আইনশৃঙ্খলা মডেল কেন ফলপ্রসূ হচ্ছে না

আজকাল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত হলে ভর্তি হচ্ছেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। নিঃসন্দেহে ভালো একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ফলে সামরিক বাহিনীর হাসপাতালে তাঁদের সুচিকিৎসা হচ্ছে। এতে এটা স্পষ্ট যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্থানীয় সরকার অথবা সরকারি অন্য কোনো হাসপাতালের ওপর রাষ্ট্রের ভরসা কম।

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধের লক্ষ্যে দেশজুড়ে লকডাউনই সবচেয়ে বেশি কার্যকর পন্থা হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের দেশে প্রথম দিকে এটার নাম ছিল সাধারণ ছুটি, ক্রমান্বয়ে লকডাউন শব্দটার ব্যবহার বেড়েছে। এখন লাল এলাকাগুলোতে লকডাউন কার্যকর করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায়। করোনাযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত আছে পুলিশ বাহিনী। সংক্রমণ রোধের প্রধান হাতিয়ার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অনেক লকডাউন এলাকায় খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পৌঁছে দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, অথবা দেওয়া হচ্ছে তাদের সহায়তায় ও সহযোগিতায়। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় তারাই শীর্ষে। তাদের সাত হাজারের বেশি সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকের মৃত্যুও হয়েছে।

বলাবাহুল্য, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, টেকনিশিয়ান ও ক্লিনার করোনাযুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধা। কিন্তু সার্বিকভাবে আমাদের করোনা মোকাবিলার প্রাথমিক চেষ্টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীনির্ভর। স্বাস্থ্যসেবকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তঁাদের পিপিই, মাস্ক ও অন্যান্য চিকিৎসাসংক্রান্ত সরঞ্জামের অভাব একটা চলমান ইতিহাস। এসব ব্যাপারে রাষ্ট্র ও সমাজের অবহেলা আছে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা মডেল প্রয়োগ করতে কোনো কার্পণ্য নেই।

২.

সাম্প্রতিক কয়েক বছরে আমাদের রাষ্ট্রটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ক্রমান্বয়ে অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সরকারের নির্ভরতা পুরোনো, নিকট অতীতে তা অত্যন্ত প্রকট হয় ২০১৮–এর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস থেকে। সে বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলোকে মাঠছাড়া করতে গায়েবি মামলার বিকট ব্যবহার শুরু হয়ে গেল। পুরোনো কাসুন্দি বেশি না ঘেঁটে এককথায় বলা যায়, ২৯ ডিসেম্বরের দিবাগত রাতে শুরু হয়ে যাওয়া ভুতুড়ে নির্বাচনে এক দলের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ছিল আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বিস্ময়কর নতুন অধ্যায়। বেছে বেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে এই আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটা অনেকাংশেই বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। আইন ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের আস্থা দিনে দিনে কমছে। তাই ২০০২ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এখনো চলছে। অর্থাৎ, অপরাধ দমনে গ্রেপ্তার, বিচার ও শাস্তির বদলে ‘শত্রু নিধন’ নীতি সম্পূর্ণ বলবৎ আছে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি (প্রধানত চীনা ও রুশ) দক্ষ জনবলের বাইরে দেশীয় দক্ষতা ও কাজের জোগান দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা অংশ।

গত ৫০ বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশের সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থনের ঘাটতি হয়েছে, সেই সব দেশের সরকারের দুটি প্রকৃতি এখন স্পষ্ট। প্রথমটি হলো খুবই মুষ্টিমেয় ব্যক্তির নির্দেশনায় সরকার পরিচালিত হওয়া। সরকার পরিচালনায় যৌথ নেতৃত্বের পরিবর্তে একক নেতৃত্ব মুখ্য হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, জনসমর্থনের পরিবর্তে এই গোছের সরকারগুলো ক্রমান্বয়ে স্ব স্ব সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এই নির্ভরশীলতার প্রকাশ ঘটে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মাধ্যমে। আর এসব অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্য খুব অল্পসংখ্যক ব্যক্তিকে আইনি জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয়। আরেকটা তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, অসংখ্য মিডিয়া থাকা সত্ত্বেও বাকস্বাধীনতার অভাব। এসব দেশে জনমত জরিপ হয় না। অবশ্য কিছু কিছু দেশে সরকারি মদদপুষ্ট জরিপ হয়, তবে সেসব জরিপের ফলাফল সবারই আগেভাগেই জানা থাকে।

৩.

আইনশৃঙ্খলানির্ভর উন্নয়ন মডেল কার্যকর ও ফলপ্রসূ থাকে তত দিন, যত দিন না কোনো অপ্রত্যাশিত বা অভাবনীয় দুর্যোগে দেশটি আক্রান্ত হয়। ছোটখাটো দুর্যোগ, যেমন ঝড়ঝাপটা, সীমিত বন্যা-প্লাবন, স্থানবিশেষে খাদ্যাভাব, ইত্যাদি আইনশৃঙ্খলা মডেলের সরকারগুলো মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু দুর্যোগটা যখন ব্যাপক ও বিশাল এবং যেই দুর্যোগ সামাল দিতে দরকার সর্বব্যাপী জনসম্পৃক্ততা, সেই সব পরিস্থিতিতেই আইনশৃঙ্খলা–নির্ভরশীল সরকারগুলোর দুর্বলতা প্রকাশ পায়। কারণ টিয়ার গ্যাস, ডান্ডাপেটা, ক্রসফায়ার, ডিজিটাল আইনে মামলা, অবিশ্বাস্য আয়ের ভাগ দেওয়া, রাতারাতি বিরাট বড়লোক হওয়ার পথ প্রশস্ত করা, ঢালাওভাবে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে খুশি রাখা, প্রয়োজনে হুমকি-ধমকি দিয়ে নীরব–নিশ্চুপ রাখা, ইত্যাদি গোছের পরীক্ষিত হাতিয়ারগুলো বিরাট সংকট বা দুর্যোগ মোকাবিলায় আর কাঙ্ক্ষিত ফল দেয় না। সরকার এলোমেলো হয়ে যায়, জনগণ হয়ে পড়ে ভীতসন্ত্রস্ত, অস্থির ও দিশাহীন। সরকার এখন আইনশৃঙ্খলা মডেল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। কিছু টেকনিক্যাল বা পরামর্শ কমিটি করা হয়েছে, কিন্তু তাদের উপদেশ, অনুনয়-বিনয়ে কেউ কর্ণপাত করছে বলে মনে হয় না। সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে, আলাপ–আলোচনা করে, যৌথভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া আইনশৃঙ্খলা মডেলের সঙ্গে বেমানান। যারা এত দিন আইন, জবাবদিহি, জনপ্রিয়তা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেনি, তাদের পক্ষে হঠাৎ করে একটা আলোচনা মডেল গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

সংবাদ টিভি চ্যানেলগুলোতে সকাল–বিকেল ঘুরেফিরে একটাই চিত্র। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, যত্রতত্র খেয়ালখুশিমতো ঘোরাঘুরি করছে, লকডাউনের তোয়াক্কা করছে না। জনগণের এই আচরণের পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রায় সবার একটাই বক্তব্য: অর্থ উপার্জনের প্রয়োজনে সবাই রাস্তায় বেরিয়েছে। কিন্তু স্পষ্টতই ঈদের দিন পনেরো আগে সরকার দোকানপাট খোলার নির্দেশ দিলেও বড় বড় দোকানপাট বন্ধই ছিল। ঈদে কেনাকাটা হয়েছে অতি সামান্য। ঈদের পরে দোকানপাট, হোটেল–রেস্টুরেন্ট সবই খোলা, কিন্তু কৃষি, চাল-ডালসহ খাদ্যদ্রব্যাদি আর ওষুধের দোকান ছাড়া অর্থনৈতিক কার্যক্রম খুবই সীমিত। যাদের টাকা খরচ করার কথা, অর্থাৎ দোকানপাটে গিয়ে কেনাকাটা করা, অথবা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াদাওয়া, টেলিভিশন-ফ্রিজ-মোটরসাইকেল কেনার কথা, তারা সবাই ঘাপটি মেরে বসে আছে। প্রায় সবাই সম্ভবত ভীত ও শঙ্কিত।

৪.

জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া লকডাউন বাস্তবায়ন অসম্ভব। কিন্তু জনগণ কি সরকারের ব্যাখ্যায় অথবা আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে? সাড়া না দিলে কেন সাড়া দিচ্ছে না তার কারণ অনুসন্ধান আমরা এখনো শুরু করতেই পারিনি। এটা সমাজবিজ্ঞানীদের কাজ। আলোচনাটা এখনো সীমাবদ্ধ আছে চিকিৎসা ও অর্থনীতিশাস্ত্রে। জ্ঞানের এই দুটি জগতের বাইরে আরও অনেকগুলো জগৎ আছে। জনগণ সরকারের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না তার সম্ভাব্য কারণ হয়তো এসব আহ্বানের প্রতি তাদের আস্থা নেই। প্রতিদিনকার স্বাস্থ্য ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের কথা যখন বেদবাক্য হয়, অর্থাৎ যখন প্রশ্ন করা যায় না, চ্যালেঞ্জ করা যায় না, তখন যারা শুনছে তারা হয়তো সবকিছু মেনে নিচ্ছে অথবা প্রায় সবকিছুই প্রত্যাখ্যান করছে। জোর করে শোনানো বা মানানো আইনশৃঙ্খলা মডেল এখন আর কাজে দিচ্ছে না। অবশ্য তাত্ত্বিক চিন্তা করতে আপত্তি কোথায়। আমাদের দুর্যোগটা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। স্বাস্থ্যদুর্যোগ বাড়ছে, প্রায় প্রতিদিনের সরকারি হিসাবেই সংক্রমণ আর মৃত্যু বাড়ছে। তবে এটা আসল হিসাব নয়। একইভাবে অর্থনৈতিক সংকট বাড়ছে এবং বাড়বে। তত্ত্ব বলে, আইনশৃঙ্খলা মডেল থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে সর্বজনীন ও গণতান্ত্রিক পথে সমাধান খুঁজতে হবে। আইনশৃঙ্খলা মডেল এবং জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক মডেল একসঙ্গে চলে না। আইনশৃঙ্খলা মডেলে এ সংকট সমাধানের আশা সরকার করতেই পারে, কিন্তু সেটা কার্যকর হবে বলে আমরা মনে করি না। জনগণকে সঙ্গে নিতে হবে, কিন্তু সেটা সরকার পারবে কি?

ড. শাহদীন মালিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক