আইএসের 'তথ্য জিহাদ' এখন নতুন হুমকি

আইএসের যুদ্ধক্ষেত্র এখন যতটা না ‘ফিজিক্যাল’, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘ডিজিটাল’। ছবি: এএফপি
আইএসের যুদ্ধক্ষেত্র এখন যতটা না ‘ফিজিক্যাল’, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘ডিজিটাল’। ছবি: এএফপি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চূড়ান্ত বিজয় ঘোষণা করে একটি টুইট বার্তায় লিখেছিলেন, ‘আইএস পরাজিত হয়েছে। তুরস্কসহ অন্য সব দেশ এখন নিজেরাই (তাদের ভূখণ্ডে থাকা) অবশিষ্ট সন্ত্রাসীদের সামলাতে পারবে। আমরা এখন (সিরিয়া থেকে) দেশে ফিরছি!’

ওই বছরে তিন মাসের মধ্যে অন্তত ১৬টি টুইট বার্তায় ট্রাম্প দাবি করেন, আইএস পরাজিত হয়েছে অথবা পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার দৃশ্যত ট্রাম্পের কথার সঙ্গে ভিন্নমত দিয়েছে। এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের চালানো তৎপরতা নিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই মহাপরিদর্শক এবং ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের মহাপরিদর্শক যৌথভাবে অপারেশন ইনহেরেন্ট রিসোলভের পর্যালোচনা করে গত আগস্টে কংগ্রেসে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। সেখানে তাঁরা বলেছেন, দৃশ্যমান ভূখণ্ড হারালেও আইএস যোদ্ধারা এখনো সিরিয়া ও ইরাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এবং আবার তারা তাদের খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সিরিয়া থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সব মার্কিন সেনা এবং আফগানিস্তান থেকে অর্ধেক সেনা সরিয়ে নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত ট্রাম্প নিয়েছিলেন, সেই সিদ্ধান্তই আইএসের তৎপরতা বৃদ্ধির আংশিক কারণ। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে না পারার কারণে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে জেমস ম্যাটিসকে সরে যেতে হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তের কারণে আমেরিকার আঞ্চলিক পার্টনারদের সন্ত্রাস মোকাবিলায় বেগ পেতে হচ্ছে।

ইরাকের বাগদাদ, নিনেওয়া ও আল আনবার প্রদেশ ছাড়াও মধ্য ইউফ্রেটিস রিভার ভ্যালি এলাকায় আইএস জঙ্গিরা আবার ধীরে ধীরে সংগঠিত হচ্ছে। সিরিয়ায় আল রাক্কা এবং হোমস প্রদেশে আইএস আবার শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তারা সেখানে অভয়ারণ্য গড়ে তোলার জন্য একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

ট্রাম্প তাঁর সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু আইএসের যুদ্ধক্ষেত্র এখন যতটা না ‘ফিজিক্যাল’, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘ডিজিটাল’। এই দিকে নজর রেখে আমেরিকাকে অবশ্যই সজাগ হতে হবে। বিশেষত, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আইএস যাতে শক্তি সঞ্চয় না করতে পারে, সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে।

২০১৪ সালে আইএস ইরাকের মসুল শহরে একটি হামলা চালিয়েছিল। এই হামলার দৃশ্য অলআইসইনআইসিস হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ সরাসরি দেখেছিল। আইএস অনলাইনে তখন থেকে এতটাই সক্রিয় যে তাদের অনলাইন তৎপরতাকে অনেকে ‘ভাইরাল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন’ বলে আখ্যা দিয়েছে। আইসিস ২.০ নামে আইএসের ভার্চ্যুয়াল যোদ্ধারা এখন তীব্রভাবে সক্রিয় হয়েছে। তারা বিশ্বব্যাপী তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে ও বিদেশি যোদ্ধা নিয়োগ করতে অনলাইনে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠাচ্ছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের খবরাখবর বুস্ট করছে।

যেমন গত এপ্রিলে শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডেতে হামলার পর এই গ্রুপটি তাদের নেতা আবু বকর আল বাগদাদির একটি ভিডিও রিলিজ করে। সেখানে বাগদাদি শ্রীলঙ্কায় হামলার দায় স্বীকার করেন। আইএসের বৈশ্বিক মিডিয়া উইং একটি অনলাইন সাপ্তাহিকও প্রকাশ করে আসছে।

এসব থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, কথিত খিলাফতের পতন ঘটলেও আইএস একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তারা পিছু হটলেও এখন তারা ইন্টারনেটের জগতে নতুন খিলাফত প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেমেছে।

আমেরিকান ও বাকি বিশ্বের জনগণকে অবশ্যই বুঝতে হবে আইএস এবং অন্য জিহাদি গ্রুপগুলো যে নতুন ধরনের লড়াইয়ে নেমেছে এবং সেখানে তাদের সমূলে বিনাশ করা খুবই দুরূহ। দুর্নীতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়কে সামনে এনে আইএস, আল-কায়েদা ও বোকো হারামের মতো সংগঠনগুলো গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো, তাদের প্রতিহত করতে যে মাত্রায় পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হচ্ছে না। যুদ্ধের ময়দানে হেরে গিয়ে তারা উধাও হয়ে গেছে মনে করে তাদের বিক্ষিপ্ত শক্তিকে খাটো করে দেখার কারণেই বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই ভার্চ্যুয়াল প্রচার প্রপাগান্ডা দিয়েই আইএস তাদের বিক্ষিপ্ত শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করতে পেরেছিল। সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না—এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অ্যান মারি স্লটার: মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নিউ আমেরিকার সিইও এবং আসা সি ক্যাসলবেরি যুদ্ধফেরত সেনা কর্মকর্তা ও জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক