অস্তিত্বের সংকটে শিবসেনা, দিশেহারা উদ্ধব

বিজেপির রোড শোতে উদ্ধব ঠাকরে। ২০১৯ সালে আহমেদাবাদে
ছবি: এএফপি

৬২ বছরের জীবনে উদ্ধব ঠাকরেকে বড়সড় দুশ্চিন্তায় বিশেষ পড়তে হয়নি। ৫২ বছর বয়স পর্যন্ত বাবা বালাসাহেব ঠাকরে বটবৃক্ষ হয়ে যাবতীয় রাজনৈতিক ও পারিবারিক ঝড়ঝাপটা সামলেছেন। নির্বিঘ্ন ও নিরুপদ্রব জীবন কাটানোর পাশাপাশি উদ্ধব মনোযোগী ছিলেন ফটোগ্রাফির নেশায়। ছবি তিনি ভালোই তোলেন। জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী করেছেন। ছবির বইও ছাপিয়েছেন। কিন্তু কয়েক দিন ধরে রাজনীতির ক্যানভাসে তাঁর জীবনের যে ছবি আঁকা হলো, তা অনুজ্জ্বলই শুধু নয়, চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়া মাঝদরিয়ায় লুণ্ঠিত দিশেহারা পরাস্ত এক নাবিকের প্রতিচ্ছবি।

বাবার কাছে ‘হার্ড কোর’ রাজনীতির হাতেখড়ি হলেও উদ্ধব খুশি ছিলেন দলীয় মুখপত্র সামনার সম্পাদনায়। প্রথম রাজনৈতিক ঝটকা, পারিবারিকও, চাচাতো ভাই রাজ ঠাকরের বিদ্রোহ। বালাসাহেবই সামলেছিলেন। ২০০৬ সালে। জীবনের উপান্তে রাজের বিদ্রোহ তাঁকে আহত করেছিল। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। বালাসাহেব নির্ভরতা খুঁজেছিলেন উদ্ধবের মধ্যে। উদ্ধবও বাবার দেখানো ‘হিন্দুত্বে’ ভর দিয়ে এগোতে চেয়েছেন। ২০১২ সালে বালাসাহেবের মৃত্যুর পর দলের সভাপতি হন। ২০১৪ বিধানসভার ভোটে আগের তুলনায় বাড়তি ১৮টি আসন জিতলেও বালাসাহেবের নামে সহানুভূতি ভোট ৩ শতাংশের বেশি তিনি টানতে পারেননি। অথচ বিজেপির ভোট বাড়ে প্রায় ১৪ শতাংশ! কেননা, তত দিনে রাজনীতিতে নিঃশব্দে ঘটে গেছে বিরাট এক গুণগত পরিবর্তন।

বালাসাহেবের ‘ইচ্ছা’ই ছিল ‘নির্দেশ’। সরকারি পদ গ্রহণ না করে, ভোটে না দাঁড়িয়েও তিনিই ছিলেন মহারাষ্ট্রের ‘সরকার’। বালাসাহেবের আদলে নিজেকে গড়তে চেয়েছিলেন রাজ ঠাকরে। ব্যর্থ তিনিও। সেই অবকাশে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে শিবসেনার তৈরি জমি নিঃসাড়ে দখল করতে থাকে বিজেপি। প্রভাব খোয়ানোর সেই চরিত্র কেমন, ২০১৯ সালের নির্বাচন এর প্রমাণ।

বালাসাহেবের বাসস্থান ‘মাতশ্রী’র গুরুত্ব যতটা কমেছে, তার বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে নরেন্দ্র মোদির বিজেপির বোলবোলাও। উদ্ধবের ‘রোলার কোস্টার’ রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাতও তখন থেকে। বুধবার রাতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর মুখ্যমন্ত্রিত্ব না ছেড়ে তাঁর উপায় ছিল না। তাঁর নিজের ও শিবসেনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শেষ পর্যন্ত কোন দিকে বাঁক নেবে, অজানা। পরাজিত ও বন্দী সম্রাটের মতো তাঁর আক্ষেপ, ‘বালাসাহেবের হাতে তৈরি সৈনিকেরাই আজ তাঁর ছেলেকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন। তাঁদের ক্ষমতাবান করার পাপের ফল ভুগতে হচ্ছে।’ অস্তিত্বের সংকট কতখানি, এ আক্ষেপ তার প্রমাণ। আজকের মহারাষ্ট্রীয় রাজনীতির চালচিত্রও তা।

এ জন্য দায়ী উদ্ধবই। তাঁর কাজের স্টাইল বালাসাহেবের চেয়ে আলাদা। উদ্ধবের প্রকৃতি নরম। একটু বেশি মাত্রায় গণতান্ত্রিক। আধুনিক। বাবা ও ভাই রাজের মতো উগ্র আন্দোলনকে জনপ্রিয়তা অর্জনের উপায় বলে মনে করেননি। তিনি উন্নয়নকামী। শারীরিকভাবে দুর্বল এবং অন্তর্মুখী। এ কারণে বাবার মতো জননেতা হতে পারেননি।

বালাসাহেবের ‘ইচ্ছা’ই ছিল ‘নির্দেশ’। সরকারি পদ গ্রহণ না করে, ভোটে না দাঁড়িয়েও তিনিই ছিলেন মহারাষ্ট্রের ‘সরকার’। বালাসাহেবের আদলে নিজেকে গড়তে চেয়েছিলেন রাজ ঠাকরে। ব্যর্থ তিনিও। সেই অবকাশে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে শিবসেনার তৈরি জমি নিঃসাড়ে দখল করতে থাকে বিজেপি। প্রভাব খোয়ানোর সেই চরিত্র কেমন, ২০১৯ সালের নির্বাচন এর প্রমাণ। উদ্ধবের টনকও নড়ে তখনই।
অন্তর্মুখী উদ্ধব মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিতে অনড় থেকে বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করে কংগ্রেস ও এনসিপিকে কাছে টানবেন, বিজেপি তা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছিল। সেই ব্যর্থতা ঢাকতে অজিত পাওয়ারের উচ্চাশায় হাওয়া দিয়ে বিজেপির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডনবিশ তড়িঘড়ি ভাঙাতে চেয়েছিলেন এনসিপিকে। ভাইপোকে সামলে কোনোরকমে পরিস্থিতির সামাল দিয়েছিলেন প্রবীণ মারাঠা শারদ পাওয়ার।

আড়াই বছর কাটতে না-কাটতে শিবসেনার দুর্গ যে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে, উদ্ধব তা বোঝেননি। রাজ ঠাকরে, ছগন ভুজবাল, নারায়ণ রানেদের দলত্যাগে যা ঘটেনি, একনাথ শিন্ডে রাতারাতি তা করে ফেললেন! এটা যতটা বিস্ময়ের, তার চেয়েও বিস্ময়কর বিদ্রোহের আঁচ টের না পাওয়া! একটা দল ও সরকারের এমন হিমালয়সদৃশ ব্যর্থতার নিদর্শন এ দেশের রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!

শিন্ডেদের বিদ্রোহের কারণও উদ্ধবের রাজনীতি। বাবার দেখানো রাস্তা পরিত্যাগ করে উদ্ধব মুখ্যমন্ত্রীই শুধু হলেন না, ছেলে আদিত্যকেও নামালেন ভোটের রাজনীতিতে। মন্ত্রী করলেন। দলে প্রবীণ ও নবীনের সংঘাতের শুরুও তখন। উদ্ধবের আমলেই শিবসেনায় ঘটে যায় বিপুল এক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। রাজনীতির ভাষার বদল ঘটে। এতকাল যাঁরা মারকাটারি আগ্রাসী রাজনীতি করে মুম্বাই দাপিয়েছেন, তৃণমূল স্তরের সেই সৈনিকেরা দেখলেন আধুনিক, শিক্ষিত, নবীন নেতৃত্বের কাছে তাঁদের মেঠো ভাষা বেমানান ঠেকছে। ভাবনা, আদর্শ ও নেতৃত্বের নতুন ধারায় মানিয়ে নেওয়া পুরোনো শিবসৈনিকদের কাছে অসম্ভব হয়ে ওঠে। সাড়ে পাঁচ দশক ধরে যাদের বিরোধিতা করে শিবসেনার রমরমা ও টিকে থাকা, হঠাৎ সেই কংগ্রেস-এনসিপিকে ‘মিত্র’ ভাবা কঠিন হয়ে ওঠে। জোট সরকার রক্ষার বাধ্যবাধকতায় উদ্ধব যতই নমনীয় ও আপসকামী হয়েছেন, ততই ক্ষোভ বেড়েছে আদি শিবসৈনিকদের। তাঁরা অসহায় বোধ করেছেন আগ্রাসী বিজেপি ও চতুর এনসিপির প্রভাব বৃদ্ধিতে। মুম্বাই-থানে, উপকূলবর্তী কোঙ্কন ও ঔরঙ্গাবাদের কিছু এলাকায় আটকে থাকে শিবসেনার প্রভাব। থানের মুকুটহীন সম্রাট একনাথ শিন্ডের গা ঝাড়া দেওয়ার কারণও তা।

