আইন জনস্বার্থে, ক্ষমতা দেখানোর জন্য নয়

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি (এসি ল্যান্ড) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জনৈক আইনজীবীকে মোবাইল কোর্ট আইন অনুযায়ী ৫০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। আরও জানা গেছে, বসা নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার জের ধরে আইনজীবীকে এসি ল্যান্ড এভাবে দণ্ডিত করেন। ক্ষুব্ধ আইনজীবীদের প্রতিবাদের মুখে বিভাগীয় কমিশনার তাৎক্ষণিকভাবে সেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় বদলি করেছেন।

বিষয়টি হাইকোর্ট বিভাগের নজরে আনা হলে সেই এসি ল্যান্ডকে ব্যাখ্যা জানাতে তলব করা হয়েছে। এ বিষয়ে গণমাধ্যম সূত্রে আরও জানা যায়, দণ্ড দেওয়ার সময় সেই এসি ল্যান্ড মন্তব্য করেন, ‘আমি আমার ক্ষমতা দেখালাম, পারলে আপনি আপনার ক্ষমতা দেখান।’ এমনটা বলেছেন বলে ভুক্তভোগী আইনজীবী দাবি করেন। দণ্ড প্রদানের যথার্থতার বিষয়টি যেখানে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আওতায় রয়েছে, সেখানে মন্তব্য করা চলে না। তবে ‘আমি আমার ক্ষমতা দেখালাম’-এ-জাতীয় বক্তব্য তিনি যদি করে থাকেন, তা অত্যন্ত গর্হিত হয়েছে। আইনজীবীরা আদালতের অংশ। নামজারি মামলার শুনানিকালে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনজীবীর আবশ্যকতা থাকে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর ভূমিকা যদি কোনোরূপ দোষের হয়, সেখানে মোবাইল কোর্টের ক্ষমতা প্রয়োগ ছাড়াও বিভিন্ন বিকল্প ছিল।

মাত্র কয়েক দিন আগে লক্ষ্মীপুরের একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও একজন অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। বসানো হয় মোবাইল কোর্ট। তা পরিচালনা করেন সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। সেই মামলাও হাইকোর্ট বিভাগ পর্যন্ত গড়ায়। সবাই ক্ষমাপ্রার্থনা করায় আদালত তিরস্কার করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ ধরনের দায়িত্বে না রাখার নির্দেশ দেন। আদালতের পর্যবেক্ষণেও কিন্তু বিষয়টি ক্ষমতার অপব্যবহার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এডিসি ও অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনের আচরণ ভদ্রজনোচিত ও কর্মকর্তাসুলভ ছিল না, এমন মন্তব্যও পর্যবেক্ষণে এসেছে।

জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন করে জনস্বার্থে। জনগণকে সুরক্ষা দিতে ও জনকল্যাণমূলক কাজ করার সুবিধার্থে। সেসব আইনে জনস্বার্থ বিঘ্নিত করার জন্য থাকে শাস্তির বিধান। আর তার দায়িত্বও থাকে কারও না কারও ওপর। এর প্রয়োগের প্রক্রিয়াও আইনেই থাকে লিপিবদ্ধ। মূলত অপরাধমূলক কাজের বিচার হয় আদালতে। দণ্ডও দেন বিচারক। তা অপরাধভেদে কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড, আবার উভয়টিই হতে পারে। আদালত ছাড়াও কিছু নির্বাহী কর্তৃপক্ষের অর্থদণ্ড আরোপের ক্ষমতা রয়েছে। রাজপথে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জন্য পুলিশের সার্জেন্ট জরিমানা করেন। রেলের টিকিট ফঁাকি দিলে চেকারও করেন তাই। বনজ সম্পদ চুরি বা ক্ষতিসাধনের জন্য জরিমানা করেন বন কর্মকর্তারা। তেমনি শুল্ক ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা জরিমানা করতে পারেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে। এগুলো সবই নির্বাহী কাজ বলে সবাই ধরে নেন।

তবে মোবাইল কোর্ট আইনটিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের জরিমানার পাশাপাশি কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে। এ আইন ২০০৭ সালে প্রথম অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে সংসদে প্রণীত হয় বর্তমানে প্রচলিত মোবাইল কোর্ট আইন। আইনের আওতা ও কার্যকর করার বিধানও সুস্পষ্ট। উল্লেখ্য, এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে মামলা আছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। তঁাদের সিদ্ধান্তে এর পরিণতি নির্ধারিত হবে। তবে এখনো বলবৎ রয়েছে। মোবাইল কোর্ট দ্রুততার সঙ্গে বেশ কিছু জনকল্যাণমূলক কাজ করে নজরকাড়া দৃষ্টান্তও রেখেছেন। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ ও ইভ টিজিং প্রতিরোধ, ভেজালবিরোধী অভিযানসহ অনেক ক্ষেত্রেই প্রশংসিত হয়েছে আইনি ব্যবস্থাটি। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে যথাযথভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাচ্ছেন না অভিযুক্ত ব্যক্তি। তাই দণ্ড দেওয়ার সময় খুবই সংযত ও সাবধানী না হলে অবিচার হতে পারে। যেখানে সংশয়ের অবকাশ আছে, প্রয়োজন অধিকতর দণ্ডারোপ, সে ক্ষেত্রে তঁারা তো বিচারিক আদালতে মামলা দায়েরের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন।

সমসাময়িক কালে কয়েকজন অতি সাহসী কিন্তু সজ্জন ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় এনে নন্দিত হয়েছেন। গণমাধ্যমসহ সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছেন তঁারা। এখনো এরূপ অনেকেই আছেন বহু ক্ষেত্রে। কিন্তু গুটি কয়েক অদূরদর্শী কর্মকর্তার আচরণ গোটা ব্যবস্থাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সংশ্লিষ্ট এসি ল্যান্ডের চাকরিকালও কয়েক বছর হয়েছে। ধরলাম তিনি ততটা অভিজ্ঞ নন। তবে একজন এডিসি তো যথেষ্ট অভিজ্ঞ কর্মকর্তা। গোটা চাকরিজীবনের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ এর মধ্যেই পার করে ফেলেছেন। এই পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা এরূপ অধৈর্য হয়ে এমন কাজ করলেন, যাতে নিজে শুধু নিন্দিত হননি, হয়েছেন তঁার ক্যাডারের সব সদস্য। এমনকি প্রশাসনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার সঙ্গে আগে যঁারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তঁারাও সমভাবে লজ্জিত ও ব্যথিত। বীরগঞ্জের এসি ল্যান্ডকে দূরবর্তী স্থানে দ্রুত বদলি করে বিভাগীয় কমিশনার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। এখন সেই কর্মকর্তার পরবর্তী পরিণতি উচ্চ আদালতের হাতে। আর সেই এডিসি ও ইউএনওর চাকরিজীবনে ইতিমধ্যে বড় ধরনের কালিমা লিপ্ত হয়েছে।

আরেকটি বিষয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আইনটির সুস্পষ্ট বিধান, কথিত অভিযোগ সেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সংঘটিত বা উন্মোচিত হতে হবে। এতে কোনো অস্পষ্টতা নেই। আর তা হওয়ার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগ গঠন করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তা পাঠ করে শুনিয়ে জিজ্ঞাসা করবেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষ স্বীকার করলে দিতে পারেন দণ্ড। এমনকি অধিকতর দণ্ডের প্রয়োজন অনুভূত হলে সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন। অপরাধ স্বীকার না করলেও তা-ই করার বিধান। এর কোনো বিচ্যুতি তো আইনের চেতনাকে বিপন্ন করে। আর স্বীয় স্বার্থে কিংবা ক্ষমতার বাহাদুরি দেখাতে আইন দিয়ে অন্যকে শাস্তি দেওয়াও অপরাধের নামান্তর।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের এই আইনি ক্ষমতা যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি একে নিয়ে বিতর্কও আছে। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের কার্যকলাপ নতুন বিতর্ক উসকে দেবে। জনপ্রশাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার সড়ককে করবে প্রশস্ত। মোবাইল কোর্ট সাধারণত পরিচালনা করেন ইউএনও, এসি ল্যান্ড এবং অন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ। ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনার সংবেদনশীলতায় আরও সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা সংগত। তঁাদের তদারককারী কর্মকর্তা হিসেবে জেলা প্রশাসকদের এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। সতর্ক নজরদারি, তদারক ও ভুলভ্রান্তি শোধরাতে তরুণ সহকর্মীদের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব তঁাদের। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এটিকে গতানুগতিকভাবে ছেড়ে দিলে চলবে না। অবিচার ও ক্ষমতার অপব্যবহার কোথাও হলে সেখানে ন্যায়সংগত প্রতিকার দিতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।

পাশাপাশি এ ধরনের অন্যায্য কার্যক্রমের সঙ্গে যঁারা সংশ্লিষ্ট হবেন, তঁাদের শাস্তির জন্য সক্রিয় উদ্যোগও প্রয়োজন। এটা মনে করা অসংগত যে সবাই মিলে প্রশাসনের লোকদের বিরুদ্ধাচরণ করছেন। যেখানে কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা অকারণ হয়রানির সম্মুখীন হন, সেখানে গণমাধ্যমসহ অন্যদের প্রতিবাদী হতে আমরা দেখছি। নিকট অতীতে বরিশালে একজন ইউএনওকে অতিরিক্ত জেলা জজ একটি মামলায় হাজতে নেওয়ার আদেশ করার পরই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দ্রুত সংশোধিত হয় আদেশটি। মামলার বাদী ক্ষমতাসীন দলের নেতা। দল তঁাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে। অত্যন্ত সম্মানজনকভাবে সেই কর্মকর্তা হয়রানি থেকে রেহাই পেয়েছেন। এসব বিষয় আমাদের ভুলে গেলে তো চলবে না। যেখানে তঁারা ভালো কাজ করেন, তা এসি ল্যান্ড, ইউএনও বা ডিসি-যে স্তরেই হোক, তঁাদের প্রশংসা করে পত্রপত্রিকায় এমনকি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।

তাই নাচতে না জানার জন্য উঠানকে দোষ দিয়ে লাভ হবে না। ভালো নিশ্চয়ই অনেকে আছেন। তঁারা ভালো করছেন। কিন্তু দু-চারজনের বিচ্যুতির দায় অন্যদের ঘাড়ে পড়ে। তা যাতে না হতে পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। দায়িত্ব ও ক্ষমতা যত বেশি, তত বেশি দরকার সংযম। কেননা, সবার নজরদারি থাকে তঁাদের প্রতিই। সংযম নিষ্ক্রিয়তা নয়। অতি সক্রিয় ব্যক্তিও সংযমী হতে পারেন। অকারণ সমস্যা ডেকে আনা হঠকারিতার নামান্তর। এর অর্থ এই নয় যে তঁারা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন। তঁারা কাজ করবেন সাহস ও প্রত্যয়ের সঙ্গে। তবে জনস্বার্থে। নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য নয়।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]