অলিম্পিক কমিটির ভাবনায় নয়, হিরোশিমা আছে মানুষের হৃদয়ে

জাপানে এখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও চলছে অলিম্পিকের ডামাডোল। এ ডামাডোল অনেকটাই যেন আড়ালে চলতে থাকা উচ্ছ্বাস। ভাইরাসের সংক্রমণ দর্শকদের মাঠে উপস্থিত থেকে খেলা উপভোগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করলেও স্বাগতিক জাপান এখন পর্যন্ত প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাওয়া সাফল্য দেখিয়ে যেতে থাকায় দেশটিতে অনেকেই এতে উৎফুল্ল এবং ঘরে বসে টেলিভিশনের পর্দায় অলিম্পিকের নানা রকম প্রতিযোগিতা অনেকেই প্রতিদিন দেখছেন।

অলিম্পিক ৫৭ বছরের বিরতির পর আবারও টোকিওতে ফিরে এলেও আগস্ট মাসের শুরুর দিকের ভিন্ন দুটি দিন অন্য এক কারণে জাপানে নিয়মিতভাবে পালন করা হয়। ৭৬ বছর আগে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরকে আণবিক বোমা হামলার শিকার হতে হয়েছিল। নৃশংস সেই হামলায় তাৎক্ষণিক মৃত্যু সম্মিলিতভাবে দুই লাখ ছাড়িয়ে গেলেও তেজস্ক্রিয় রশ্মির বিকিরণ থেকে মানুষের অসুস্থ হয়ে পড়া এর পরেও দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকায় সে সময়ে যাঁরা মাতৃগর্ভে ভূমিষ্ঠ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁদের অনেকেও পরে দীর্ঘকালীন অসুস্থতায় ভুগেছেন। এ ছাড়া বোমা হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষের মধ্যে যাঁরা এখনো জীবিত, তাঁদের নানা রকম শারীরিক অসুস্থতায় প্রতিনিয়ত ভুগতে হচ্ছে।

এ কারণে বলা যায়, সেই অভিজ্ঞতা বলছে, ১৯৪৫ সালে আণবিক বোমা হামলার মধ্য দিয়ে নতুন যে ভয়ংকর আণবিক যুগে বিশ্বের প্রবেশ, সেদিনের সেই অশুভ কীর্তিকলাপের জন্য মানুষ অনুতপ্ত না হলে অজানা পথের দুয়ার খুলে দেওয়া আণবিক এই যুগ কোন অন্ধকার জগতের দিকে আমাদের নিয়ে যেতে পারে, তার অনেকটাই গত ৭৫ বছরে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

বিশ্বের কয়েকটি দেশের কাছে যে পরিমাণ পরমাণু অস্ত্রের মজুত এখন আছে, তা দিয়ে আমাদের এই বিশ্বকে কয়েকবার ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। আত্মবিধ্বংসী এই অস্ত্রের ভান্ডার যে কেবল বেড়েই চলেছে শুধু তা–ই নয়, বাড়ছে এ রকম অস্ত্রের মালিক হয়ে বসা রাষ্ট্রের সংখ্যাও। ফলে কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে অস্ত্র মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পরিণতি কী হতে পারে, তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এ কারণেই প্রতিবছর ৬ ও ৯ আগস্ট হিরোশিমা ও নাগাসাকি—দুই শহরের অতীত অভিজ্ঞতাকে স্মরণ করা পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের গুরুত্ব বিশ্ববাসীকে আবারও মনে করিয়ে দেয়। আর শান্তির বার্তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার এই প্রক্রিয়ার বিশেষ করে আণবিক বোমা হামলার শিকার যাদের হতে হয়েছিল, হিবাকুশা নামে পরিচিত সেই প্রজন্মের এখনো যাঁরা বেঁচে আছেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাঁরা আজও পালন করে চলেছেন।

১৯৪৫ সালে আণবিক বোমা হামলার মধ্য দিয়ে নতুন যে ভয়ংকর আণবিক যুগে বিশ্বের প্রবেশ, সেদিনের সেই অশুভ কীর্তিকলাপের জন্য মানুষ অনুতপ্ত না হলে অজানা পথের দুয়ার খুলে দেওয়া আণবিক এই যুগ কোন অন্ধকার জগতের দিকে আমাদের নিয়ে যেতে পারে, তার অনেকটাই গত ৭৫ বছরে পরিষ্কার হয়ে গেছে

অলিম্পিকের আয়োজন চলতে থাকা অবস্থায় এবারের হিরোশিমাবার্ষিকী অনেকটাই যেন আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তবে হিরোশিমার হিবাকুশাদের পাশাপাশি শহর কর্তৃপক্ষও অলিম্পিকের আয়োজনকে শান্তির বাণী পরোক্ষে ছড়িয়ে দেওয়ার চমৎকার এক সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন এবং সে কারণেই আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) কাছে এ রকম অনুরোধ এদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল যে ৬ আগস্ট বোমা হামলা হওয়ার সঠিক সময়, সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে ক্রীড়াবিদ, আয়োজক এবং অলিম্পিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই যেন নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে মুহূর্তের নীরবতা পালন করেন।

হিরোশিমা নগর প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইওসির প্রেসিডেন্ট টমাস বাখকে উদ্দেশ করে লেখা একটি চিঠিতে ঠিক এ অনুরোধ প্রশাসন জানায়। গত মাসের ২৮ তারিখে বাখকে লেখা চিঠিতে হিরোশিমার মেয়র কাজুমি মাতসুই উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমরা চাই অ্যাথলেট এবং কর্মকর্তারা যেন কোনো একপর্যায়ে হলেও আণবিক বোমার বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারেন। ফলে হিরোশিমায় আয়োজিত শান্তি স্মারক অনুষ্ঠানের চেতনার সঙ্গে যোগ দিয়ে অলিম্পিক ভিলেজ কিংবা অন্য যেকোনো জায়গায় নীরব প্রার্থনায় অংশ নেওয়ার আহ্বান আপনি এদের প্রতি জানাবেন কি?’

উল্লেখ্য, গত ১৬ জুলাই বাখ হিরোশিমা সফর করে সেখান থেকে অলিম্পিক চলাকালে অস্ত্রবিরতি মেনে চলার আহ্বান বিশ্বের সংঘাতময় এলাকার নেতৃবৃন্দের প্রতি জানিয়েছিলেন। ফলে হিরোশিমার মেয়র হয়তো ধরে নিয়ে থাকবেন, শান্তির প্রতি বাখ অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে মেয়রের সেই হিসাব বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়নি।

হিরোশিমাবার্ষিকী এগিয়ে আসার আগে নগর কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে মেয়র সেই অনুরোধের কোনো জবাব আইওসির কাছ থেকে পাননি। অন্যভাবে বলা যায়, আইওসি হিরোশিমার মেয়রের সেই অনুরোধ ফাইলবন্দী করে রেখেছে এবং এর উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করেনি।

জাপানের সংবাদমাধ্যমে হিরোশিমার সেই আবেদন নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার পর টোকিও অলিম্পিকের আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত জানানো হয় যে হিরোশিমার অনুরোধ আইওসি পেয়েছে এবং এ রকম সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি গ্রহণ করেছে যে অলিম্পিকের ভেন্যুতে কিংবা অন্য কোথাও মুহূর্তের নীরবতা পালনের অনুরোধ ক্রীড়াবিদ ও অলিম্পিক কর্মকর্তাদের প্রতি জানানো হবে না।
কেন জানানো হবে না, তারও একটি ব্যাখ্যাও আয়োজক কমিটি দিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ৮ আগস্ট অলিম্পিকের সমাপনী অনুষ্ঠানে ইতিহাসের বিভিন্ন ট্র্যাজিক ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ করার একটি অংশ অন্তর্ভুক্ত রাখা হবে, আইওসির নীতিমালা অনুসরণ করে যেটা ঠিক করে নেওয়া হয়েছে।

এ কোন নীতিমালা, যেখানে আণবিক বোমা হামলার মতো মর্মান্তিক ঘটনার বিষয়টি স্মরণ করতে ইতিহাসের সব রকম ট্র্যাজেডিকে টেনে এনে বিশেষ সেই ঘটনার গুরুত্বকে খাটো করতে হয়? শক্তিশালী কেউ যেন অসন্তুষ্ট না হয়, আইওসি নিশ্চিতভাবেই তা দেখতে অনেক বেশি আগ্রহী, হিরোশিমার মর্মান্তিকতা স্মরণ করে শান্তির বাণী বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে নয়।

তবে এতে অবশ্য মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। আণবিক বোমা হামলার শিকার হওয়া দেশ জাপানের রাজধানীর অলিম্পিক ভেন্যুতে হিরোশিমার নিহত মানুষকে স্মরণ করা না হলেও আমরা জানি, সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ সেদিন তাঁদের স্মরণ করবেন এবং মানুষের শুভবুদ্ধি যেন জাগ্রত থাকে, সে কামনা বুকে ধারণ করে রেখে নীরব প্রার্থনায় যোগ দেবেন।

টেকিও, ৫ আগস্ট, ২০২১

মনজুরুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক