অশ্রু ঝরছে আশুড়ার বিলে

রক্তও ঝরতে পারত, ঝরেনি। ধন্যবাদ স্থানীয় প্রশাসন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে। তাঁরা তাঁদের চরম সহনশীলতা ও উপস্থিত বুদ্ধির যে প্রমাণ দিয়েছেন, তাকে সাধুবাদ জানাতেই হবে। সাধারণ মানুষের এই প্রতিরোধ–প্রচেষ্টার খবর জাতীয় সংবাদের মর্যাদা পায়নি। গুলিতে মানুষের প্রাণহানি হলে হয়তো সে মর্যাদা পাওয়া যেত। কিন্তু সেটা হতো আরও দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত।

দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায় আশুড়ার বিলের পানি ধরে রাখার জন্য ২০১৯ সালে প্রায় ১৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ব্যয়ে একটা আড়াআড়ি বাঁধ বা কথিত ক্রসড্যাম নির্মাণ করা হয়। ফলে এই বিলে রবি মৌসুমে চাষবাস করে যেসব ভূমিহীন পরিবার বেঁচেবর্তে থাকত, তাদের জীবনধারণের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ২০ হাজার মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে এই বাঁধ। দেনদরবারে কোনো ফল না পেয়ে নিরুপায় ভূমিহীনেরা ১৩ জানুয়ারি সোমবার রাতে বাঁধের দুটি জায়গা কেটে দেন।

পরদিন মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) সকালে খবর পাওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিনাজপুর, বিএডিসি নির্বাহী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ), সহকারী কমিশনার (ভূমি), নবাবগঞ্জ বন কর্মকর্তা পুলিশসহ ঘটনাস্থল গিয়ে ভাড়াটে শ্রমিক দিয়ে কেটে দেওয়া বাঁধ পুনর্নির্মাণ শুরু করেন। ক্ষতিগ্রস্ত সংক্ষুব্ধ এলাকাবাসী আবার ছুটে এসে বাঁধ বন্ধের কাজে বাধা দেন। ইতিমধ্যে মেরামত করা অংশ আবার কেটে দেন। আশুড়ার বিলের পাশে হরিপুর এলাকায় এসব ঘটনা ঘটে। হাজার হাজার নারী–পুরুষ আর শিশুদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই এগিয়ে আসা আর তাঁদের মুহুর্মুহ স্লোগানে হকচকিত হয়েই হোক বা নিজেদের শক্তির কথা ভেবেই হোক, প্রশাসন শক্তি প্রয়োগে বিরত থাকে। তারা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আশপাশের থানার সহযোগিতা চান। পরে পার্শ্ববর্তী বিরামপুর ও দিনাজপুর পুলিশ লাইনস থেকে এবং র‌্যাবের সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে পরিস্থিতি ‘শান্ত’ হয়। উপজেলা চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে আরও আলোচনার আশ্বাস দিয়ে গ্রামবাসীকে নিবৃত করা হয়। গ্রামবাসী ফিরে গেলে প্রশাসন ব্রিটিশের শেখানো পথেই হাঁটে। জনগণের সমবেত হওয়ার অধিকার রদ করে জারি করে ১৪৪ ধারা। মামলা হয় গ্রামবাসীদের আসামি করে। গ্রেপ্তার চালায়। জামিন না-জামিনের চক্রে ফেলে দেওয়া হয় বিলের জমিতে দুমুঠো ফসল ফলিয়ে বেঁচে থাকতে চাওয়া অনেক মানুষকে।

বাঁধের কাটা অংশ মাটি ফেলে গাছের গুঁড়ি ফেলে আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। আশুড়ার বিলের যে প্রায় ১৯ হেক্টর জমিতে আমন, ইরি আর রবিশস্যের চাষ হতো, তা আবার পানিতে তলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় ২০ হাজার মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। ১৯৪৪ সাল থেকে হরিপুর এলাকার গ্রামবাসী এই জমিগুলো ভোগদখল করে আসছিল। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ব্যয়ে বিলের পানি ধরে রাখার জন্য বৃহত্তর বগুড়া ও দিনাজপুর জেলা ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সাবমার্জড ওয়্যার (আড়াআড়ি বাঁধ যাকে ভুলভাবে অনেক সময় ক্রসড্যাম বলা হয়) নির্মাণ করে বিএডিসি। তবে এই আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন স্থানীয় লোকজন। তাঁদের আপত্তি কেউ কানে তোলেনি।

কেন এই কোন্দল
সংসদ সদস্য বিল এলাকায় কাছেই গড়ে তুলেছেন আয়েশি ছুটি কাটানোর দালান ‘স্বপ্নপুরী’। বিলের পানি বন্ধ করে বিলের ভেতর আঁকাবাঁকা কাঠের সেতু বানিয়ে বিনোদন কেন্দ্র চালু করেছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা চেয়ারম্যনের ধারণা, তাঁদের বিনোদন কেন্দ্র মানুষের বেশি পছন্দ হচ্ছে, সাংসদের ‘স্বপ্নপুরীতে’ আর মানুষ যাচ্ছে না। তাই সংসদ সদস্য লোকজন দিয়ে বাঁধ কাটার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করছেন। সংসদ সদস্য অবশ্য এসব অভিযোগ বাতিল করে দিয়েছেন (প্রথম আলো, উত্তরাঞ্চল জানুয়ারি ১৫)। তবে উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাংসদের যে কোনো মধুর সম্পর্ক নেই, সেটা এলাকার মানুষ খুব ভালো করেই জানেন। রাজায় রাজায় যুদ্ধ চলে আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। খেটে খাওয়া মানুষের জনপদ এখন পুলিশের হাওলায়।

বিল না থাকলে তাই নদীও থাকে না
দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ সদরের এক কিলোমিটার উত্তর–পশ্চিমে শালবন। এই শালবনের উত্তর পাশ ঘেঁষেই বিশাল আশুড়ার বিলের অবস্থান। বিলের আয়তন ২৫১.৭৮ হেক্টর। বাংলাদেশের বিল–হাওর–বাঁওরের সঙ্গে নদী ও সংশ্লিষ্ট পানিপ্রবাহগুলোর একটা সম্পর্ক রয়েছে। ভরা বর্ষায় এরা নদীর ভার কমিয়ে নিজে অতিরিক্ত পানি ধারণ করে। মাছেরা স্রোতোশীল আর ঘোলা জলের বাইরে বিলে এসে তাদের প্রজননের প্রয়োজনীয় কাজটা সেরে নেয়। আবার বর্ষার শেষে নদীতে পানির টান পড়লে বিল–হাওর–বাঁওর নদীর নাব্যতা রক্ষার দায়িত্ব নেয়। টানের সময় এরা নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। বিল না থাকলে তাই নদীও থাকে না।

প্রতিটি বিলই যুক্ত থাকে নদীর সঙ্গে, বিল–বাঁওর–হাওর বেঁধে দিলে সে তার প্রাণের আত্মীয় নদীকে হারাবে। হারাবে নিজের বেঁচে থাকার রসদ আর প্রয়োজন। আশুড়ার বিলও তার চারপাশের নানা জলস্রোত, নদী আর নালার সঙ্গে যুক্ত আছে বা ছিল। প্রায় ৮০টি মুখে বা ৮০টি নালার মাধ্যমে ঘটেছে সেই মিলন। আশুড়ার নামকরণের পেছনে এই আশি মিলনপথের একটি ভূমিকা আছে। আশি পথে চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেছে বলে এর নামকরণ হয়েছে আশুড়ার বিল। বিশাল এই বিলের গভীরতা, তলানি এবং চারপাশ–বেষ্টিত শালবন একসময় নানা কিংবদন্তির জন্ম দিয়েছে। বিলের মধ্যে নানা কারণে বিভিন্ন জায়গার নাম হয়েছে পাতিলদহ, বুড়িদহ, পীরদহ, মুনির আইল, কাজলাদহ, পালাদহ, মুনির থান ইত্যাদি। একসময় এ বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এ বিলের বোয়াল ও পাবদা মাছ খুবই সুস্বাদু। বাঁধ দিলে বিল তার প্রাণসম্পদ হারাবে।

যেকোনো প্রাকৃতিক প্রবাহের গায়ে হাত দেওয়ার আগে দেখতে হবে কী কী সম্ভাব্য পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটতে পারে, আর তার কতটা কীভাবে এড়ানো সম্ভব? আশুড়ার বিলের ক্ষেত্রে কি সেটা করা হয়েছিল? বিলের গায়ে হাত দেওয়ার জন্য যেসব মানুষের পেটে লাথি পড়বে, তাদের জন্য কি কোনো পরিকল্পনা আছে? খাসজমির দোহাই দিয়ে ভূমিহীনদের চাষবাসের অধিকার চট করে কেড়ে নেওয়া যায় কি? যে যমুনেশ্বরী নদী এত দিন আশুড়ার বিলের সঙ্গে পানি ও মাছ লেনদেন করত, পানি পৌঁছে দিত করতোয়া ও বাঙ্গালী নদীতে, তার কী হবে? বিল বলে কি নদী কমিশন একটু রা–ও করবে না?

পর্যটনের নামে নিজেদের ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি জাহির করতে একটি পুরো বিল হাপিশ হয়ে যাবে, আর আমারা ভানুর মতো বলতে থাকব, ‘দেখি না কী হয়’? এসব প্রশ্নের উত্তর খুবই জরুরি। কিন্তু তার চেয়ে জরুরি মামলা, ১৪৪ ধারা, ধরপাকড় ও মারধর বন্ধ করা।

লেখক: গবেষক
[email protected]