অনুষ্ঠানে।

সামনে নির্বাচন। পিটার হাস রাখঢাক না করেই বলেছেন, ‘আনুষ্ঠানিক না হলেও বাংলাদেশে যে নির্বাচনের প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে, পত্রিকায় চোখ বোলালেই সেটা দেখতে পাই। তাই এখন থেকেই (নির্বাচনের বিষয়ে) আমাদের দিক থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন হচ্ছে কি না, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখাটা জরুরি।’

আরও পড়ুন

এশিয়া সফরে এসে বাইডেনের অর্থনৈতিক জোট আইপিএফ গঠনের ঘোষণার মধ্যে এটা পরিষ্কার যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এশিয়ার গুরুত্ব বাড়ছে। বিশ্বরাজনীতিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে কৌশলগত প্রতিযোগিতা চলছে, সেখানে অর্থনীতি ও নিরাপত্তা দুটিই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কোনো বিশ্লেষকের ধারণা, বাইডেন যখন নিরাপত্তা থেকে এশিয়ার বাজারের দিকে নজর দিচ্ছেন, তখন চীন অর্থনীতি থেকে নিরাপত্তার দিকে ঝুঁকছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলে কোয়াড গঠনের পর চীন নিরাপত্তাকে তাদের নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচনা করছে। গত ২১ এপ্রিল বিওএও ফোরামে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় যেসব নিরাপত্তা উদ্যোগের কথা বলেছেন, তাতে চীনের তরফে সামরিক সহযোগিতার উদ্যোগ ও জোট গঠনের আকাঙ্ক্ষা টের পাওয়া যায়। বোঝা যাচ্ছে, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অর্থনৈতিক তৎপরতা মোকাবিলায় সামনের দিনগুলোতে চীনের তরফেও পাল্টা উদ্যোগ আসতে পারে।

বিশ্বরাজনীতির কোনো একটি পক্ষ এককভাবে বাংলাদেশের সব স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া পূরণের পথ ধরা মানে চীনকে খেপিয়ে তোলা। আবার চীনের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিল রেখে কিছু করতে যাওয়া মানে শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমকে খেপানো নয়, আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতও তাতে অস্বস্তিতে পড়বে। বিশ্বমন্দার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ ভারসাম্য রক্ষার কাজটি কীভাবে করবে, সেটা সত্যই একটি বড় প্রশ্ন। নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতার সংকটে থাকা সরকারে পক্ষে কাজটি আরও কঠিন ও জটিল। জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও নির্বাচনে জয়লাভ—এই হিসাব-নিকাশে কোনো একটি ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে।

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

[email protected]