আওয়ামী লীগের 'কাউয়া' এবং বিএনপির 'রোষ' তত্ত্ব

.
.

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে বাহাসের মূল কারণ কতটা আদর্শগত আর কতটা ক্ষমতার লড়াই, সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। তবে এ কথার উদ্দেশ্য এই নয় যে এই দুটি দলের মধ্যে আদর্শগত কোনো ফারাক নেই। ফারাক অবশ্যই আছে। কিন্তু যতই মাঠের আওয়াজ জোরালো হচ্ছে, আদর্শগত ফারাকটা ততই কমে আসছে।
২০১৩ সালে বিএনপি যদি মৌলবাদী হেফাজতে ইসলামকে মদদ দিয়ে মহা অপরাধ করে থাকে, তাহলে বর্তমানে সরকার হেফাজতের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী পাঠ্যবই থেকে ‘অবিশ্বাসীদের’ রচনা বাদ দিয়ে বড় পুণ্যের কাজ করেছে, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। প্রগতিশীল শিক্ষানীতির প্রণয়নকারী আওয়ামী লীগের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির কেউ এর প্রতিবাদ করেননি, বরং তাঁরা মনে মনে খুশি হয়েছেন এই ভেবে যে তাঁদের আরাধ্য কাজটি আওয়ামী লীগই করে দিয়েছে।
ফলে এই শতকের কোনো এক সময়ে (আওয়ামী লীগ ২০৪১ সালতক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছে) যদি বিএনপি বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসে, তাদের নতুন করে পাঠ্যবই পরিবর্তন করার জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হবে না। আর যারা সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা ও সমালোচনা করছেন, তাঁদের ক্ষমতাসীনেরা খুব একটা পাত্তা দেন বলে মনে হয় না। বহু বছর আগে একবার একজন প্রগতিশীল শিক্ষাবিদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ পরামর্শ চায় না, সমর্থন চায়। তার ভালো কাজেও যেমন সমর্থন দিতে হবে, তেমন মন্দ কাজের সমালোচনা করা যাবে না।
কেননা বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার মানুষের ভরসাস্থল বামেরা ভাগ হতে হতে নিজেদের এতটাই শক্তিহীন করে ফেলেছেন যে কেউ তাঁদের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। আর আওয়ামী লীগ ভাবে, ওরা যাবে কোথায়? বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে তো হাত মেলাতে পারবে না, তাদের সঙ্গেই থাকতে হবে। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে হাত না মেলানোর অর্থ এই নয় যে আওয়ামী লীগ প্রগতিশীলতার নামে দেশবাসীর ওপর হেফাজতি শিক্ষা ও দর্শন চাপিয়ে দেবে, আর সবাই তা মুখ বুজে মেনে নেবে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক—এ কথা তাঁর শত্রুও বলবেন না। বরং বিএনপি আমলে তিনি সত্য উচ্চারণ করতে গিয়ে নিগৃহীত ও কারারুদ্ধ হয়েছেন। সেই মুনতাসীর মামুন যখন বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্য ফারাকটা ক্রমেই কমে আসছে, তখন সত্যি ভরসা রাখার কোনো জায়গা থাকে না। ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা প্রগতিশীলতা কেবল সংবিধানে লেখা থাকলেই হয় না। সেটি রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে অনুশীলন করতে হয়। সেই কাজটি সরকার করছে কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুললেই ভোটের হিসাব দেখাবেন। আবারও মুনতাসীর মামুনের শরণ নিয়ে বলছি, বাংলাদেশের মানুষের ঝোঁক যদি ডানপন্থার দিকেই থাকে, আওয়ামী লীগও কি সেদিকেই হাঁটবে? বিএনপিও একই যুক্তিকে জামায়াতের সঙ্গে ‘ঘর’ করছে।

২.
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দলীয় সভায় বক্তব্য দেন। অন্যদের মতো রাখঢাক করে কিছু বলেন না। সরাসরি কথা বলেন। মাঝেমধ্যে নেতা-কর্মীদের হুমকি-ধমকিও দেন। ওবায়দুল কাদের মাঠের মানুষ বলে মাঠের ভাষাতেই কথা বলেন। সম্প্রতি সিলেটের সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় প্রতিনিধি সমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘প্রচার লীগ, তরুণ লীগ, কর্মজীবী লীগ, ডিজিটাল লীগ, হাইব্রিড লীগ আছে। কথা হাছা, সংগঠনে কাউয়া ঢুকছে। জায়গায় জায়গায় কাউয়া আছে। পেশাহীন পেশিজীবী দরকার নেই। ঘরের ভেতর ঘর বানানো চলবে না। মশারির ভেতর মশারি টানানো চলবে না।’
ওবায়দুল কাদের নেতা–কর্মীদের বিএনপি নিয়ে বিচলিত না হতে এবং আগামী নির্বাচনের আগে কথা কম বলে বেশি বেশি কাজ করতে বলেছেন। তবে আওয়ামী লীগের নেতারা কাজের চেয়ে কথাই বেশি বলছেন বলে মানুষ মনে করে। আর তাঁদের প্রায় সব কথার লক্ষ্য ও উপলক্ষ বিএনপি। তাতে মনে হয়, মুখে না বললেও বিএনপি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা একটু বেশিই বিচলিত আছেন।
ওবায়দুল কাদেরের মুখে কাউয়া শব্দটি শুনে রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের কথা মনে পড়ল। সেই গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র মিনি তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বাবা, রামদয়াল কাককে “কউয়া” বলে কেন?’ বাবা কী জবাব দিয়েছিলেন জানি না। কাক চরিত্রের দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত কাকের মধ্যে অসম্ভব ভ্রাতৃত্ববোধ রয়েছে। কোথাও একটি কাক মারা গেলে শত শত কাক এসে সেখানে হাজির হয়। শোক প্রকাশ করে। কাকের দ্বারা মৃত কাকের সৎকারের কথাও শোনা যায়। আবার কাক যে বাসা বাঁধে, সেই বাসায় কোকিল এসে ডিম পাড়ে। সে ক্ষেত্রে কাককে পরোপকারী পাখি বলা হয়।
তবে ধারণা করি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাকের এই চরিত্রটি মনে রেখে কথাটি বলেননি। তিনি বলেছেন কাকের পরজীবী চরিত্রের কথা। বাসাবাড়ি কিংবা যেকোনো স্থানে রক্ষিত কোনো খাবার থাকলে কাক তা ছোঁ মেরে নিয়ে যায়।
তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হয় অকপটে এ রকম একটি সত্য কথা বলার জন্য। তবে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়া কাউয়ার সংখ্যা কত এবং তারা দলের বা দেশের কী কী সম্পদ ছোঁ মেরে নিয়েছেন সেটি জানালে আমরা আরও কৃতার্থ হতাম। এখন তাঁর দায়িত্ব হবে দলে ঢুকে পড়া ওই সব সুযোগসন্ধানী কাউয়াকে বের করে দেওয়া এবং নতুন কাউয়া যাতে ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকা। নির্বাচনের আগে দলকে পরিচ্ছন্ন রাখার এটাই হতে পারে আওয়ামী লীগের বড় কাজ।

৩.
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থকদের বিজয়কে ‘ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে জনরোষের বহিঃপ্রকাশ’ বলে অভিহিত করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। শনিবার নিজের টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিজয়ীদের অভিনন্দন। এ বিজয় ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে জনরোষের বহিঃপ্রকাশ।’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এবারের নির্বাচনে (২০১৭-১৮) সভাপতি, সম্পাদকসহ ১৪টি পদের মধ্যে আটটিতে জয়ী হয়েছেন বিএনপি ও জামায়াত-সমর্থক আইনজীবীরা। অন্যদিকে সহসভাপতি, সহসম্পাদক, কোষাধ্যক্ষসহ ছয়টি পদে জয়ী হন আওয়ামী লীগ-সমর্থক আইনজীবীরা। প্রধান দুটি পদসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ পদে বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে সমিতিতে এবার আবার বিএনপি-জামায়াতসমর্থিত আইনজীবীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গত বছর সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ পেয়েছিল আওয়ামী লীগপন্থী প্যানেল।
জেলা পর্যায়ের অধিকাংশ আইনজীবী সমিতির নির্বাচনেও বিএনপিপন্থী আইনজীবী প্যানেল জয়ী হয়েছে। এবার স্বাধীনতা
দিবসে ঢাকায় বিএনপির মিছিলও চোখে পড়ার মতো। দীর্ঘদিন পর রাজপথে এ রকম একটি মিছিল করতে পেরে কর্মীরাও উজ্জীবিত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সেই বিজয়ের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে যা বলেছেন, তা মোটেই গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় নয়। তিনি মনে করেন, এই ফলাফল ‘ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে জনরোষের বহিঃপ্রকাশ’। নির্বাচনে জয়-পরাজয় আছে। এক পক্ষ জয়ী হবে, আরেক পক্ষ পরাজিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে রোষ বা ক্রোধের প্রশ্ন আসে কী করে?
খালেদা জিয়ার বক্তব্য সঠিক হলে এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিএমএতে আওয়ামী সমর্থকদের বিজয়কে কি মানুষ বিএনপির প্রতি জনরোষ হিসেবে চিহ্নিত করবে? সমাজের অগ্রবর্তী এসব পেশাজীবী সংগঠনগুলোর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব পেশাজীবীদের স্বার্থ রক্ষা এবং পেশার উৎকর্ষ সাধন। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে পেশাজীবী সংগঠনগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধ ছাত্রদের পর আইনজীবী ও সাংবাদিকেরাই প্রথম রাজপথে নেমে এসেছিলেন। কিন্তু হালে এসব সংগঠনের দলানুগত ভূমিকা আমাদের পীড়িত করে। তারপরও আইনজীবী সমিতি কিংবা চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ একই ছাতার নিচে কাজ করছে। সাংবাদিকেরা তাও পারেননি। স্বৈরাচারী এরশাদ আমলে সাংবাদিক ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ থাকলেও গণতান্ত্রিক আমলে তারা ভাগ হয়ে গেছে।
এই বিভাজন আদর্শের না ক্ষুদ্র স্বার্থের, একদিন ইতিহাসই তা বিচার করবে।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]