আইনের শাসন বনাম ‘লাইনের’ শাসন

কিছুদিন আগে মুশতাক আহমেদ নামক একজন লেখকের বন্দী অবস্থায় মৃত্যুতে সারা দেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল। মাঠে ময়দানে, মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে। একটি রাষ্ট্রে তার কোনো নাগরিকের বিচারবহির্ভূত মৃত্যু হলে যেমন প্রতিবাদ হওয়া উচিত, তেমনি একটি অভূতপূর্ব আন্দোলন মানুষ দেখেছিল। প্রথম সারির গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজ এই প্রতিবাদ গড়ে তুলতে মূল ভূমিকা রেখেছিল।

প্রশ্ন হলো, বন্দী অবস্থায় বিনা বিচারে কি শুধু লেখক মুশতাকেরই মৃত্যু হয়েছে? উত্তর যদি ‘না’ হয়, তবে পরের প্রশ্ন হবে এর আগে বা পরে বন্দী অবস্থায় একই ধরনের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে কী ধরনের প্রতিবাদ হয়েছিল বা হচ্ছে?

মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর মাওলানা ইকবাল হোসেন নামের একজন হেফাজত নেতা ঠিক একইভাবে বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ এই মৃত্যু নিয়ে কিছু প্রতিবাদ করলেও প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলোতে বড় আকারে কোনো খবর চোখে পড়েনি। মাঠে ময়দানে এই মৃত্যু নিয়ে তেমন বড় আকারের কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে, জানা নেই।

প্রশ্ন হলো, এই দ্বৈত নীতি কেন? এটা কি রাষ্ট্রের সমস্যা? এটা কি সরকারের সমস্যা? অথবা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি আমাদের এসে বলে দিচ্ছে যে অমুকের জন্য প্রতিবাদ করা যাবে, কিন্তু কিছুতেই তমুকের জন্য প্রতিবাদ করা যাবে না? দেশের নাগরিক সমাজ তাহলে কি নিজেদের জন্য এমন কোনো মানদণ্ড ঠিক করে রেখেছেন যে শুধুমাত্র সেই মানদণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁরা প্রতিবাদের ধরন ঠিক করবেন?
লেখক মুশতাকের জন্য ডাকা প্রতিবাদসভাগুলোর মূল প্রতিপাদ্য ছিল আইনের শাসন। অর্থাৎ, মুশতাকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আইনের শাসনের লঙ্ঘন হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, আইনের শাসন কী? স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলসফির মতে, কোনো রাষ্ট্রে আইনের শাসন বিদ্যমান আছে বলতে বোঝায় সেই রাষ্ট্রটি পরিচালিত হয় কিছু মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে। তার মধ্যে কিছু হলো তাত্ত্বিক মূলনীতি। যেমন সাধারনতা (জেনারেলিটি), স্বচ্ছতা, এবং স্থিতিশীলতা। আরেকটি হলো পদ্ধতিগত মূলনীতি। এই মূলনীতি অনুযায়ী স্বাধীন বিচার বিভাগের মতো কিছু প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে তাত্ত্বিক মূলনীতিগুলোর বাস্তবায়ন ঘটবে। এখানে সাধারনতা বা জেনারেলিটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘নৈর্ব্যক্তিক এবং নিরপেক্ষতা’ হিসেবে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি যখন আইনের শাসন ব্যাহত হয়েছে দাবি করে, তাঁরা তখন আইন প্রয়োগের বিভিন্ন অসংগতির মধ্যে এমন একটি বিষয়ও বোঝাতে চায় যে সরকার তার পক্ষের মানুষের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করে, তার বিপক্ষের মানুষের সঙ্গে একই আচরণ করে না।

তাহলে আমার প্রশ্ন হলো, আমাদের নাগরিক সমাজও কি একই দোষে দোষী নন? তাঁরা নিজেদের মতের মানুষগুলো অত্যাচারের স্বীকার হলে যেমন প্রতিবাদ করছেন, ভিন্ন মতের মানুষদের জন্য কি একইভাবে প্রতিবাদ করছেন? যদি না করে থাকেন, তাহলে তাঁরা কোন মুখে সরকার বা রাষ্ট্রের কাছে আইনের শাসন দাবি করতে পারেন?

বর্তমানে অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান হলো একটি শক্তিশালী নাগরিক সমাজ, যারা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মানুষের জন্য পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। কারা এই সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের আওতাভুক্ত? নাগরিক সমাজের সংজ্ঞা নিয়ে অনেক মতামত থাকলেও, বাংলাদেশে মূলত যারা এই ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, বিভিন্ন পেশাদার সংগঠন, এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অন্যতম।

কিন্তু বাংলাদেশে এখন একটি শক্তিশালী নাগরিক সমাজের অনুপস্থিতির কারণেই দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষেরা যার যার মতো করে নিজেদের ‘লাইনের’ লোকজন অন্যায়ের স্বীকার হলে শুধুমাত্র তাঁদের জন্যই মুখ খুলছেন। যেমন, কোন শিক্ষক অত্যাচারিত হলে, অন্য শিক্ষকেরা প্রতিবাদ করেন, কোন সাংবাদিক অত্যাচারিত হলে অন্য সাংবাদিকেরা প্রতিবাদ করেন, তেমনিভাবে ডানপন্থীর জন্য ডানপন্থীরা, বামপন্থার জন্য বামপন্থীরা, পুরোহিতের জন্য হিন্দুরা, আর ইমাম সাহেবের জন্য মুসলমানেরা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট পুতনমের মতে এ ধরনের বিভক্ত ও দুর্বল নাগরিক সমাজ একটি দেশে বরং সত্যিকারের জনসম্পৃক্ততা এবং সামাজিক বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।
আমরা যদি সত্যিই আইনের শাসন চাই, তবে অবশ্যই আমাদের শুধুমাত্র নিজেদের ‘লাইনের’ মানুষের জন্য প্রতিবাদ না করে একতাবদ্ধ হয়ে আইনের শাসন ব্যাহত হয় এমন সবগুলো ঘটনার জন্য সমানভাবে বিচার চাইতে হবে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। আর তা না হলে, সবাই যার যার দল বা মতের মানুষের জন্য বিচার কামনা করবে, প্রতিবাদ সমাবেশ করবে, কিন্তু সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম, তা কখনই গড়ে উঠবে না।

মো. হারুন অর রশিদ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যান্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পিএইচডি গবেষক
[email protected]