আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচনে কী করে

বিভিন্ন দফায় চলমান পৌরসভা নির্বাচনের একটিতে একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালনকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জেলা পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তা কর্তৃক অপদস্থ হয়েছেন মর্মে অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ গেছে নির্বাচন কমিশনে। তারা স্বভাববশত নির্বিকার। তবে এর অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাটি জেনে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বিষয়টি। বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার অভিযুক্ত কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাতের উদ্দেশে বলেছেন, কে কোন দলের, তা আপনার বিবেচ্য নয়। একই সঙ্গে হাইকোর্ট বেঞ্চ তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ‘পুলিশ কর্মকর্তা ও জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আপনার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। অভিযুক্ত সেই পুলিশ সুপার আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন (প্রথম আলো, ২৬ জানুয়ারি)। এ ঘটনার সূত্র ধরে নির্বাচনকালে কার কী ভূমিকা আইন ও বিধিতে দেওয়া আছে, আর হাল আমলে চলছেটা কী, এ সম্পর্কে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

সংবিধান জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণ ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব দিয়েছে। এ দায়িত্ব পালন সহজতর করতে কমিশনের জনবলকাঠামো বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তরোত্তর। অনেক আগেই আমাদের কমিশনের জনবল কয়েক গুণ হয়ে গেছে ভারতের বিবেচনায়। আকৃতি যতই বাড়ানো হোক, নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় কার্যত বহুসংখ্যক সংস্থার জনবলের প্রয়োজনীয়তা থাকে। সে ক্ষেত্রে এর সুষ্ঠু সমন্বয় দরকার। বলা বাহুল্য, জাতীয় পর্যায়ে এ সমন্বয়ের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তেমনি স্থানীয়ভাবে তা রিটার্নিং কর্মকর্তার। ভোটকেন্দ্রে কাজটি করেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। সব সংস্থার সমন্বয়ে জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা প্রার্থীরা ভোট গ্রহণের দিন কেন্দ্রে এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে অংশীদার হন ব্যবস্থাপনায়।

নির্বাচন আয়োজনের যে কয়েকটি অধ্যায় রয়েছে, তাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রভূত দায়িত্ব রয়েছে। তারা নির্বাচন-পূর্ববর্তী, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ না করলে নির্বাচনই করা যাবে না। নির্বাচনের দিন প্রতিটি কেন্দ্রে প্রয়োজন হয় তাদের উপস্থিতি। আবশ্যকতা রয়েছে ভ্রাম্যমাণ টহল দল (মোবাইল টিম) এবং গোলযোগ বাধলে সেখানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার মতো দলের (স্ট্রাইকিং ফোর্স)। এই আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছে পুলিশ। পুলিশের সহায়তায় আবশ্যক হয় আনসার। র‍্যাব, বিজিবিও এ ব্যবস্থায় মোবাইল টিম বা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করে।

জাতীয় নির্বাচনে আমাদের দেশে ঐতিহ্যগতভাবে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় সামরিক বাহিনী তলব করা হয়। তারাও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পালন করে দায়িত্ব। উল্লেখ করা আবশ্যক, এসব মোবাইল টিম যে বাহিনীর দ্বারাই পরিচালিত হোক, সাধারণত সঙ্গে থাকেন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। নির্বাচনী অপরাধ, আচরণবিধি ভঙ্গ ইত্যাদি বিষয় তাৎক্ষণিক আমলে নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে বিচার করার জন্য হাল আমলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরাও থাকেন দায়িত্বরত। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের তাদের সব সহযোগিতা দেওয়ার কথা। আর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায় নিয়মিত সবার সমন্বয় বিধান করার কথা জেলা প্রশাসকের (ডিসি), সাধারণ তত্ত্বাবধানে এসপির। এর সুষ্ঠু সমন্বয়ে নির্বাচনের সময়কার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ব্যবস্থা সফল করার পূর্বশর্ত।

তবে সে ধরনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যাদের প্রধান দায়িত্ব, সে নির্বাচন কমিশন বরাবর চুপসে আছে। নিকট অতীতে জাতীয় নির্বাচনে যেসব গুরুতর অনিয়মের বিষয়ে প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে, তা তাদের আওতার বাইরে ছিল না। অনেকেই তো মনে করেন, ইচ্ছাকৃতভাবে ঢিলেমি দিয়ে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলটিকে অন্যায্য সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আর মাঠপর্যায়ে সে অন্যায্য দায়িত্ব পালনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথাটি সামনে আসছে বারবার। ভোট কর্মী (প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তা) নিয়োগ দেওয়ার কর্তৃত্ব রিটার্নিং কর্মকর্তা বা তাঁর সম্মতিতে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার।

এটা অজানা নয় যে সে তালিকা প্রণয়নে অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ। রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রায় ক্ষেত্রে ডিসিরাই ছিলেন। না থাকলেও ডিসি হিসেবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারতেন। সে তালিকা প্রণয়নে অন্য কোনো সংস্থার হস্তক্ষেপ বন্ধ করার কোনো পদক্ষেপ তাঁরা নিয়েছেন, এমনটা জানা যায়নি। সুতরাং ধরে নিতে হয়, তাঁরাও ব্যবস্থাটির সক্রিয় সহযোগী কিংবা নিদেনপক্ষে অসহায় দর্শক ছিলেন। ভোট কর্মীর তালিকায় কাউকে নিয়ে বিতর্ক থাকলে প্রার্থী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানাতে পারেন। যৌক্তিক মনে করলে কিংবা আস্থার মনোভাব বৃদ্ধি করতে ক্ষেত্রবিশেষে রিটার্নিং কর্মকর্তারা সেগুলোর সংশোধন করেন।

এরপর আসে ভোটের আগে সরকারবিরোধী দলের প্রার্থী, কর্মী-সমর্থক ও এজেন্টদের অব্যাহত হয়রানির বিষয়টি। বিগত জাতীয় নির্বাচনের কিছুকাল আগে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনের সময় থেকে এ-জাতীয় একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়। হয়রানির ধরন ছিল কোনো না কোনো মামলায় গ্রেপ্তার করা, রাতের বেলা বাড়িতে তল্লাশি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন। কী কারণে কী কাজ হয়, এটা মানুষ বোঝে। আর জাতীয় নির্বাচনের সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে ব্যাপকভাবে। এ বিষয়াদির দায়িত্বে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ। গণমাধ্যমে এগুলো এসেছে। নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ গেছে অনেক। কমিশন গুরুত্বের সঙ্গে এ ধরনের অভিযোগ আমলে নিয়ে নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে কোনো লক্ষণীয় উদ্যোগ নেয়নি।

সর্বশেষ খেল হয় একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের নির্ধারিত দিনের আগের রাতে। বেশ কিছুসংখ্যক নির্বাচনী এলাকায় রাতে ভোট কর্মীদের কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষে তাতে সিল মেরে রাখার ঘটনা সম্পর্কে বড় রকমের অভিযোগ রয়েছে। মধ্যরাতের নির্বাচন বলে এটি পরিচিতি পায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অতি সক্রিয়তা ও প্রশাসনের নীরব ভূমিকার বিষয়টি বিভিন্ন গবেষণা জরিপে উঠে এসেছে। উভয়টিই অপরাধ। এ প্রসঙ্গে সে নির্বাচনকালীন টিআইবির ৫০টি নির্বাচনী এলাকায় জরিপ প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। জরিপ দলের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা মতামত দিয়েছে যে ৫০টি স্থানের মধ্যে ৪২টিতে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ছিল নিষ্ক্রিয়। ভুয়া ভোট দেওয়া হয় ৩১টি স্থানে। ৩৩টিতে ভোটের আগের রাতেই ব্যালটে সিল দিয়ে রাখা হয়। কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা হয় ৩০টিতে, পর্যাপ্ত ব্যালট পেপার ছিল না ২২টিতে এবং ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই বাক্স ভর্তি হয়ে যায় ২০টিতে। এ নমুনা জরিপ খণ্ডচিত্র নয়, গোটা ব্যবস্থারই প্রতিফলন।

পুলিশের কর্তারা তাঁদের অধীন বাহিনী যেখানে কর্মরত থাকে, সেখানে তদারকিতে অবশ্যই যাবেন। ভোটকেন্দ্রেও যেতে পারেন। আইনশৃঙ্খলাঘটিত কোনো পরামর্শও দিতে পারেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে। কিন্তু ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে দিতে পারেন না কোনো সিদ্ধান্ত বা নির্দেশ। অন্য সংস্থার দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও এমনিভাবে কেন্দ্র পরিদর্শন করবেন। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে সবাইকে। এর ব্যত্যয় অগ্রহণযোগ্য।

প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার আইনানুগ নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রচুর কাজ আছে। তারা সেসব দায়িত্বও পালন করে। তা-ও জনবল ও অবকাঠামো সংকটে দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। সুতরাং তারা যা করার কথা নয়, সেসব বিষয় থেকে বিরত থাকলে আমরা অধিকতর সেবা পাব। আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন এসব সংস্থা। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ব্যতিরেকে কোনো পক্ষভুক্ত হয়ে অতিরিক্ত বিষয়াদি থেকে দূরে থাকতে হবে তাদের। আর সেটা দেশের স্বার্থেই।


আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

[email protected]