শিন্ডের অসহায়ত্ববোধ বাড়ার অন্য কারণও আছে। বালাসাহেব রাজনীতি করেছেন দায়বদ্ধতার বাইরে দাঁড়িয়ে। মনোহর যোশীকে মুখ্যমন্ত্রী করলেও তিনি দল ও সরকারের রাশ রেখেছিলেন নিজের হাতে। সাড়ে চার দশকের সেই প্রথা ভাঙেন উদ্ধব, বাবার মৃত্যুর পর। শুধু তা-ই নয়, এগিয়ে আনেন ছেলে আদিত্যকেও। এতে আচমকা বন্ধ হয়ে যায় শিন্ডের রাজনৈতিক উত্তরণের রাস্তা। তিনি বুঝতে পারেন, টিকে থাকতে হলে ঠাকরেদের হাত থেকে বের করে আনতে হবে শিবসেনাকে। সে লক্ষ্যে তিনি ও তাঁর অনুগামীরা বিদ্রোহের পক্ষে যে যুক্তিজাল বুনেছেন, এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট প্রতীয়মান তাঁদের অসহায়ত্ব। নইলে এত বড় ভাঙন এভাবে সংগঠিত হতে পারে না।
কী বলছেন তাঁরা? প্রথমত, জোট বদল করে শিবসেনা তার এযাবৎ লালিত চরিত্র হারিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই জোটে লাভ হয়েছে এনসিপি ও কংগ্রেসের। তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বেড়েছে, শিবসেনার কমেছে। তৃতীয়ত, এই ‘ভুল’ রাজনীতি শিবসেনার ‘মারাঠা মানুষ’-এর চাবিকাঠি তুলে দিয়েছে বিজেপির হাতে। তাদের উগ্র হিন্দুত্ববাদ আকর্ষণ করছে আগ্রাসী শিবসৈনিকদের। চতুর্থত, উদ্ধবের ‘ভ্রান্ত’ রাজনীতি শিবসেনার নেতাদের অযথা ‘রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হেনস্তার’ মোকাবিলায় নামতে বাধ্য করছে। বিদ্রোহী শিবিরে অন্তত ১৫ জন রয়েছেন, যাঁদের ‘অর্থনৈতিক দুর্নীতির’ তদন্তের নামে হয়রান হতে হচ্ছে। শিন্ডেদের দাবি তাই শিবসেনা তার ‘অস্বাভাবিক’ মিত্র কংগ্রেস-এনসিপিকে ছেড়ে ফিরে আসুক ‘স্বাভাবিক’ মিত্র বিজেপির কাছে। হিন্দুত্বই শিবসৈনিকদের একমাত্র আশ্রয়!

যাঁদের ওপর ভরসা করে বালাসাহেব দল গড়েছিলেন, একনাথ শিন্ডে সেই অতি সাধারণ ‘মারাঠা মানুষ’। একদা থানের অটোচালক আজকের ৫৮ বছরের শিন্ডে তর্কাতীতভাবে দলের প্রধান জননেতা। যে রাজনীতি করতে আজ তিনি বাধ্য হলেন, তাতে সাময়িকভাবে নিজেকে লাভবান মনে করতেই পারেন। কিন্তু আখেরে? বিজেপির সুরে নেচে মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন, তবে অবশ্যই তা বড় তরফের কৌশলগত অর্ন্তবর্তীকালীন সাময়িক বন্দোবস্ত। শিবসেনাকে বাঁচাতে উদ্ধব বিজেপির সঙ্গ ছেড়েছিলেন। তাতে দল সংকুচিত হয়েছে। সর্বগ্রাসী বিজেপিকে ঠেকানো তাঁর কাছে কঠিনস্য কঠিন পরীক্ষা। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে উদ্ধব হতোদ্যম অনুগামী শিবসৈনিকদের আদৌ চাঙা করতে পারবেন কি না, নব-অধ্যায়ে তা বড় প্রশ্ন। নেতৃত্বের সেই দৃঢ়তা ও কাঠিন্য গত ১০ বছরে তিনি কিন্তু দেখাতে পারেননি। অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে দৃশ্যত আজ তিনি দিশেহারা।

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি