অলিম্পিকের উদ্দেশ্য কী

জাপানের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ চায় যে গেমস বাতিল হোক অথবা স্থগিত হোক
ছবি: রয়টার্স

জুডোয় অলিম্পিক বিজয়ী এবং জাপানের অলিম্পিক কমিটির নির্বাহী সদস্য কাওরি ইয়ামাগুচি সম্প্রতি এক বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মহামারির এই সময়ে জাপান এমনিতেই কোণঠাসা অবস্থায় আছে, এর মধ্যে আবার অলিম্পিক আয়োজন! এসব অলিম্পিক কিসের জন্য আয়োজন করা হয়? কাদের জন্য আয়োজন করা হয়? এই খেলার কোনো অর্থ হয় না। আমার বিশ্বাস, এর মধ্যেই আমরা খেলাটি বাতিল করার সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলেছি।’

তিনি যে একা এ ধরনের কথা বলছেন, তা নয়। জাপানের এক শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এ মুহূর্তের অলিম্পিক আয়োজন নতুন করে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব শুরু করে দিতে পারে। এতে করে বর্তমান কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। জাপানের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ চায় যে গেমস বাতিল হোক অথবা স্থগিত হোক। তারপরও যদি অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে হবেও, তাহলে বেশির ভাগ খেলা অনুষ্ঠিত হবে ফাঁকা স্টেডিয়ামে। এতে শুধু বিপুল পরিমাণ অর্থেরই অপচয় হবে, আর কিছু হবে না।

ইয়ামাগুচি যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছেন। কার জন্য আসলে এ অলিম্পিক? সব ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ তো খেলোয়াড়দের রয়েছেই। শুধু টেলিভিশনের দর্শকদের বিনোদিত করার জন্য জাপানিদের অর্থ ব্যয় করা উচিত নয়। অলিম্পিক গেমস সম্ভবত জাপানের সেসব রাজনীতিবিদের জন্য, যাঁরা আশা করেছিলেন যে অলিম্পিক আয়োজন তাঁদের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে। অথবা এ আয়োজন ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) নাদুসনুদুস বিড়ালদের জন্য।

ব্যারন পিয়ের দা কুবার্তিন ১৮৯৬ সালে এথেন্সে আবার যখন খেলাটি শুরু করেছিলেন, তখন থেকেই ‘অলিম্পিক কিসের জন্য’, এ প্রশ্ন অলিম্পিক গেমসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ব্যারনের মতো সে সময়ের ফরাসি রক্ষণশীলেরাও জাতীয় শৌর্যবীর্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিশেষ করে ১৮৭১ সালে প্রুশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর তাঁদের এ উদ্বেগ বাড়ে। তিনি ভেবেছিলেন, ফরাসি শৌর্যবীর্যের যেসব ত্রুটি রয়েছে, তা সারানোর উপযুক্ত উপায় হতে পারে এসব প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলা। কুবার্তিন আরও আশা করেছিলেন, এ ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান ফরাসি শৌর্যবীর্য পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি বিশ্বের জনগণকে একত্র করবে এবং বিশ্বের বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করবে।

ডানপন্থী চিন্তাবিদ চার্লস মাউরাস প্রথম দিকে কুবার্তিনের এ চিন্তাভাবনাকে উপহাস করেছিলেন। তিনি বৈশ্বিক বন্ধুত্বের ধারণাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে তাঁর মন ঘুরে গিয়েছিল। মাঠে প্রতিযোগিতা করা বিভিন্ন জাতির মানুষেরা একে অপরকে ঘৃণা করবে, এটি তাঁর দৃষ্টিতে ছিল খুবই উৎকৃষ্ট একটি ব্যাপার।

শেষ পর্যন্ত কুবার্তিনের আদর্শ কিংবা মাউরাসের হতাশা কোনোটাই হালে পানি পায়নি। তবে এ কথাও ঠিক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অলিম্পিক গেমস বেশ কিছু ভালো কাজও করেছে। ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিক জাপানিদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওই অলিম্পিক শুধু অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের জন্যই নয়, বরং রাজনৈতিক সম্মানের প্রতীক হিসেবেও জাপানিদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ।

১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। কয়েক দশকের কঠোর সাম্রাজ্যবাদী জাপানি শাসন, বিধ্বংসী কোরিয়ান যুদ্ধ এবং কয়েক দশকের সামরিক স্বৈরশাসনের পর দক্ষিণ কোরিয়া প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন, মুক্ত সংবাদমাধ্যম এবং আশাবাদী এক তরুণসমাজ নিয়ে বিশ্বের বুকে আবির্ভূত হয়েছিল। এসব কারণে কোরীয়রা আন্তর্জাতিক পাদপ্রদীপের আলোয় আসার যোগ্য ছিল। সিউল গেমস সেই সুযোগ এনে দিয়েছিল।

কিন্তু ২০১৪ সালে রাশিয়ায় যে শীতকালীন অলিম্পিক উৎসব হয়েছিল, সেটা ভ্লাদিমির ‍পুতিন আয়োজন করেছিলেন একটি কৃত্রিম বরফাচ্ছাদিত রিসোর্টে। এ ধরনের আয়োজন পুতিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনেরই বহিঃপ্রকাশ। আর ২০০৮ সালে চীনের বেইজিংয়ে যে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ফুটে উঠেছিল চীনা জাতীয়তাবাদ। এর আগে ২০০৪ সালে গ্রিসের মতো দরিদ্র দেশগুলোকে বিশাল ঋণের বোঝা আর আগাছাভর্তি স্টেডিয়াম দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

অলিম্পিক গেমস প্রকৃতপক্ষে আইওসির জন্য, পৃষ্ঠপোষকদের জন্য, উঠতি ধনীদের জন্য এবং কখনো কখনো দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের জন্য এক বিশাল বাণিজ্যের আধার। তাদের জন্যই অলিম্পিক। হাজার হাজার অলিম্পিক কর্মকর্তা এ বছর টোকিওর বিলাসবহুল হোটেলের লবিগুলোয় ভিড় করবেন এবং এ অলিম্পিক শেষ হওয়ার পর তাঁরা চলে যাবেন অন্য জায়গায়, যেখানে পরবর্তী অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে। আর এখানে বিশাল বিশাল স্টেডিয়াম পড়ে থাকবে রিক্ত ও শূন্য হয়ে। এমনটা হওয়া কখনোই উচিত নয়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইয়ান বুরুমা দ্য চার্চিল কমপ্লেক্স: দ্য কার্স অব বেইজিং স্পেশাল, ফ্রম উইনস্টন অ্যান্ড এফডিআর টু ট্রাম্প অ্যান্ড ব্রেক্সিট বইয়ের লেখক