অসমতা ও মার্কিন শিশু

জোসেফ ই স্টিগলিৎজ
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ

শিশুরা এক বিশেষ দলভুক্ত, এটা বহুকালের রীতি। তাদের মা-বাবা কে হবেন, সেটা তারা নির্ধারণ করে না। যে পরিবেশে তাদের জন্ম হয়, তার ওপরও তাদের হাত নেই। বড়দের মতো তারা নিজেদের দেখভাল করতে পারে না। সে কারণেই ১৯২৪ সালে িলগ অব নেশন্স শিশু অধিকারবিষয়ক জেনেভা ঘোষণায় অনুমোদন দিয়েছে। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ১৯৮৯ সালে কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড গ্রহণ করেছে।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, জাতিসংঘ তার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারছে না। এমনকি তারা কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ডের স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দেশটি সুযোগের জন্য বিখ্যাত। ফলে এ দেশটি শিশুদের যত্নে যথাযথ ও আলোকিত ব্যবস্থা নেবে, এটা সবাই আশা করে। এ ক্ষেত্রে তারা অনুপ্রেরণার নজির স্থাপন করবে। তা না হয়ে এ দেশটি ব্যর্থতার আলোকশিখা হয়ে উঠেছে। শিশু অধিকার প্রদানে তারা দুনিয়ার সবচেয়ে ধীরগতির দেশ হিসেবে নজির স্থাপন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে শৈশবের গড় মান হয়তো দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ তা নয়, কিন্তু দেশটির সম্পদ ও শিশুদের অবস্থার মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য বিরাজ করছে, তার কোনো তুলনা নেই। সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ গরিব। কিন্তু শিশুদের মধ্যে ১৯ দশমিক ৯ ভাগই দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে, প্রায় দেড় কোটি। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে শুধু রোমানিয়ায় শিশুদারিদ্র্যের হার যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। ব্রিটেনের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদারিদ্র্যের হার দুই-তৃতীয়াংশ বেশি, আর নর্ডিক দেশগুলোর চেয়ে চার গুণ বেশি। অন্য কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ। কালো শিশুদের মধ্যে ৩৮ ভাগ ও হিস্পানিক শিশুদের মধ্যে ৩০ শতাংশের বেশি দরিদ্র।
যুক্তরাষ্ট্র শিশুদের ব্যাপারে তেমন যত্নশীল নয়, এ কারণে যে এটা হয়েছে তা নয়। এর কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক দশকে এমন এক নীতি গ্রহণ করেছে যে এর অর্থনীতি মারাত্মকভাবে অসম হয়ে পড়েছে। এতে সে সমাজের সবচেয়ে কমজোর অংশটি আরও মানবেতর অবস্থায় চলে গেছে। ব্যাপক হারে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটছে, তার ওপর করও হ্রাস করা হচ্ছে। এর মানে হচ্ছে, শিক্ষা ও শিশুর সুরক্ষার মতো জনকল্যাণমূলক কাজে বিনিয়োগের হার কমে যাওয়া।
ফলে মার্কিন শিশুদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। তাদের এরূপ ভাগ্যবরণে এটা পরিষ্কার যে অসমতা শুধু অর্থনৈতিক অগ্রগতির গতি ও স্থিতিশীলতাই রুদ্ধ করে না, এটা আমাদের সযত্নে লালিত ন্যায্য সমাজের ধারণাও হুমকির মুখে ফেলে দেয়। অর্থনীতিবিদ ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো শেষমেশ তা স্বীকার করতে শুরু করেছে।
আয়ের অসমতার সঙ্গে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকার প্রাপ্তির অসমতার সম্পর্ক আছে। এর সঙ্গে পরিবেশগত ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ারও সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ আর্থিক অবস্থা যত খারাপ হবে, পরিবেশগত ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের গরিব শিশুদের মধ্যে প্রায় প্রতি পাঁচজনে একজনের হাঁপানি রোগ আছে। সচ্ছল শিশুদের চেয়ে তা ৬০ ভাগ বেশি। যেসব পরিবারের বার্ষিক আয় ৩৫ হাজার ডলারের কম, তাদের শিশুদের অক্ষমতার হার যাদের আয় এক লাখ ডলার, তাদের শিশুদের প্রায় দ্বিগুণ। তার পরও মার্কিন কংগ্রেসের অনেকে সস্তায় খাদ্য সরবরাহে ভর্তুকি কমাতে চায়। এর ওপর ২৩ মিলিয়ন মার্কিন পরিবার নির্ভরশীল। ফলে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষ ক্ষুধার রাজ্যে নিপতিত হবে।
ফলাফলের অসমতার সঙ্গে সুযোগের অসমতার সম্পর্ক আছে। যেসব দেশের শিশুরা পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকার প্রাপ্তিতে পিছিয়ে এবং পরিবেশগত ঝুঁকির মুখে আছে, অনিবার্যভাবে সেসব দেশের গরিবের সন্তানদের জীবনের সমৃদ্ধির সম্ভাবনা ধনীর সন্তানদের চেয়ে কম। আর মার্কিন শিশুর জীবনের সম্ভাবনা যেহেতু তাদের মা-বাবার আয় ও শিক্ষার ওপর নির্ভর করে, ফলে এই দেশের সুযোগের সমতা অন্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় খুবই কম। তবে এটা আংশিক কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজের নিম্নকোটি থেকে আসা মানুষের পরিমাণ মাত্র ৯ শতাংশ, আর ৭৪ শতাংশ আসে উচ্চকোটি থেকে।
তরুণেরা তাদের প্রতিভা বিকশিত করবে, অধিকাংশ সমাজেই এটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে পরিগণিত হয়। অনেক রাষ্ট্রে শিক্ষার সমসুযোগ নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক সুরক্ষা আরোপ করা হয়েছে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ধনীর শিশুদের শিক্ষাব্যয় গরিব শিশুদের চেয়ে বেশি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র তার মহামূল্যবান সম্পদ হারাচ্ছে। অনেক তরুণই কোনো দক্ষতা অর্জন করতে না পেরে অপ্রায়োগিক কাজে সময় নষ্ট করছেন। দেশটির ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের উচ্চশিক্ষায় ব্যয়ের পরিমাণ কারা-ব্যবস্থাপনার ব্যয়ের সমান।
ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা—প্রাক্–স্কুলশিক্ষা, যা খুবই অল্প বয়সে শুরু হয়—না থাকায় অসম সুযোগের জের জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়। এ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় শিশুর পাঁচ বছর বয়স থেকেই। ফলে আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কিছু করার তাগিদ বোধ করা উচিত।
হ্যাঁ, অসমতার ক্ষতিকর প্রভাবের পরিসর খুবই ব্যাপ্ত, এটা অর্থনীতি ও সমাজের ব্যয় বিপুল হারে বাড়িয়ে দেয়। তবে এ ব্যয় অনেকাংশেই এড়ানো সম্ভব। কিছু কিছু দেশে অসমতার যে চূড়ান্ত নজির আমরা দেখেছি, তা অর্থনৈতিক সূত্র ও শক্তির অনিবার্য ফল নয়। সঠিক নীতি এই বিপর্যয় সৃষ্টিকারী প্রবণতার রাশ টেনে ধরতে পারে: শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা জাল, ধনীদের ওপর ক্রমবর্ধমান হারে কর আরোপ ও কঠোরতর নিয়ন্ত্রণ—অনেক সূচকের মধ্যে কয়েকটি।
এ কাজের জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, তা তৈরি করতে হলে আমাদের নীতিপ্রণেতাদের জড়তা ও কর্মহীনতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। যে লড়াইয়ের চালিকাশক্তি হবে আমাদের শিশুদের ওপর অসমতার বিপর্যয়কর প্রভাব। আমরা শিশুবঞ্চনা কমাতে ও সুযোগের সমতা বাড়াতে পারি। সেটা করতে পারলে আমরা আরও ন্যায্য ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের ভিত্তি নির্মাণ করতে পারব। তাহলেই তা আমাদের বিঘোষিত মূল্যবোধের প্রতিফলন হবে। তাহলে আমরা কেন তা করছি না?
অসমতা আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর যে প্রভাব ফেলছে এবং শিশুদের যে ক্ষতি করছে, সে ব্যাপারে আমাদের বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। পূর্ণবয়স্ক দরিদ্র মানুষের কথা নাহয় বাদই দিলাম, তারা হয়তো পরিশ্রম করেনি, পর্যাপ্ত সঞ্চয় করেনি বা সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু শিশুদের তো কোনো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নেই। শিশুরা এ অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। অধিকারের সুরক্ষা অন্যদের চেয়ে শিশুদেরই বেশি প্রয়োজন। এটা বলতে কী বোঝায়, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তার একটি উজ্জ্বল নজির স্থাপন করা।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ: নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ।