আওয়ামী লীগ-হেফাজত যখন একাকার

রাজনীতি সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারায় না চলায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ তাঁর নিখোঁজ গণতন্ত্র: কর্তৃত্ববাদের পথরেখা ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বইয়ে।

এই লেখায় গণতন্ত্র নিয়ে কিছু বলব না ঠিক করেছি। যে প্রশ্নটি এই মুহূর্তে আমাদের তাড়া করে ফিরছে, তা হলো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ, যারা একটানা এক যুগের বেশি সময় ধরে মসনদে আছে, সেই দলটির সাংগঠনিক অবস্থা এতটা ভঙ্গুর হয়ে পড়ল কেন? আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি এবং দেশবাসীও বহু বছর ধরে দেখে এসেছে, দলটির বড় শক্তি তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু গত ১২ বছর আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজপথছাড়া করতে গিয়ে রাজপথটি তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের মাঠের রাজনীতি কোনো রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ করছে না; করছে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।

এরও একটা পটভূমি আছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। উদ্যোগটি ছিল ফেসবুক ব্যবহারকারী মুক্তমনা একদল ছাত্র-তরুণের, পরবর্তী সময়ে যাতে যোগ দিয়েছিলেন সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ। ওই ছাত্র-তরুণদের ভয় ছিল, আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ছাড় দিতে পারে। আওয়ামী লীগ সুযোগটি পুরোপুরি কাজে লাগাল। তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি জামায়াতের সমর্থন পেতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করল। পরবর্তীকালে বিএনপির অনেক নেতা স্বীকার করেছেন, এটি তাঁদের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ যুদ্ধাপরাধের বিচারের পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ, বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনার দাবি সামনে নিয়ে আসে। তারা জঙ্গিবাদীদের হাতে মুক্তচিন্তার লেখকদের হত্যার প্রতিবাদ জানাল। কেবল ঢাকার বাসিন্দারা নন, সারা দেশ থেকে মানুষ এসে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সে সময় আওয়ামী লীগ এসব দাবির সঙ্গে কেবল সহমতই প্রকাশ করল না, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে নিজেদের আন্দোলন বলে ঘোষণা দিল। জাতীয় সংসদ থেকে কোনো কোনো নেতা এমন বক্তৃতাও দিলেন, তাঁদের মন পড়ে আছে শাহবাগে।

তবে শাহবাগে তাঁদের মন বেশি পড়ে থাকল না। হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে আহূত মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুরো ঢাকা শহরে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তারা ঘোষণা দিল, ১৩ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত ঢাকা শহর ছাড়বে না। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে রাত পোহানোর আগেই হেফাজতের নেতা-কর্মীরা ঢাকা শহর ছাড়তে বাধ্য হন।

এরপরই আমরা দেখলাম অজ্ঞাত কারণে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে ইতি টানা হলো। গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা যে আওয়ামী লীগের ওপর বেশি নির্ভর করছিলেন, তাঁরা গণজাগরণ মঞ্চকে কেবল পরিত্যাগ করলেন না, স্বাধীনভাবে যাতে আন্দোলন চলতে না পারে, সে জন্য নানা কৌশল নিলেন। বামপন্থী ছাত্র-তরুণদের সঙ্গে ছাত্রলীগের মারামারির ঘটনা ঘটল।

কিছুদিন পর অবাক বিস্ময়ে দেশবাসী লক্ষ করল, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের আপসরফা হয়ে গেছে। হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো গতি পেল না। আওয়ামী লীগের নেতাদের হেফাজতের সদর দপ্তর হাটহাজারীতে যাতায়াত বাড়তে থাকল।

প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের নেতারা বলতেন, জামায়াতে ইসলামীকে মোকাবিলা করতে হেফাজতকে নিউট্রাল বা নিরপেক্ষ করার প্রয়োজন আছে। এখন দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ নিজেই নিউট্রাল হয়ে গেছে। হেফাজতের সঙ্গে সখ্যের কারণে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী, এমনকি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মগজও ধোলাই হয়ে গেছে। এখানে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি:

সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ মারজান হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের পক্ষে পোস্ট দিয়েছেন। পোস্ট দিয়েছেন ছাতক উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা আলামীনও। তাঁদের দুজনকেই বহিষ্কার করা হয়েছে।

হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে সুনামগঞ্জের ধরমপাশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা আফজাল খানকে হেনস্তা করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতার ছেলে আল মুজাহিদ ও তাঁর সহযোগীরা। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ওই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগের নেতাকে হেনস্তা ও অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনায় ধরমপাশা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনকে প্রত্যাহার করে সুনামগঞ্জ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে ধরমপাশা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জহিরুল ইসলাম ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আনোয়ার হোসেনকে প্রত্যাহার করে সুনামগঞ্জ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়।

পুলিশের একজন কর্মকর্তাকেও দেখলাম ফেসবুক লাইভে মামুনুল হকের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিতে। যাঁরা তাঁকে হেনস্তা করেছেন, তাঁরা বেআইনি কাজ করেছেন বলেও মন্তব্য করেছেন এই কর্মকর্তা। খবরে দেখলাম, তাঁকেও প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঢাকার তেজগাঁও অঞ্চলের এক ডাকসাইটে পুলিশ কর্মকর্তা জনসচেতনতা বিষয়ে সহায়তা চাইলেন মামুনুল হক ও সহযাত্রী আলেমদের। ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমাদের কথা কে শুনবে। মাওলানা মামুনুল হকেরা বললে অনেক বেশি মানুষ শুনবেন, মানবেন।’

সোনারগাঁয়ের ঘটনায় স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা মামুনুল হককে নাজেহাল করেছেন। আবার হেফাজতের কর্মীরা যখন তাঁদের তাড়া করে রিসোর্ট জবরদখল করলেন, তখন তাঁরা এক সাংবাদিককে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছেন। ক্ষমা চাওয়ার পরও তিনি রেহাই পাননি। হেফাজতের কর্মীরা তাঁকে বেদম প্রহার করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও প্রশাসনের মধ্যে আরও অনেককে পাওয়া যাবে, যাঁরা প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে হেফাজতকে সমর্থন করেন। সুনামগঞ্জের শাল্লায় রফিকুল ইসলাম নামে যে ইউপি সদস্যের নেতৃত্বে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা হলো, তিনি স্থানীয় যুবলীগের নেতা। আবার হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে যে তরুণ স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি যুব দলের কর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনুসারীর ভূমিকাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? শেষ পর্যন্ত ধর্মই কি বিচারের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াল। বিএনপির কর্মীর স্ট্যাটাসের বিরুদ্ধে স্থানীয় মুসলমানেরা ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে যুবলীগের নেতা ও ইউপি সদস্য সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলায় নেতৃত্ব দিলেন। তাহলে কে কার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, তা বুঝতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ার প্রয়োজন হয় না।

নারায়ণগঞ্জ, সালথা, শাল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে যা ঘটেছে, তাকে এককথায় বলা যায় ল–লেসনেস বা আইনের শাসনের প্রবল অনুপস্থিতি। অতীতে এ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলে প্রশাসন স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবিলা করত। দফায় দফায় বৈঠক করত। এখন প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের, এমনকি ক্ষমতাসীন দলটির সম্পর্কও সুখকর নয়। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জ জেলার আওয়ামী লীগের এক নেতা আলাপ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এখন দেশে যা চলছে, তা প্রশাসনিক গণতন্ত্র। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডেমোক্রেসি।

শেষে আরেকটি কথা বলা জরুরি মনে করি। সব অঘটনের দায় পাইকারিভাবে বিএনপি, জামায়াত-শিবির কিংবা হেফাজতের ওপর চাপানোও ঠিক নয়। ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে ভবিষ্যতে এ রকম অঘটন আরও ঘটতে পারে। শাল্লার ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের কোনো ভূমিকা ছিল না। ফরিদপুরের সালথায় প্রশাসনের হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে অঘটন ঘটেছে। স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গের দায়ে প্রশাসন জেল-জরিমানা করতে পারে। কাউকে লাঠিপেটা করতে পারে না। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রিসোর্টে দুই ঘণ্টা অবস্থান করার পরও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কী করবে। তারা কি ইচ্ছা করেই হেফাজতের কর্মীদের আসার অপেক্ষা করছিল?

রিসোর্টে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে গিয়ে হেফাজতের ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তুলেছেন। কিন্তু সাত বছর তাঁরা নিশ্চুপ ছিলেন কেন? কোন রাজনীতির হিসাবে-নিকাশে?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]